দুর্গত মানুষগুলোর জন্য কেন্দ্রীয় কোঁদল আছে, সাহায্য কই?

মিথ্যে প্রচার আর প্রতিশ্রুতি বিলিয়ে ভোটযন্ত্রে ডিভিডেন্ড তোলাই যখন শাসক দলের এক ও একমাত্র লক্ষ্য হয়, তখন সেই সংকীর্ণ রাজনীতি চরম ব্যর্থতার অধিক কিছু প্রসব করে না। লিখছেন অনির্বাণ সাহা

Must read

আস্তে আস্তে ছন্দে ফিরছে উত্তরবঙ্গ। স্বাভাবিক জীবনের চাকা ফিরে আসছে ক্রমশ।
এটাই স্বাভাবিক। যে কোনও বিপর্যয়ের পর।
রাজ্য প্রশাসন সক্রিয়। মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং সক্রিয়, বরাবরের মতোই। ডুয়ার্সকে ঘিরে উত্তরবঙ্গে যে প্রাকৃতিক বিপর্যয় নেমে এসেছে সেটাও কাটিয়ে উঠছি আমরা। আবহাওয়া আপাতত অনুকূল। সড়ক এবং ট্রেন যোগাযোগও স্বাভাবিক হয়ে আসছে। উত্তরবঙ্গের অর্থনীতি বহুলাংশে পর্যটন-নির্ভর। তাই ওই অঞ্চলের জনজীবনে স্বাভাবিকতা ফেরাতে পর্যটনকে ছন্দে ফেরানো আবশ্যক। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে রাজ্যের মা-মাটি-মানুষের সরকার তৎপর হতেই অধিকাংশ পর্যটন কেন্দ্রও দ্রুত ছন্দে ফিরছে।
আসলে কেবল সুখ বা আনন্দই নয়, দুঃখ বিষাদ বিপদ-আপদও চিরস্থায়ী হয় না। বিপর্যয় দুর্দিন প্রভৃতি আসে আবার চলেও যায় কালের নিয়মে। মানুষ তৎপর হলে দুঃসময় কেটে যায় দ্রুত। এমনটাই তো জেনে এসেছি চিরকাল। এবারও তার ব্যতিক্রম ঘটবে কোন সূত্র মেনে!

আরও পড়ুন-চর্চায় সিরিজ এবং সিরিয়াল

তবু, তবুও মানতেই হবে, বিপর্যয়ের মলিন স্মৃতি মোটেই রাতারাতি উবে যাওয়ার নয়। প্রকৃতির রোষের চার-পাঁচদিন পর তরাই ডুয়ার্স-সহ বাংলার পাহাড়ি অঞ্চলে ধ্বংসের চিহ্ন তাই বিদ্যমান। উল্লেখ্য, পাহাড়ের রানি দার্জিলিংয়েই ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ সর্বাধিক। প্রাথমিক হিসেব অনুযায়ী, ওই জেলায় ক্ষয়ক্ষতির আর্থিক পরিমাণ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গিয়েছে। পাহাড়ের মানুষকে ভালভাবে বাঁচাতে হলে এই ক্ষতি অবিলম্বে পূরণ হওয়া জরুরি। পার্শ্ববর্তী একাধিক জেলার ক্ষতি যোগ করলে অঙ্কটি আরও বিপুল!
আর এই আবহেই একটা জিজ্ঞাসা মাথাচাড়া দিচ্ছে। এবং সেটা মোটেই অমূলক জিজ্ঞাসা নয়। এত বড় কাজ কি রাজ্য সরকারের একার সীমিত আর্থিক ক্ষমতায় সম্পন্ন করতে হবে? কেন্দ্ররও কি এই ব্যাপারে দরাজ এবং আন্তরিক হওয়া উচিত ছিল না?
কিন্তু সেসব দূর-অস্থ্! কোথায় কী! বঙ্গ বিজেপির ইশারায় রাজ্যে তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে আকচা-আকচি আর তরজায় জড়িয়েছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। সোশ্যাল মিডিয়ায় পশ্চিমবঙ্গ সরকার এবং তৃণমূলকে বিঁধেছেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী লিখেছেন, ‘তৃণমূলের উচিত, হিংসায় প্ররোচনা না দিয়ে দুর্গতদের পাশে দাঁড়ানো। রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা এমন হওয়া উচিত নয়।’ কিন্তু কথাটা হল, কোনও প্রমাণ ছাড়াই প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে রাজনীতির রং লাগাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী। এটা দুর্ভাগ্যজনক! যখন মানুষ বিপন্ন, এমনকী মরছেও তখন দেশের অভিভাবকের এই ভূমিকা অনভিপ্রেত এবং কুরুচিকর। তিনি সংকীর্ণ রাজনৈতিক তরজায় মগ্ন হলে উদ্ধার, ত্রাণবণ্টন, পুনর্বাসনের মতো অত্যন্ত জরুরি প্রক্রিয়া ব্যাহত হতে পারে। তাতে মানুষের দুর্ভোগ বাড়বে। প্রধানমন্ত্রীর উচিত, দলীয় রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে সর্বতোভাবে বাংলার দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়ানো। আয়লা-আম্ফান এবং পরবর্তী প্রতিটি বিপর্যয়ে কিন্তু বাংলার মানুষ কেন্দ্রকে পাশে পায়নি। এবার অন্তত দিল্লি মানবিক মুখ নিয়ে এগিয়ে আসবে, সবাই ভেবেছিলাম। বঙ্গ বিজেপিরও উচিত ছিল, এই দাবিতে সোচ্চার হওয়া।
কিন্তু যেটা হল সেটা তদ্বিপরীত।

আরও পড়ুন-হিউম পাইপে হচ্ছে দুধিয়া সেতু, বাড়ি তৈরি করছে রাজ্য, যুদ্ধকালীন তৎপরতায় চলছে উত্তরবঙ্গের পুনর্গঠনের কাজ

দুর্ভাগ্যের বিষয় এই যে, বাংলার এই ভয়াবহ বিপদেও মোদি সরকার রা কাড়ছে না। দার্জিলিং লোকসভা কেন্দ্র দীর্ঘদিন কেন্দ্রের শাসক দলের দখলে। স্বভাবতই সেখানকার পীড়িত মানুষজন কেন্দ্রের আন্তরিক সহযোগিতা প্রত্যাশা করেন। শুধু এটাই নজরে আসছে যে, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং রাজ্যের শাসক দলের নেতা-মন্ত্রীরা যখন দুর্গত মানুষজনকে বাঁচাতে জান লড়িয়ে কাজ করছেন, তখন বিজেপি নেমেছে সংকীর্ণ রাজনীতির খেলায়। তাদের এমপি-এমএলএ-রা ছুটছেন বিপর্যস্ত এলাকা পরিদর্শনে! সেখানে পৌঁছে যাচ্ছেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীও। বিজেপির নেতাকর্মীদের ভাবখানা এই যে, তাঁরা মানুষের পাশে দাঁড়াবার কমপিটিশনে অবতীর্ণ। কিন্তু ‘ফটোশ্যুটওয়ালাদের’ দেখে স্থানীয় মানুষ উল্টে খেপে যাচ্ছেন। তাঁরা ধরে নিচ্ছেন যে তাঁদের দুর্দিনকে সামনে রেখে প্রচারসর্বস্ব গেরুয়াবাহিনী ভোটের বাজার করতে নেমে পড়েছে। ব্যাপারটাকে তাঁরা তাঁদের কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে হিসেবেই দেখছেন। এ-নিয়ে ইতিমধ্যে উত্তরবঙ্গের একাধিক স্থানে চরম বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়েছে। তাতে সুরাহার পরিবর্তে, রাজ্য সরকারের ত্রাণকার্যই ব্যাহত হওয়ার উপক্রম হয়। তর্কের খাতিরে ধরা গেল, গেরুয়া শিবির বা দিল্লিওয়ালারা বাংলার মানুষের পাশে দাঁড়াবার জন্য আকুল। কিন্তু তার প্রমাণ কোথায়? যে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির পায়ের নিচে সরষে, যিনি বছরভর দুনিয়া চষে বেড়ান, উত্তরবঙ্গে বেনজির বিপর্যয়ে পড়া মানুষের পাশে তাঁকে দেখা যাচ্ছে না কেন? বেশ, তিনি এত ব্যস্ত যে আসতে পারছেন না, কিন্তু তাঁর সরকারের অন্য মন্ত্রীরা এসেও তো উপযুক্ত আর্থিক প্যাকেজ ঘোষণা করতে পারেন! গালভরা প্যাকেজ ঘোষণা কোনও কাজের কথা নয়। না আঁচালে এই সরকারের কোনও কিছুতেই বিশ্বাস নেই। কারণ, কথার খেলাপে মোদি সরকার ইতিমধ্যেই একগুচ্ছ বিশ্ব রেকর্ডের অধিকারী!
২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচন দেখিয়ে দিয়েছিল, মোদি বাজিমাত করলেন যে ইস্যুতে সেটা আর কিছু নয়, বেকারত্ব।

আরও পড়ুন-হিউম পাইপে হচ্ছে দুধিয়া সেতু, বাড়ি তৈরি করছে রাজ্য, যুদ্ধকালীন তৎপরতায় চলছে উত্তরবঙ্গের পুনর্গঠনের কাজ

মোদি দাবি করেন, তিনি সরকার গড়তে পারলে বছরে দু-কোটি চাকরি দেবেন! দেশবাসী তাঁর এই প্রচার সরল মনে বিশ্বাস করেছিল এবং তাঁকে আশীর্বাদও করেছিল দু-হাত তুলে। কেবল কথা রাখেননি মোদি, দেশের প্রধানমন্ত্রী। শুধু প্রথম দফায় নয়, পরবর্তী দু-দফাতেও তাঁকে অন্য ভূমিকায় না পেয়ে দেশবাসী, বেকার শ্রেণি যারপরনাই হতাশ। বছরে দু-কোটি চাকরির গালভরা আশ্বাস মিলিয়ে গিয়েছে হাওয়ায়। খোদ কেন্দ্রীয় সরকারি পরিসংখ্যানেই প্রকাশ, দু-বছরের ব্যবধানে সারা দেশে সামগ্রিকভাবে প্রায় ৯ লক্ষ ইপিএফ গ্রাহক বা শ্রমিক/কর্মচারী কমে গিয়েছে। সার্বিকভাবে ইপিএফ গ্রাহকের সংখ্যা কমে যাওয়ার সহজ হিসেবই হল, বেসরকারি সংস্থা/প্রতিষ্ঠানগুলিতে ক্রমশ কাজের সুযোগ হারাচ্ছেন শ্রমিক/কর্মচারীরা। একইসঙ্গে ইপিএফের মতো সামাজিক সুরক্ষা পরিষেবার আওতা থেকে বেরিয়ে যাওয়া সদস্যের সংখ্যাও ওই তিন বছরে ক্রমেই বেড়েছে। ২০২২-’২৩ সালে ১ কোটি ৩৩ লক্ষ, ২০২৩-’২৪ সালে ১ কোটি ৪৯ লক্ষ এবং ২০২৪-’২৫ সালে ১ কোটি ৮৩ লক্ষ সদস্য ইপিএফও ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছেন। তবে তাঁরা চাকরি খুইয়ে বেরিয়েছেন, নাকি স্বেচ্ছায় ইপিএফও ছেড়ে দিয়েছেন— রিপোর্ট থেকে তা পরিষ্কার নয়।
সব মিলিয়ে এটাই সারসত্য মোদিযুগে বেকারত্ব দূরীকরণদর্শনের যে শুধুই প্রচার এবং ভোটযন্ত্রে ডিভিডেন্ড তোলাই যখন শাসক দলের এক ও একমাত্র লক্ষ্য হয়, তখন সেই সংকীর্ণ রাজনীতি চরম ব্যর্থতার অধিক কিছু প্রসব করে না।
জলে মাছ ধরার গেরুয়া মতলবে যদি কেন্দ্রের মোদি সরকার উত্তরবঙ্গ পুনর্গঠনের থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকে, তবে রাজ্যবাসী তো ভুগবেই, বিজেপিকেও ফল ভুগতে হবে আগামী বিধানসভা নির্বাচনে।

Latest article