নয়া জাতীয় শিক্ষানীতি মানার কোনও প্রশ্নই নেই

আইজ্যাক আসিমোভ তো সেই কবেই বলে গিয়েছেন, যখন মূর্খামি দেশপ্রেম বলে বিবেচিত হয়, তখন বুদ্ধিমান হওয়াটা মোটেই নিরাপদ নয়। জাতীয় শিক্ষানীতি, আর যাই হোক, দেশের যুবসমাজকে বুদ্ধিমান করে তুলতে চায় না, এটা পরিষ্কার। লিখছেন দেবু পণ্ডিত

Must read

কেন্দ্রের নয়া শিক্ষানীতি (National Education Policy) নিয়ে রাজ্যের অবস্থানকেই তুলে ধরল দেশের শীর্ষ আদালত। আবারও জাতীয় শিক্ষানীতি নিয়ে রাজ্য সরকারের অবস্থানকেই মান্যতা দিলেন তাঁরা। দেশের বৈচিত্রের কথা মাথায় রেখে শিক্ষানীতি নিয়ে কেন্দ্র একটি বিশদ রূপরেখা স্থির করতে পারলেও বিভিন্ন রাজ্য সরকারই তাদের মতো করে সেই শিক্ষানীতির বাস্তবায়ন করতে পারবে, জানিয়ে দিয়েছে বিচারপতি জে বি পারদিওয়ালা ও বিচারপতি মহাদেবনের বেঞ্চ। পশ্চিমবঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর উদ্যোগেই কেন্দ্রের শিক্ষানীতির মূল কাঠামোকে অক্ষুণ্ণ রেখে রাজ্যের জন্য পৃথক শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের এই রায়ে তাই অবাক হওয়ার কিছু নেই।
এই সংক্রান্ত বিতর্কের উৎসে ভাষাগত বিতর্ক বর্তমান। নয়া শিক্ষানীতি (National Education Policy) অনুসারে, প্রথম ভাষা হিসেবে প্রতিটি রাজ্যে স্কুল পড়ুয়াদের বাধ্যতামূলকভাবে মাতৃভাষা শিখতে হবে। দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে তাদের বেছে নিতে হবে হিন্দি অথবা ইংরেজি। এছাড়া তৃতীয় একটি ভাষাকে বাছবে সংশ্লিষ্ট রাজ্য। এই ভাষানীতির আলখাল্লা পরে আসলে কেন্দ্র অহিন্দিভাষী রাজ্যগুলোর ওপর জোর করে হিন্দি ভাষা চাপিয়ে দিতে চাইছে। এই বক্তব্য তামিলনাড়ু, কেরল, পশ্চিমবঙ্গের মতো সেইসব রাজ্যগুলির, যেখানে হিন্দি প্রধান ভাষা নয় এবং বিজেপি শাসন ক্ষমতায় নেই।
সংশ্লিষ্ট মামলায় রায়দানকালে শীর্ষ আদালত সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে, তারা সংবিধানের ৩২ নং ধারা অনুসারে এ-ব্যাপারে নির্দেশিকা জারি করতে পারে যাতে নাগরিকদের অধিকার রক্ষিত হয়, কিন্তু কোনওমতেই কোনও রাজ্যকে জাতীয় শিক্ষা নীতির ভাষানীতি গ্রহণে বাধ্য করতে পারে না। এর আগে জাতীয় শিক্ষানীতি পর্যালোচনা করার জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকার একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করেছিল। সেই কমিটি স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয়, রাজ্য জুড়ে সকল পড়ুয়াকে তাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থান নিরপেক্ষভাবে একটিমাত্র শিক্ষা ব্যবস্থা অনুসরণ করতে বাধ্য করানোর প্রয়াস মোটেই বাস্তবসম্মত নয়। একটি রাজ্যে যেটা গ্রহণযোগ্য নয় সেটি ১৩০ কোটি জনসংখ্যার দেশে গ্রহণযোগ্য হবে কোন যুক্তিতে?
এছাড়া বিদ্যালয় শুধু দশম ও দ্বাদশে চূড়ান্ত পরীক্ষা নেওয়ার ব্যবস্থা সরিয়ে জাতীয় শিক্ষানীতি তৃতীয়, পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণিতেও বোর্ড পরীক্ষা নেওয়ার প্রস্তাব রেখেছে। বলেছে, সাধারণ পাঠ্যক্রমের সঙ্গে বৃত্তিমূলক শিক্ষার পাঠ্যক্রমের যে পার্থক্য রয়েছে, সেটা মুছে ফেলার প্রস্তাবও। এসব শুনতে ভাল। কিন্তু বাস্তবায়িত করার পরিকাঠামো রাজ্যে রাজ্যে নেই, এটা প্রায় সর্বজ্ঞাত সত্য। সে কারণেও জাতীয় শিক্ষানীতি সর্বজন গ্রাহ্য হতে পারে না।
জাতীয় শিক্ষানীতি গ্রহণযোগ্য কেন? এই প্রশ্ন তুললেই গেরুয়া শিবির থেকে বাঁধা গতে একটাই কথা শোনা যায়। এই নীতি শিক্ষাক্ষেত্রে ‘নবজাগরণ’ সূচিত করবে। কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে অটল টিংকারিং ল্যাবের কথা, উচ্চ প্রাথমিক স্তর থেকে কোডিং শেখানোর কথা, শিক্ষক হিসেবে তফসিলি জাতি/ উপজাতি প্রার্থীদের নিয়োগের বিষয় ইত্যাদি।
কিন্তু এত ঢক্কনিনাদে চাপা পড়ে যাচ্ছে একটা প্রাথমিক চাহিদার প্রসঙ্গ। স্নাতক যুব সমাজ দেশের উৎপাদন প্রক্রিয়ায় শামিল হতে পারবে কি না, দেশশের কর্মশক্তির অঙ্গীভূত হতে পারবে কি না, সোজা কথায় তাদের বেকারত্ব ঘুচবে কি না, সে বিষয়ে কোনও সুনির্দিষ্ট দিশা এই নব প্রবর্তিত শিক্ষানীতিতে অমিল। বিবেকানন্দ বলতেন, শিক্ষার উদ্দেশ্য হল শিক্ষার্থীকে নিজের পায়ে দাঁড় করানো। আর ১৯৪৮-এর রাধাকৃষ্ণণ কমিশন, ১৯৬৬-র কোঠারি কমিশন, ১৯৮৫-র অফিসার্স কমিশন, এগুলোর সবক’টাই সে দিকে নজর না-দিয়ে কেবল সমতা, সমানাধিকার, এসব নিয়েই মাথা ঘামিয়েছে। নয়া জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০-ও বা ব্যতিক্রমী হতে পারল কই? ডিগ্রির শংসাপত্র নিছক কাগজ না হয়ে জীবন তৈরির ছাড়পত্র যে হবে, সে-ব্যবস্থা এই শিক্ষানীতিতে কোথায়? ‘নবজাগরণ’-এর আবাহনকারী হিসেবে এই শিক্ষানীতি মান্যতা পাবে কোন যুক্তিতে?
যথোপযুক্ত শিক্ষা মানে শিক্ষায় যেমন গভীরতা থাকবে, তেমনই সেটার দিগন্ত হবে প্রসারিত। গভীরতা মানে, শিল্পের চাহিদা অনুযায়ী প্রযুক্তি গত সক্ষমতা অর্জন। প্রসারতা মানে কৃত্রিমম বুদ্ধিমত্তার মতো নিত্যনতুন বিষয়ের আগমনের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা সব মিলিয়ে উপযুক্ত শিক্ষা শিক্ষার্থীদের কাজের বাজারে বাতিল হয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা পাওয়ার বর্মবিশেষ। কিংবা, অন্য কথায়, কাজের বাজারের বাস্তুতন্ত্রে প্রাসঙ্গিক থাকার রক্ষাকবচ।

আরও পড়ুন-কপোতাক্ষের জল আটকে বাংলাদেশকে উচিত শিক্ষা

চার বছর হয়ে গেল জাতীয় শিক্ষানীতির বয়স। কিন্তু ২০২০-র শিক্ষানীতি যে সর্বজনগ্রাহ্য হয়ে উঠেছে তেমন কোনও লক্ষণ দেখা গেল কই? অন্তত পরিসংখ্যানগতভাবে?
২০২৫-এ দেশের স্নাতকদের মধ্যে ৪২.৬ শতাংশ কর্মশক্তিতে শামিল হতে সক্ষম। ২০২৩-এও তো সংখ্যাটা প্রায় একই ছিল, ৪৪.৩ শতাংশ। জাতীয় শিক্ষানীতিতে প্রস্তাবিত বিষয়গুলি যদি সর্বত্র কার্যকর হত, তাহলে ছবিটা এরকম থমকে থাকত না। জাতীয় শিক্ষানীতির অন্যতম বিশেষত্ব প্রবেশও বহির্গমনের বহু বিকল্প। কিন্তু কম বেতনের ই-কমার্স চাকরির বাইরে আর কোনও চাকরির পথ এই ব্যবস্থা এখনও খুলতে পেরেছে বা ভবিষ্যতেও পারবে বলে মনে হয় না। যে হাবে দেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বাড়ছে তাতে মনে হচ্ছে, এদেশে শিক্ষানীতি ছাত্র সমাজের ক্ষমতায়নের পরিবর্তে তাদের ক্ষমতা হ্রাসের পথে হাঁটছে। বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে আমেরিকায় চালু হয় ভ্যানেভার বুশ মডেল। এই মডেল মানেনি নয়া জাতীয় শিক্ষানীতি। অর্থনীতিক বাস্তুতন্ত্রে এই শিক্ষানীতির কার্যকারিতা আদৌ প্রশ্নাতীত নয়। পাঠ্যক্রমের গৈরিকীকরণ কাজের কথা বলে না, রুজি রোজগারের কথা বলে না। আধুনিক কাজের বাজারের বা শিল্পমহলের চাহিদা মেটাতে পারে এরকম যুবশক্তি গঠনের কথা বলে না।
নুনজিও কোয়াকোয়ারেল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের মান নির্ণায়ক স্থানাঙ্ক নির্ধারণ কার্যক্রমম চালু করেছেন। তদনুসারে, ভারতের ১১টি বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বের প্রথম ৫০০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের পর্যায়ে পড়ে। কোয়াকোয়ারেল্লি বলেছেন, ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলির গুণমানে ইদানীং অন্তত ৩১৮ শতাংশ উন্নতি হয়েছে। গবেষণাপত্র প্রকাশের ক্ষেত্রে ২০০৮-২০১৯ সময়সীমায় ভারতের গুণমান ছিল জি-২০-র ১৯টি দেশের মধ্যে ১৭তম স্থান। গত ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫-এ ভারত সরকার সগর্বে জানিয়েছে, ভারত এখন ১৬তম স্থানে উন্নীত হয়েছে। এসবই প্রচারিত হচ্ছে নয়া শিক্ষানীতির সাফল্য নিয়ে সরকারি আত্মপ্রচারের তাগিদে। কিন্তু যেটা অনুল্লেখিত থাকছে, সেটা হল এই কোয়াকোয়ারেল্লি স্থানাঙ্কের কোনও গ্রহণযোগ্যতা শিল্প মহলে নেই।
ঢাক-ঢোল পিটিয়ে কত প্রকল্পই তো ঘোষিত হয়েছে অতীতে। নিউ মিলিয়েনিয়াম প্রোজেক্ট, ১০ ডলার আকাশ ট্যাবলেট প্রোজেক্ট, ইমপ্রিন্ট, অর্থাৎ ইমপ্যাক্টিং রিসার্চ ইনোভেশন অ্যান্ড টেকনোলজি প্রোজেক্ট ইত্যাদি ইত্যাদি। কয়েক বছর সেগুলি নিয়ে খুব হইচই হল। হাজার হাজার কোটি কোটি টাকা, করদাতাদের অর্থ, তাতে খরচ হল। কিন্তু সে-সব প্রকল্পের এখন কী অবস্থা, সে খবর আমরা কেউ জানি না। কেউ জানানোর দরকারও বোধ করে না।
আশঙ্কা হয়, কয়েক বছর পর জাতীয় শিক্ষা নীতি ২০২০-রও এই অবস্থাই হবে। গোটা শিক্ষা ব্যবস্থাটাই এমন হয়ে দাঁড়াচ্ছে, যেখানে কেন্দ্রীয় সরকার একটা নীতি খাড়া করে দেবে আর সেটাকে প্রচার যন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করবেন গৈরিক পরিমণ্ডল, স্কুল-কলেজের শিক্ষকরা। আর সরকারি চাকুরে নন যেসব শিক্ষাবিদ, চিন্তাবিদ, তাঁরা খবরের কাগজে লেখালেখি করেই ক্ষান্ত হবেন। তাঁদের আর কিচ্ছুটি করার নেই। কেউ তাঁদের কথায় কানও দেবে না। জাতীয় শিক্ষানীতি এরকম একটা আবহই গড়ে তুলতে চায়। তাই রাজ্যে রাজ্যে তাকে বর্জন করার ডাক উঠেছে। স্রেফ দেশপ্রেমের নাম করে সেই নীতি চালু করা হচ্ছে কেন্দ্রীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে অথচ সেসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষাপ্রাপ্ত যুবক-যুবতীদের চাকরির বাজারে কী হাল হবে, তা নিয়ে কেউ ভাবছেই না। ভাগ্যের হাতে তাদের ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে।
আইজ্যাক আসিমোভ তো সেই কবেই বলে গিয়েছেন, যখন মূর্খামি দেশপ্রেম বলে বিবেচিত হয়, তখন বুদ্ধিমান হওয়াটা মোটেই নিরাপদ নয়। জাতীয় শিক্ষানীতি (National Education Policy), আর যাই হোক, দেশের যুবসমাজকে বুদ্ধিমান করে তুলতে চায় না, এটা পরিষ্কার।

Latest article