প্রতিবেদন : মহালয়ার সঙ্গে দেবী দুর্গার বন্দনার কোনও যোগসূত্রই নেই। ‘মহালয়া’ অর্থ আলাদা, তার অনুষঙ্গ আলাদা। মাতৃ আরাধনার কোনও যোগ নেই।কবে, কী ভাবে, কেন এই দুই বিষয় সংযুক্ত হল, তা বলা খুব কঠিন। আমরাই মহালয়া এবং দুর্গাপুজোকে একই উৎসবে যুক্ত করেছি। গবেষক বা পণ্ডিতেরা কেউ কেউ বলছেন ‘মহালয়া’ বিষয়টি মহা-আলয় বা পিতৃপুরুষের বাসভূমি থেকে এসেছে। যেমন, দেবলোকে দেবতাদের বাস তেমনই পিতৃলোকে পিতৃপুরুষেরা বাস করেন। অমাবস্যায় তাঁদের জল দান করা কর্তব্য। তাই মহালয়ার দিনটি পিতৃ উপাসনার দিন রূপে চিহ্নিত হয়েছে। ধারণা করা হয়, পিতৃ উপাসনার মধ্যেই তৈরি হয় ধর্ম ভাবনা। আর সেই ধর্ম ভাবনা পূর্ণতা পায় মাতৃ আরাধনায়। মহালয়ার সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে প্রয়াত পিতৃপুরুষের। জল ও পিণ্ড তর্পণের মাধ্যমে তাদের অতৃপ্ত আত্মাকে তুষ্ট করার প্রচেষ্টা চলে ওইদিন৷ হিন্দুধর্মের বিশ্বাস অনুযায়ী মৃত্যুর পর বিদেহী আত্মারা এই সময় মর্তে আসেন জল ও খাদ্য গ্রহণ করতে।
আরও পড়ুন-ঢাকি, ধুনুচিতে পুজোর আবহ নবান্ন সভাঘরে
পাশাপাশি আছে মহাভারতের যোগ। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে মারা যাওয়ার পর কর্ণ স্বর্গে গেলে তাঁকে সেখানে খাদ্য-পানীয়ের পরিবর্তে শুধুই সোনা রুপোর মতো ধাতু খেতে দেওয়া হয়। কর্ণ প্রশ্ন তোলেন তাঁর খাবারের এমন বিচিত্র ধরন নিয়ে? উত্তরে জানানো হয়, তিনি আজীবন শুধু শক্তির আরাধনা করেছেন, সোনাদানা বিতরণ করেছেন, কিন্তু কখনও নিজের পূর্বপুরুষের কথা স্মরণ করেননি, প্রয়াত পূর্বপুরুষদের আত্মাকে খাদ্য-পানীয় দেননি। তাই পুণ্যফলে তিনি স্বর্গে আসতে পারলেও খাদ্য-পানীয় পাওয়ার যোগ্য বলে বিবেচিত হননি। কর্ণ বলেন, এতে আমার অপরাধ কোথায়? আমি তো মৃত্যুর মাত্র একদিন আগে জেনেছি আমার পূর্বপুরুষদের পরিচয়। আমি তো জানতামই না কাদের খাদ্য বা জল দেব? যমরাজ বোঝেন কর্ণ নির্দোষ। তিনি তখন কর্ণকে বিদেহী পিতৃকুলকে জল ও পিণ্ডদানের জন্য এক পক্ষকাল মর্তে ফিরে যাওয়ার অনুমতি দেন কর্ণকে। যমের (অন্য মতে ইন্দ্রের) নির্দেশে ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপ্রতিপদ তিথিতে কর্ণ আবার মর্ত্যে ফিরে আসেন৷
আরও পড়ুন-গোয়া তৃণমূল কংগ্রেসে যোগদান প্রাক্তন ফুটবলার-বক্সারের
এক পক্ষকাল মর্ত্যে থেকে পিতৃপুরুষকে তিল-জল দান করে পাপস্খলন করেন। আশ্বিনের অমাবস্যা তিথিতে শেষ জলদান করে কর্ণ স্বর্গে ফিরে যান। এই বিশেষ পক্ষকাল সময়কে শাস্ত্রে পিতৃপক্ষ বলা হয়েছে। পিতৃপক্ষের শেষ দিন হল মহালয়া। সেদিন থেকেই নাকি শুরু হয় পিতৃপক্ষ তর্পণের প্রথা। পুরাণের এই ব্যাখ্যাই বলছে, মহালয়ার সঙ্গে আপাতদৃষ্টিতে দুর্গাপুজোর কোনও যোগই নেই। ওদিকে, এই দিনে প্রতিমার চোখ আঁকার রেওয়াজ আছে, যদিও এর পিছনেও নির্দিষ্ট কোনও নিয়ম নেই। এই দিনটি আসলে পিতৃপক্ষের অবসানকে চিহ্নিত করে। তারপরেই শুরু হয় বাঙালির সবচেয়ে প্রতীক্ষিত উৎসব৷ মহালয়া শব্দের অর্থ ‘মহান আলয়’ বা মহান আশ্রয়। মহালয়ার অর্থ হিসেবে পিতৃলোককেও বোঝায়। ওই পিতৃলোকে এই জগতের স্বর্গত পিতৃপুরুষরা থাকেন বলে বিশ্বাস। পিতৃলোককে সশ্রদ্ধ স্মরণ করার অনুষ্ঠানই ‘মহালয়া’ নামে পরিচিত। পিতৃপক্ষের শেষ হওয়ার পর, আশ্বিনের কৃষ্ণপক্ষের শেষ ও দেবীপক্ষের শুরুতে যে অমাবস্যা আসে, সেই লগ্নকেই মহালয়া বলে। মহালয়া ‘স্ত্রীকারান্ত’।
আরও পড়ুন-চিকিৎসক হয়ে সমাজসেবাই লক্ষ্য
ত্রিভুবনে দেবী দুর্গাই হলেন মহান আশ্রয়। তাঁর আগমনের লগ্নই ‘মহালয়া’৷ আবার কেউ বলেন ‘পিতৃলোক’ হল সেই মহান স্থান। মহালয়া হল পিতৃপূজা ও মাতৃপূজার সন্ধিক্ষণ। মহালয়ার দিন একসাথে পিতৃপূজা ও মাতৃপূজা দুই’ই করা যায়৷ মানব জীবনে, মননে এই দিনটি এক বিশেষ গুরুত্ব বহন করে আনে। যুগ যুগ ধরেই মহালয়ার প্রভাতে পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে তিন গন্ডুষ জলের অঞ্জলি দিয়ে আসছেন সনাতন ধর্মাবলম্বীরা। বলছেন, ‘ময়া দত্তেন তোয়েন তৃপ্যন্ত ভুবন এয়ম, আব্রহ্ম স্তম্ভ পর্যন্তং তৃপ্যন্ত’ মন্ত্র। যার মধ্যে দিয়ে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে চলেছেন বিদেহী পিতৃপুরুষ এবং পূর্বপুরুষদের। হিন্দু পুরাণ মতে, এই সময় পিতৃপুরুষের আত্মার স্বর্গ-প্রাপ্তির জন্য পুত্র যে শ্রাদ্ধক্রিয়া করে, তাকে বলা হয় ‘তর্পণ’। গঙ্গায় বা নদীতে পিতৃপুরুষদের উদ্দ্যেশ্যে পিণ্ডদানও করা হয়৷ এই পিণ্ডদান আসলে পিতৃপুরুষদের জল ও খাদ্য প্রদানের এক ধরনের চেষ্টা৷ মহালয়া ভারতীয় সংস্কৃতির ধারক এবং বাহক। হিন্দুধর্মে মহালয়া এবং তর্পনের গুরুত্ব আজও অমলিন, অক্ষত যা ভাবীকালেও অক্ষুণ্ণ থাকবে বলেই মনে হয়।