সদ্য শেষ হয়েছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির তিন দিনের মার্কিন মুলুকে রাষ্ট্রীয় সফর। ২০১৪ সালে কেন্দ্রে ‘আব-কি-বার, মোদি সরকার’ গঠনের পর নরেন্দ্র মোদি দেশে কিংবা বিদেশে কখনও সাংবাদিক সম্মেলন করেননি। কিন্তু এই প্রথম নরেন্দ্র মোদিকে মার্কিন রাষ্ট্রপতি জো বাইডেনের সঙ্গে যৌথ সাংবাদিক সম্মেলনে হাজির হতে হয়। সেই সম্মেলনে ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের সাংবাদিক সাব্রিনা সিদ্দিকির ভারতের সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্নের উত্তরে মোদি বলেন, ‘‘ভারতে বৈষম্যের কোনও জায়গা নেই।’’ প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘‘যেখানে মানবাধিকার নেই, সেখানে গণতন্ত্র নেই।’’ দেশে এবং বিদেশে ভারতে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিয়ে যখন প্রশ্ন উঠছে তখন প্রধানমন্ত্রী বলছেন যে, ‘‘ভারত এবং আমেরিকার ডিএনএতে গণতন্ত্র রয়েছে। আমাদের সরকার সংবিধান মেনে চলে তাই কোনও ঘৃণা বা জাত-ধর্মের ভিত্তিতে ভেদাভেদ নেই।’’ যদিও মোদির (Modi Government) এই সফর চলাকালীন প্রাক্তন মার্কিন রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামা একটি সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘‘ভারতে মুসলিমদের নিরাপত্তা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।’’ কেবল ওবামা নন মার্কিন কংগ্রেসের উচ্চকক্ষের সদস্য সেনেটর বার্নি সান্ডার সংবাদমাধ্যমের অধিকারের ওপর সরকারের হস্তক্ষেপ এবং অনৈতিকভাবে সামাজিক আন্দোলনের কর্মীদের জেলে আটকে রাখা নিয়ে মোদি সরকারকে নিশানা করেছেন। তিনি সংবাদমাধ্যমে বলেছেন, ‘‘উগ্র হিন্দুত্ব জাতীয়তাবাদের ধারণা প্রচার করা হচ্ছে, যেখানে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের কম গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।’’ আর তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হল, মার্কিন কংগ্রেসের যৌথ অধিবেশনে নরেন্দ্র মোদির বক্তৃতা বয়কট করেছেন কংগ্রেসের দুই সদস্য ইলহান ওমার এবং রশিদা তালেব। তাঁদের অভিযোগ, মোদি জমানায় ভারতের মাটিতে সংখ্যালঘুরা আক্রান্ত। এই সরকারের আমলে মানবাধিকার খর্ব হয়েছে। এ ছাড়া সামার লি, জামাল বাওম্যান, কোরি বুশ, আলেকজান্দ্রিয়া ওকাসিও কর্টেজের মতো মার্কিন কংগ্রেসের সদস্যরা মোদির বক্তৃতা বয়কট করেছেন।
বস্তুত ২০১৪ সালে কেন্দ্রে মোদি সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে কখনও লাভ জিহাদ বা কখনও ফ্রিজে গরুমাংস রাখার কারণে পিটিয়ে মারার অভিযোগ উঠেছে বিজেপি এবং আরএসএসের বিভিন্ন শাখা সংগঠনের পক্ষ থেকে। উল্লেখ্য, ভারতে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার বিষয় নিয়ে বিভিন্ন সংস্থার রিপোর্টেও উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। এই উদ্বেগের কথা মোদি-সরকার নাকচ করলেও বিগত নয় বছরে গোরক্ষকদের গণপিটুনিতে একের-পর-এক সংখ্যালঘু মুসলিম নাগরিকের মৃত্যু হয়েছে। সংখ্যালঘু মুসলিমদের বলপূর্বক ‘জয় শ্রীরাম’ মন্ত্র উচ্চারণে বাধ্য করার ঘটনাও ঘটেছে। আখলাক, পেহলু খান, জুনাইদ, আফ্রাজুল, তবরেজ আনসারিদের দুর্ভাগ্যজনক মৃত্যু সংখ্যালঘুর প্রতি ঘৃণা ও বিদ্বেষের জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা বাতিলের পর রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে সেখানকার অবাধ গ্রেপ্তারি, নাগরিকদের মৌলিক অধিকারের উপর সার্বিক অবরুদ্ধতা মানবাধিকারকে ক্ষুণ্ন করেছে— এমন অভিযোগ দেশে-বিদেশে উঠেছে। কথায় কথায় প্রধানমন্ত্রী ‘সব কা সাথ, সব কা বিকাশ’-এর সাথে জুড়ে দেন ‘সব কা বিশ্বাস’-এর স্লোগান। কিন্তু এই গালভরা স্লোগানের বাস্তব প্রয়োগ কার্যত অধরা। চলতি লোকসভায় সংখ্যালঘু মুসলিম সাংসদের সংখ্যা গতবারের তুলনায় ২২ থেকে বেড়ে ২৭ হলেও শতকরা হার ৫ শতাংশের নিচে। অথচ ২০১১ সালের সেন্সাস অনুযায়ী দেশে সংখ্যালঘু মুসলিমের সংখ্যা ১৪.২ ভাগ। অর্থাৎ মুসলিম সাংসদের সংখ্যা আনুপাতিক হারে ৭০ জন হওয়ার কথা। কিন্তু এ-যাবৎ ২০০৪ সালের সর্বোচ্চ ৩৪ জন মুসলিম সাংসদ লোকসভায় নির্বাচিত হয়েছিল। মুসলিম প্রতিনিধিত্ব বৃদ্ধির ভাবনা কাউকেই করতে দেখা যায় না। আরও মজার কথা, ২০১৪ সালে এবং ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি যথাক্রমে ২৮২ এবং ৩০৩ আসন জিতলেও তাতে একজনও মুসলিম সদস্য নেই। প্রথম মোদি-মন্ত্রিসভায় রাজ্যসভার দুই বিজেপি সাংসদ মুখতার আব্বাস নাকভি এবং এম জে আকবর স্থান পেলেও মি টু আন্দোলনের প্রতিক্রিয়ায় এম জে আকবর মন্ত্রিপদ হারান। বর্তমানে মোদি-মন্ত্রিসভা মুসলিম সদস্য বর্জিত। শুধু তাই নয়, বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলিতে বিশেষত উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, গুজরাট, হরিয়ানা, মহারাষ্ট্র, উত্তরাখণ্ড প্রভৃতি রাজ্যগুলির বিধানসভা নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়নে বিজেপি মুসলিমদের কার্যত ব্রাত্য রেখে দিয়েছে। ফলে এই রাজ্যগুলির নির্বাচিত বিধায়কদের মধ্যে মুসলিম প্রতিনিধিত্বের সংখ্যা ক্রমশ কমেছে। অর্থাৎ বিজেপির সাংসদ কিংবা বিধায়ক সংখ্যা বৃদ্ধি আর মুসলিম বিধায়ক সংখ্যার হ্রাস সমার্থক হয়ে উঠেছে। কেবল বিজেপি-শাসিত রাজ্যই নয়, আমাদের পশ্চিমবঙ্গেও বিগত বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির মুসলিম প্রার্থী সংখ্যা খুবই নগণ্য ছিল। ফলে বিজেপির জয়ী ৭৭ জন বিধায়ক তালিকায় মুসলিম নাম নেই। সেই সঙ্গে বিজেপির বিধায়ক সংখ্যা এই রাজ্যে বৃদ্ধির ফলে আগের তুলনায় মুসলিম বিধায়ক সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে।
অথচ সংসদীয় গণতন্ত্রে সমাজের প্রত্যেক অংশের উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব ছাড়া দেশের সার্বিক বিকাশ সম্ভব নয়। ইংল্যান্ডের চার্টিস্ট আন্দোলন কিংবা আমেরিকার স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম দাবিই ছিল ‘No taxation without representaion’। তাই প্রশ্ন জাগে, মুসলিমদের কোন বিশ্বাস অর্জনের কথা বলছেন নরেন্দ্র মোদি! ইতিমধ্যে আমেরিকা মোদি জমানায় ভারতের ধর্ম নিরপেক্ষতায় ফাটলের ইঙ্গিত সমীক্ষার মাধ্যমে তুলে ধরেছে। গণতন্ত্রের পবিত্র প্রতিষ্ঠান সংসদে দাঁড়িয়ে লোকসভার সদস্যরা নজিরবিহীন ভাবে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে যেভাবে ‘জয় শ্রীরাম’ আর ‘আল্লাহ আকবর’ ধ্বনিতে মুখরিত হল, তা দেশের ধর্মনিরপেক্ষতায় বিরাট আঘাত বলে অনেকেই মানছেন। এই প্রবণতা বলে দিচ্ছে ভারতের চিরাচরিত ধর্মনিরপেক্ষতা আজ চরম বিপদের মুখে দাঁড়িয়ে। লঙ্ঘিত হচ্ছে সংবিধানে বর্ণিত নাগরিকদের মৌলিক অধিকার।
আরও পড়ুন- বিশ্বভারতীকে কেন্দ্র করে বাংলার হেনস্তা চাইছে বিজেপি, বললেন জহর
মোদ্দা কথা হল, মোদির (Modi Government) শাসনে হিন্দু সংখ্যাগুরুর কর্তৃত্ববাদের নিকট ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বলপূর্বক আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করা হচ্ছে। আসলে রাষ্ট্রীয় জাতীয়তাবাদকে ধর্মীয় এবং অনেকক্ষেত্রে ভাষিক সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে স্থান দিতে না পারার অক্ষমতা থেকেই সম্প্রদায়গত বিভাজনের ফাটল বড় হয়ে দেখা দিচ্ছে। বহু ভাষা-ধর্ম ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যময়তার মৌলিক চরিত্রকে অস্বীকার করে কেবলই ‘হিন্দু’ শব্দ দিয়ে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের সামগ্রিকতার বহিঃপ্রকাশ যে অসম্ভব— এই চরম আপ্তবাক্যটি বুঝতে না পারা বা না বোঝার ভান করার মধ্যেই আজকের বিরাজমান সাম্প্রদায়িক হানাহানির বীজ খুঁজতে হবে। এই ধরুন, সম্প্রতি দেশের বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার (Modi Government) তিন তালাক বিলকে কেন্দ্র করে মুসলিম নারীদের মুক্তির কথা বলে ‘নারীমুক্তির ত্রাতা’ হয়ে ওঠার চেষ্টা করলেও সমকামিতা, পরকীয়া কিংবা শবরীমালা মন্দিরে নারী প্রবেশে শাসকদলের ভূমিকা প্রগতিশীল থাকেনি। শবরীমালা নিয়ে গৈরিকদলের ভূমিকা প্রতিক্রিয়াশীল বলেই গণ্য হয়েছে। আবার সেই দলই যখন তিন তালাক আইনে মুসলিম নারীর মুক্তি খোঁজে তখন কোথাও না কোথাও তাদের কপটতার মুখোশ বেরিয়ে পড়ে। তিন তালাককে কেন্দ্র করে নারীর মুক্তি আর ক্ষমতায়ন নিয়ে কেন্দ্রের ছাপান্ন ইঞ্চির সরকার ইতিবাচক মনোভাব দেখালেও মহিলা সংরক্ষণ বিল নিয়ে এই সরকারের উদ্যোগ ও সদিচ্ছার অভাব দিনের আলোর মতো প্রকাশিত হয়েছে। দেশে অভিন্ন দেওয়ানি বিধির অজুহাতে তিন তালাকে অভিযুক্ত স্বামীর ফৌজদারি দণ্ডবিধানে তিন বছরের জেলের বিধান সাম্যর নীতিকে লঙ্ঘন করছে। ধর্মাচরণের সাংবিধানিক অধিকার ভঙ্গের কথা মাথায় রেখেই তাই বলা যায়, তিন তালাক নিয়ে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের নির্দিষ্ট রায় থাকা সত্ত্বেও কেন্দ্র সরকারের (Modi Government) এই বাড়তি উৎসাহের মূলে যে রাজনৈতিক অভিসন্ধি লুকিয়ে থাকতে পারে, সে-আশঙ্কা অনেকেই করছেন।