বাইরের দরজা

দক্ষিণের বারান্দার প্রযোজনায় জ্ঞান মঞ্চে মঞ্চস্থ হল মোহিত চট্টোপাধ্যায়ের 'বাইরের দরজা'। সৌমিত বসুর নির্দেশনায়। ভাষা এবং বিষয়বস্তু কবিতার মতোই। রহস্যময়। গভীর। সঙ্কেতধর্মী। জোগায় নতুন ভাবনার রসদ। নাটকটি দেখে এসে লিখলেন অংশুমান চক্রবর্তী

Must read

অবিরাম বৃষ্টি। তার মধ্যেই ৩১ জুলাই, কলকাতার জ্ঞান মঞ্চে ভিড় জমিয়েছিলেন নাট্যপ্রেমীরা। দক্ষিণের বারান্দা প্রযোজিত ‘বাইরের দরজা’ নাটকের আকর্ষণে। রূপমঞ্জরীর ব্যবস্থাপনায় মঞ্চস্থ হয়েছে নাটকটি। দর্শকদের আগ্রহ ছিল তুঙ্গে। কারণ এই নাটকের নাটককার মোহিত চট্টোপাধ্যায়। নাটক এবং চিত্রনাট্য লিখে খ্যাতি অর্জন করলেও, মোহিত চট্টোপাধ্যায়ের সাহিত্য-জীবনের সূচনা হয়েছিল কবি হিসেবে। লিখেছেন বিভিন্ন পত্রিকায়। প্রকাশিত হয়েছে কবিতার বই। দুর্ভাগ্যের বিষয়, একটা সময়ের পর তিনি কবিতা লেখা ছেড়ে দেন। যদিও কবিতা তাঁকে ছাড়েনি। তাঁর নাটকের মধ্যেও তুমুলভাবে মিশে রয়েছে কাব্য-উপাদান। দেখা যায় রহস্যময়তা। সংলাপের ভিতর দিয়ে বলেছেন সময়ের কথা। সমাজের কথা। এক যুগ আগে প্রয়াত হয়েছেন। আজও তাঁর যে-কোনও নাটক দেখলে বা পড়লে মনে হয়, যেন এই সময়ের কথা বলা হয়েছে। বেশকিছু নাটকের ভাবনা চিরকালীন। যুগের পর যুগ মানুষ নতজানু হয় বিষয়বস্তুর কাছে। ছিটেফোঁটা বিনোদন নেই, তাঁর নাটক মানুষকে জাগায়। ভাবায়। বাস্তবধর্মী এবং রাজনৈতিক নাটকের পাশাপাশি লিখেছেন মনস্তাত্ত্বিক নাটক। তেমনই একটি নাটক ‘বাইরের দরজা’। রচিত হয়েছে চারটি চরিত্র সামনে রেখে। মঞ্জু, অশোক, কমল এবং পাহারওয়ালা।

আরও পড়ুন-ধনকড়-ইন্ডিয়া জোট বিরোধ, ইমপিচমেন্ট প্রস্তাব আনার প্রস্তুতি বিরোধী শিবিরের

মঞ্জু এক সাধারণ নারী। অশোক তার অতীত। কমল বর্তমান। অশোক এক রাতে সময়ের জাল ছিঁড়ে হাজির হয় মঞ্জুর সামনে। জাগিয়ে তোলে অতীত-স্মৃতি। মঞ্জু সমস্তকিছু তীব্রভাবে অস্বীকার করতে চায়। ভুলতে চায়। কিন্তু অশোক নাছোড়। মঞ্জুর হারিয়ে যাওয়া কিশোরীবেলাকে সামনে এনে দাঁড় করায়।
দুজনের কথোপকথনের মাঝে হাজির হয় কমল। মঞ্জুর বর্তমান। কমল মঞ্জুর কাছে নিজেকে সম্পূর্ণ উন্মোচিত করে না। মঞ্জুও তাই। এর পিছনে কাজ করে একে অপরকে হারানোর ভয়। কমল জানতে পেরে যায় অশোক এবং মঞ্জুর অতীত। বাইরের দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকে পড়ে সন্দেহের বীজ। ধীরে ধীরে আলগা হয়ে আসে সম্পর্কের বাঁধন। সন্দেহের মাত্রা এতটাই তীব্র হয়ে ওঠে যে, তারা মুখ্য বিষয়কে পাশে সরিয়ে গৌন বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে বসে। তাদের কোপে পড়ে পাহারাওয়ালা। তিন সন্দেহবাতিক ছক কষে পাহারাওয়ালাকে হত্যা করে। এই পাহারাওয়ালা আসলে সন্দেহের প্রতীক। কিন্তু যে সন্দেহ একবার মনের অন্দরে বাসা বাঁধে, তার মৃত্যু হয় না। চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সম্পর্ক। তাসের ঘরের মতো হুড়মুড়িয়ে ভেঙে যায়। খসে পড়ে মাটির প্রলেপ। বেরিয়ে আসে খড়। পাহারাওয়ালা-হত্যার দায় নিতে অস্বীকার করে অশোক এবং কমল। দুজনেই বেরিয়ে যায়। মঞ্জু বোঝে সে একা, ভীষণ একা। অতীতে যেমন একা ছিল, আজও তাই। সন্দেহ তাদের পারস্পরিক সম্পর্ককে টুকরো টুকরো করে দিয়ে যায়।

আরও পড়ুন-জহরের প্রশ্নে অস্বস্তিতে রেলমন্ত্রী

মঞ্জুর চরিত্রে অভিনয় করেছেন নীলাঞ্জনা দাস মণ্ডল। তাঁকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে নাটকটি। সঙ্গত করেছেন বাকিরা। ভীষণরকম টানাপোড়েন দেখা যায় এই নারী চরিত্রের মধ্যে। সেইসঙ্গে ভাঙন। হাহাকার। আঙুলের ফাঁক দিয়ে গলে যায় সম্পর্ক। মুঠোয় ধরতে পারে না। গ্রাস করে হতাশা। শেষমেশ উদযাপন করে নিজের একাকিত্ব। চরিত্রটি আন্তরিকতার সঙ্গে ফুটিয়ে তুলেছেন অভিনেত্রী। যদিও তাঁকে নিখুঁত বলা যায় না। কোনও কোনও সময় অভিনয় স্বাভাবিক-মাত্রা ছাপিয়েছে। কোনও কোনও সময় নেমে গেছে খাদে। ত্রুটিমুক্ত নয় উচ্চারণও। কিছু জায়গায় ফুটে উঠেছে জড়তা। আর একটু বলিষ্ঠতা দাবি করে চরিত্রটি।
অশোকের চরিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন সৌমিত বসু। তিনি তুখোড় অভিনেতা। দাপিয়ে বেড়িয়েছেন সারা মঞ্চ জুড়ে। তাঁর চরিত্রে রয়েছে কিছুটা নেগেটিভ শেড। আলো এবং কালো। যে মন মঞ্জুর প্রতি সহানুভূতিশীল, সেই মন তীব্র ঘৃণা উগরে দেয় ধূর্ত অশোকের প্রতি। এই ঘৃণা একজন আপাত খল-চরিত্রের অভিনেতার পুরস্কার।
কমলের চরিত্রে অভিনয় করেছেন তুহিন মাইতি। সরলরৈখিক চরিত্র। বেশি ওঠানামা নেই। নিজের সীমাবদ্ধতা জানেন অভিনেতা। তাই নিজেকে অতিরিক্ত ছড়িয়ে দেওয়ার অকারণ চেষ্টা করেননি।
বিস্মিত করেছেন রঞ্জন দাস। পাহারাওয়ালার চরিত্রে। কোনও সংলাপ নেই। নির্বাক। শুধুমাত্র অভিব্যক্তির প্রকাশ ঘটিয়ে অকল্পনীয় অভিনয় করেছেন। মুখ নয়, কথা বলেছে তাঁর দুটি চোখ। নীরবতার ভাষা বুঝে নিতে কোনওরকম অসুবিধা হয় না।

আরও পড়ুন-সুপ্রিম নির্দেশে বাধা কাটল জামিনে

নাটকের নির্দেশক সৌমিত বসু এই সময়ের একজন গুরুত্বপূর্ণ কবি। নাটকটির ভাষা এবং বিষয়বস্তু কবিতার মতোই। রহস্যময়। গভীর। সংকেতধর্মী। ফলে এই স্বল্প দৈর্ঘ্যের নাটকের মূল সুর খুঁজে নিতে এবং নাটকটির প্রাণ প্রতিষ্ঠা করতে তাঁকে কোনোরকম বেগ পেতে হয়নি। তিনি বেঁধেছেন আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে। সার্থকভাবে করেছেন বিনির্মাণ। আলোকসম্পাতে ছিলেন প্রদীপ গিরি। আবহ রচনা করেছেন চন্দ্রাবলী মুখোপাধ্যায়। সাজসজ্জায় গোপাল মাইতি। শুরু এবং শেষে দুটি রবীন্দ্র-গানের ব্যবহার ছিল যথাযথ।
মফসসলের দল ‘দক্ষিণের বারান্দা’। ২৬ বছর নিয়োজিত রয়েছে নাট্যচর্চায়। এর আগে ১৭টি নাটক মঞ্চস্থ করেছে। মহানগরীতে নাটক করার পাশাপাশি জেলার বিভিন্ন মঞ্চে দর্শকদের অজস্র অভিনয় উপহার দিয়েছে। অংশ নিয়েছে রাজ্য সরকারের নাট্য মেলাতেও। এই দলের প্রযোজনায় ১২৯ বার মঞ্চস্থ হল ‘বাইরের দরজা’। আশা করি, আগামী দিনে আরও অনেক আসরে মঞ্চস্থ হবে। সময় সুযোগ পেলে দেখে নিতে পারেন। সন্দেহ নেই, এই নাটক জোগাবে নতুন ভাবনার রসদ।

Latest article