নির্বাচন কমিশনকে ঘিরে প্রশ্ন অনেক গভীরে

নির্বাচন কমিশনের স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা নিয়ে নানা প্রশ্ন। এই প্রশ্নগুলো আমাদের টের পাওয়াচ্ছে, আমরা ফ্যাসিবাদী সরকারের উঠোনে পৌঁছে গিয়েছি। লিখছেন পূর্ণেন্দু বসু

Must read

ভারতীয় নির্বাচনী ব্যবস্থার মূল নিয়ন্ত্রক হল নির্বাচন কমিশন (Election Commission of India)। সংবিধান নির্বাচন কমিশনকে এই অধিকার দিয়েছে। যাঁদের হাতে নিরপেক্ষ ও অবাধ নির্বাচনের দায়িত্ব, সেই নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগ নিয়ে মোদি সরকার সুপ্রিম কোর্টে যথেষ্ট কঠিন প্রশ্নের মুখে পড়েছে।
এক সপ্তাহ আগেই নতুন কমিশনার হিসেবে কেন্দ্রীয় সরকার পাঞ্জাব ক্যাডারের আমলা অরুণ গোয়েলকে নিয়োগ করেছে। ২৪ নভেম্বর, ২০২২ সুপ্রিম কোর্ট সেই নিয়োগ সংক্রান্ত ফাইল খতিয়ে দেখে প্রশ্ন তুলেছে, মাত্র ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কীভাবে তাঁকে নিয়োগ করা হল? বিচারপতি কে এস যোসেফের নেতৃত্বাধীন সাংবিধানিক বেঞ্চ প্রশ্ন করেছে, ‘‘এত তাড়াহুড়ো করা হল, একেবারে জরুরি ভিত্তিতে, আপনাদের বিবেচনা করারও সময় দরকার পড়েনি?”

নির্বাচন কমিশনের (Election Commission of India) স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা নিয়ে বিরোধী দলগুলি বারবার প্রশ্ন তুলেছে। নির্বাচনের সময় কমিশনের বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়ে বিশেষ পক্ষপাতিত্বের বিষয়গুলি সাধারণ মানুষের চোখেও ধরা পড়েছে। এর মধ্যেই নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের স্বচ্ছ্বতা নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে একগুচ্ছ মামলা হয়েছিল। অভিযোগ উঠেছিল, কেন্দ্রীয় সরকার নিজের অনুগত আমলাদেরই নির্বাচন কমিশনে নিয়োগ করে। সেই মামলাতেই সুপ্রিম কোর্ট নিয়োগ সংক্রান্ত ফাইল দেখতে চায়। ১৮ নভেম্বর নির্বাচন কমিশনার হিসেবে গোয়েলকে নিয়োগ করা হয়। তা নিয়েই ২৪ নভেম্বর প্রশ্ন তুলেছে সুপ্রিম কোর্ট।
এখানে উল্লেখযোগ্য যে, গোয়েল কেন্দ্রে ভারী শিল্পমন্ত্রকের সচিব ছিলেন। তাঁর ৩১ ডিসেম্বর অবসর নেওয়ার কথা ছিল। ১৮ নভেম্বর তিনি স্বেচ্ছাবসর নেন। সেদিনই সিদ্ধান্ত নিয়ে একদিন পরেই তাঁকে নির্বাচন কমিশনে নিয়োগ করা হয়। সুপ্রিম কোর্টের প্রশ্ন, নির্বাচন কমিশনে একটি পদ মে মাস থেকে ফাঁকা পড়েছিল। তা হলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তাড়াহুড়ো করে নিয়োগের কী প্রয়োজন পড়ল?

আরও পড়ুন-স্বামীজি রূপে জন্ম মোদির! রাহুল উন্মাদ, বলল তৃণমূল

গোয়েলের নিয়োগ নিয়ে যে প্রশ্ন উঠেছে, তা সঠিক এবং সর্বোচ্চ আদালতের যেসব মন্তব্য তা সঙ্গত কারণেই। কিন্তু এসবের মধ্যেই যে প্রশ্নগুলি ঘুরপাক খাচ্ছে, সেগুলি রয়েছে অনেক গভীরে। যা ভারতীয় সংসদীয় ব্যবস্থার স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা নিয়েই প্রশ্ন তুলে দিয়েছে।
গত কয়েক দশক ধরেই লক্ষ করা যাচ্ছে যে, নির্বাচন কমিশনের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক সংস্থার স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতার অবনমন ঘটছে। বারবার এই অভিযোগ উঠছে যে, কমিশন শাসকদলের অঙ্গুলিহেলনে চলে। বর্তমান সময়ে নির্বাচনে শাসকদলের সুবিধা করে দেওয়াই যেন কমিশনের কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে নির্বাচনের সময় প্রচার, ভোটগ্রহণ, গণনা প্রভৃতি চলার সময় নির্বাচনবিধি লঙ্ঘনের গুচ্ছ গুচ্ছ অভিযোগ কমিশনে জমা পড়ে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বিরোধী দলগুলি প্রতিকার পায় না। পশ্চিমবঙ্গে গত বিধানসভা নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদি ও অমিত শাহের নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনের বিষয়গুলি তার উদাহরণ। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর উপর যেভাবে নিরন্তর ব্যক্তিগত আক্রমণ করা হয়েছিল তা কোনও মতেই মেনে নেওয়া যায় না। কেন্দ্রীয় শাসকদলের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেবার ক্ষেত্রে আশ্চর্যজনক ভাবেই কমিশন চোখ বুজে থাকে।

গত নভেম্বর মাসে মুখ্য নির্বাচন কমিশনার এবং অন্য দুই কমিশনার প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে ডাকা বৈঠকে হাজিরা দেন। করোনা অতিমারীর সময় কমিশনের যত নিষেধাজ্ঞা বিরোধীদের ক্ষেত্রে লাগু হলেও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষেত্রে ছাড় ছিল। প্রধানমন্ত্রীর প্রচার কর্মসূচি শেষ হবার পরই কড়া নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। প্রধানমন্ত্রী একাধিকবার বিধি লঙ্ঘন করলেও সাতখুন মাপ। আসন্ন গুজরাত নির্বাচনের ক্ষেত্রেও নির্বাচনের সূচি ঘোষণা হয় প্রধানমন্ত্রীর প্রাক-নির্বাচনী ঘোষণা, প্রতিশ্রুতি, শিলান্যাস, উদ্বোধন পর্ব শেষ হবার পর। এর অর্থ হল, কমিশন নিরপেক্ষতা রক্ষার ক্ষেত্রে দৃঢ় অবস্থান নিচ্ছে না বা পারছে না। এখানেই প্রশ্ন যে, তাহলে কমিশনে কি তেমন লোকেদেরই নেওয়া হয় যাঁরা শাসকদলের বিরুদ্ধে সক্রিয় হবেন না? তাহলে কি পছন্দের লোকদেরই বেছে বেছে নেওয়া হয়? এভাবেই কি দলীয় আধিপত্য গণতন্ত্রের ভিত নড়িয়ে দিচ্ছে না।
নির্বাচন কমিশনের (Election Commission of India) মতো একটি স্বয়ংশাসিত সংস্থাকে দলের অধীনে নিয়ে আসা দলীয় আধিপত্যের প্রকাশ, তা সেখানেই সীমাবদ্ধ নয়। সংবিধান-নির্দিষ্ট সমস্ত স্বশাসিত সংস্থার ক্ষেত্রে একই ভাবে এই আধিপত্যের বিস্তার ঘটেছে। যার ফলে দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ক্রমশই ভেঙে পড়ছে।
বর্তমানে কেন্দ্রীয় ক্ষমতায় থাকা শাসকদলের কাছে ক্ষমতায় টিকে থাকাটাই মূল লক্ষ্য। ক্ষমতায় টিকে থাকতে গেলে কেন্দ্রীয় স্বশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলিকে সার্বিক নিয়ন্ত্রণের মধ্যে নিয়ে আসা প্রয়োজন। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক থেকে শুরু করে সিবিআই, ইডি, ইউজিসি ইত্যাদি সংস্থাগুলিকে নিয়ন্ত্রণে আনার প্রক্রিয়া প্রথম থেকেই শুরু করেছে মোদি সরকার। ধীরে ধীরে তা ব্যক্তি ক্ষমতার অঙ্গীভূত হচ্ছে। স্ব-শাসিত সংস্থার স্বাধীনতা থেকে, নাগরিক ও ব্যক্তি স্বাধীনতা বলে কিছু থাকবে না— এটাই মোদি শাসনের মূল লক্ষ্য। কাজেই নির্বাচন কমিশন বাদ যাবে কেন? বর্তমান জমানার এই সাধারণ সত্যটি যত তাড়াতাড়ি আমরা বুঝি এবং তার প্রতিকারের জন্য বিরোধিতায় সোচ্চার হই— সেটাই সময়ের দাবি।
ইতিহাস আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, আমরা ফ্যাসিবাদ থেকে বেশি দূরে নেই। বিশ্ব জুড়ে এক নতুন ফ্যাসিবাদের উদ্ভব হচ্ছে। পুতিনের ইউক্রেন যুদ্ধ, ট্রাম্পের আমেরিকান গণতন্ত্রের উপর আঘাত— এ-সবই ফ্যাসিবাদী মতাদর্শের অভিযান। ভারতে হিন্দুরাষ্ট্র ভাবনা সেই একই মতাদর্শের প্রকাশ। সর্বগ্রাসী আধিপত্যবাদ— সেই মতাদর্শেরই অঙ্গ। বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশে আজ চলছে গণতন্ত্র ধ্বংসের প্রক্রিয়া। নির্বাচন কমিশন সেই সামগ্রিক প্রক্রিয়ারই একটি অংশ। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা এই ব্যবস্থাকে বলেন— ‘স্বাধীনতার ভয়’। এই শাসকরা মানুষের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে না। নরেন্দ্র মোদি সেই শাসকদেরই প্রতিনিধি। একটি গণতান্ত্রিক কোয়ালিশনই পারে এই ব্যবস্থাকে পরাজিত করতে।

Latest article