সংবিধানকে মেরে ফেলার চেষ্টা চলছে, কিন্তু কাজটা মোটেই সহজ নয়

সংবিধান সম্পর্কে এবং সাধারণতন্ত্রের ধারণা সম্পর্কে কেন্দ্রের সরকারি পরিসরে এবং কেন্দ্রের শাসক দলের বিশেষ কোনও আগ্রহ নেই বলেই ৭৫ বছর পূর্তির মতো একটি উপলক্ষেও হাতে রইল গতানুগতিক দৃশ্যাবলি: রাষ্ট্রীয় কুচকাওয়াজ, সমরসজ্জা, শোভাযাত্রা ও পুরস্কার ঘোষণা, বাণিজ্যিক বিপণনের প্রসার ঘটানোর জন্য বিশেষ ছাড় এবং নাগরিক চড়ুইভাতি। লিখছেন আকসা আসিফ

Must read

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির পূর্বসূরি বিজেপির সর্বমান্য নেতা অটলবিহারী বাজপেয়ী সংসদে একাধিকবার তাঁর বক্তৃতায় বলেছেন, দল ক্ষমতায় আসবে-যাবে, সরকার তৈরি হবে, বিদায় নেবে, কিন্তু দেশ, দেশের লোকতান্ত্রিক কাঠামো যেন অক্ষুণ্ণ থাকে। না-হলে বিপদ অনিবার্য। গঠনমূলক বিরোধিতা, যুক্তিনির্ভর বিতর্ক আর সমালোচনা সংসদীয় রাজনীতির প্রাণ। সরকার পক্ষ যতই শক্তিশালী হোক, ভারতের সংসদ কিন্তু বিরোধীদের। তাকে কোনওভাবে লঘু করে দেখানোর চেষ্টা হলে, বিরোধীদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা হরণ করা হলে গণতন্ত্র বিপন্ন হতে বাধ্য। আর গণতন্ত্র বিপন্ন হওয়ার অর্থ, সংবিধানও খাদের কিনারায়।

দেশের স্বাধীনতা প্রাপ্তির ৭৫ বছর পূর্তিতে যে পরিমাণ আড়ম্বর হয়েছিল, সংবিধান (Constitution) প্রণয়নের ৭৫ বছর পরে সাধারণতন্ত্র দিবসের আহ্বানে তার এক আনা উৎসাহ উদ্দীপনাও দেখা গেল না। স্বাধীনতা দিবসের নিজস্ব মহিমা অবশ্যই অতুলনীয়, কিন্তু সব বিষয়ে সতত উচ্ছ্বাসে উদ্বেল হয়ে ওঠাই যে দেশের স্বভাব হয়ে দাঁড়িয়েছে, সেখানে বিশেষ উপলক্ষ থাকা সত্ত্বেও এমন নিস্তরঙ্গ সাধারণতন্ত্র দিবস বিস্ময়জনক।

আসলে এক্ষেত্রে অভাব আগ্রহের। সংবিধান সম্পর্কে এবং সাধারণতন্ত্রের ধারণা সম্পর্কে কেন্দ্রের সরকারি পরিসরে এবং কেন্দ্রের শাসক দলের বিশেষ কোনও আগ্রহ নেই বলেই ৭৫ বছর পূর্তির মতো একটি উপলক্ষেও হাতে রইল গতানুগতিক দৃশ্যাবলি: রাষ্ট্রীয় কুচকাওয়াজ, সমরসজ্জা, শোভাযাত্রা ও পুরস্কার ঘোষণা, বাণিজ্যিক বিপণনের প্রসার ঘটানোর জন্য বিশেষ ছাড় এবং নাগরিক চড়ুইভাতি। অথচ কিছুদিন আগেই দেশের নানা প্রান্তে সংবিধানের প্রস্তাবনা হয়ে উঠেছিল কেন্দ্রীয় শাসক শিবিরের দুরভিসন্ধির বিরুদ্ধে সংগঠিত প্রতিস্পর্ধী নাগরিকদের এক অসামান্য নৈতিক হাতিয়ার। বিরোধী রাজনীতিকরা, বিশেষত প্রধান বিরোধী দলের কেন্দ্রীয় স্তরের নেতারা বিভিন্ন উপলক্ষে সংবিধানের (Constitution) সারাৎসার সম্বলিত পুস্তিকা বা গ্রন্থ সঙ্গে নিয়ে রাজনৈতিক ও সংসদীয় সভায় সমাবেশে যোগ দিয়েছেন। শুধু এই ক্ষেত্রে নয়, শাসকরা কখনও সরাসরি, কখনও কৌশলে সংবিধানের উদার গণতান্ত্রিক চরিত্রটিকে বিপন্ন বা খর্বিত করার যে সব চেষ্টা চালিয়ে আসছেন, তার বিরুদ্ধে অভিযোগ এবং ক্ষোভবিক্ষোভ বিস্তর। শাসকরা প্রত্যাশিত ভাবেই এই অভিযোগ অস্বীকার করে থাকেন এবং সংবিধানের প্রতি মৌখিক শ্রদ্ধা জানাতে কসুর করেন না, নবনির্মিত সংসদ ভবনে প্রবেশ করে প্রধানমন্ত্রী সংবিধানকে সাড়ম্বরে প্রণাম করেন এবং অতঃপর সেই দৃশ্য বহুলপ্রচারিত হয়। অর্থাৎ— দৃশ্যে ও বাস্তবে— বর্তমান জমানায় সংবিধান এ দেশের রাজনীতিতে একটি গুরুতর বিষয়, রাজনৈতিক বিরোধ ও সংগ্রামের একটি প্রকরণ। সংবিধানকে রক্ষা করার জন্য এই সংগ্রাম অবশ্যই জরুরি।

আরও পড়ুন- এক্তিয়ার ছাড়িয়ে রাজনীতি করছেন মৃতার অভিভাবক, কড়া মন্তব্য ফিরহাদের

সংবিধান (Constitution) লিখতে আম্বেদকর ও তাঁর সহযোগীরা সময় নিয়েছিলেন দু’বছরেরও বেশি। ১৯৪৭ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে শুরু করে ১৯৪৯-এর শেষার্ধ্ব পর্যন্ত সংবিধান লেখার কাজ চলে। সংবিধান লেখা শেষ ও গৃহীত হয় ১৯৪৯-এর ২৬ নভেম্বর। আর তা কার্যকর করা শুরু হয় ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি। সেই থেকে ২৬ জানুয়ারি দিনটি ‘সাধারণতন্ত্র দিবস’ হিসেবে পরিচিত। মোদি সরকার এসেই ২০১৫ থেকে ২৬ নভেম্বর দিনটি পালন করছে ‘সংবিধান দিবস’ নামে। তার পরও প্রায় এক দশক কাটতে চলেছে। কিন্তু, সংবিধানের মূল আত্মা ভাল আছে কি? আজ এই প্রশ্নের মুখে গোটা দেশ এবং দেশের মানুষ। সংবিধান নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা কিছু কম হয়নি। কংগ্রেস সবচেয়ে বেশি সময় ক্ষমতায় থাকার সুবাদে একাই ৭৫ বারের বেশি সংশোধন করেছে। পিছিয়ে নেই মোদিজিও। দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এসেই নরেন্দ্র মোদি কাশ্মীরে ৩৭০ ধারার অবলুপ্তি ঘটান। রদ করেন মধ্যযুগীয় তিন তালাক প্রথা। ৩৭০ এবং ৩৫এ ধারার সৌজন্যে স্বাধীনতার সময় থেকেই জম্মু ও কাশ্মীর বিশেষ মর্যাদা পেয়ে আসছিল। সেই বিশেষ মর্যাদা শুধু কেড়েই নেওয়া হয়নি, পূর্ণ রাজ্যটিকে দুটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে ভেঙে দেওয়া হয়। আর তা করতে গিয়ে মাসের পর মাস উপত্যকায় সংবিধানের দেওয়া মৌলিক অধিকারগুলিকেই কেন্দ্র হরণ করে রাখে। বন্ধ থাকে ইন্টারনেট পরিষেবাও। যার দরুন সুপ্রিম কোর্টকে পর্যন্ত বলতে হয়, ইন্টারনেট পরিষেবা মানুষের মৌলিক অধিকার। সেইসঙ্গে আটক করে রাখা হয় শতাধিক কাশ্মীরি নেতানেত্রীকে। কোনও শুনানি ছাড়াই তাঁরা কার্যত দীর্ঘসময় গৃহবন্দি ছিলেন। সেই তালিকায় ছিলেন ওই রাজ্যের তিন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীও। সামগ্রিকভাবেই একের পর এক ঘটনা পরম্পরা গণতন্ত্র রক্ষার মানদণ্ডে ভারতের অবস্থানকে নীচের দিকে ঠেলে দিয়েছে। যেখানে শীর্ষ নেতানেত্রীরাই নিরাপদ নন, তাঁদের স্বাধীন চলাফেরাটুকুও নিয়ন্ত্রিত, সেখানে কিসের গণতন্ত্রের বড়াই! সংবিধানের লম্বাচওড়া লেখাজোখারই-বা দাম দেবে কে? এই প্রশ্ন কি অবান্তর?

এ দেশের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দল বিজেপির কথায় এবং কাজে দীর্ঘকাল যাবৎ যে মানসিকতা প্রকট হয়ে উঠেছে, তা সংবিধানের আদর্শের প্রতি শ্রদ্ধার পরিচয় দেয় না। একেবারে গোড়ার কথাটুকুই ধরা যাক। সেখানে বলা আছে যে, জনসাধারণ (‘উই, দ্য পিপল’) নিজেদের জন্য এই সংবিধান ‘রচনা’ করেছে। এই কথাটিই প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রের বীজমন্ত্র। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে সেই জনসাধারণকে বিজেপির মতো দল কতটুকু গুরুত্ব দিয়ে থাকে? জনসাধারণের ‘নামে’ নিজেদের আধিপত্য জারি করা এবং জারি রাখাই এদের উদ্দেশ্য। এই আধিপত্যবাদ বর্তমান শাসকদের ক্ষেত্রে এক উৎকট আকার ধারণ করেছে। ধরে এই রোগের প্রকোপ বেড়েছে এবং তার পরিণামে প্রজার তন্ত্র পর্যবসিত হয়েছে প্রজা শাসনের তন্ত্রে। ৭৫ বছর পরে এই অপ্রিয় সত্যটি স্বীকার করা এবং আত্মসংশোধন করা দরকার, তা না হলে আধিপত্যবাদের কবল থেকে যুক্তরাষ্ট্রীয় গণতন্ত্রকে রক্ষা করা উত্তরোত্তর কঠিনতর হতে বাধ্য।
এতকিছু বলার পরেও কিছু কথা থেকে যায়।
পদার্থবিদ্যা শেখায় স্থিতিস্থাপকতার (ইলাস্টিসিটি) একটা বিশেষ তাৎপর্য আছে। চাপ, তাপমাত্রা এবং বাইরের বলপ্রয়োগে (টেম্পারেচার, প্রেশার অ্যান্ড এক্সটারনাল ফোর্স) যে কোনও জিনিসের আকার ও চরিত্রের সাময়িক পরিবর্তন হতে পারে, কিন্তু তা সরে গেলেই আবার পুরনো অবস্থায় ফিরে যায়। এটাই পদার্থের ধর্ম। মনে রাখতে হবে, আমাদের সংবিধানও তাই—যত ক্ষমতাবান ধুরন্ধর শাসকই আসুন না কেন, সাময়িক পরিবর্তনের চেষ্টা হলেও অন্তরাত্মাকে তা স্পর্শ করে না। বাইরের পরিস্থিতি বদলালেই আবার যে কে সেই! এটাই বি আর আম্বেদকরের সংবিধানের মাহাত্ম্য।

Latest article