থাইরয়েড

ছোট্ট গ্রন্থি। কিন্তু তার অসীম ক্ষমতা! এই গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত হরমোন কম বা বেশি হলেই বিপদ। থাইরয়েড। খুব চেনাশোনা একটা রোগ হলেও সাধারণ নয়। এই রোগ আপনার দিনযাপন, সৌন্দর্য, মন, মানসিকতা সব সমীকরণ গুলিয়ে দিতে পারে। তাই বিশ্ব জুড়ে জানুয়ারিতে পালিত হয় থাইরয়েড সচেতনতা মাস। কেন হয় থাইরয়েড? চিকিৎসাই বা কী? লিখছেন শর্মিষ্ঠা ঘোষ চক্রবর্তী

Must read

গবেষণা অনুযায়ী ভারতে প্রায় ৫০ মিলিয়ন মানুষ থাইরয়েড রোগে ভুগছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ভারতে প্রতি ১০ হাজার শিশুর মধ্যে ৩৭ জনের থাইরয়েড রয়েছে। থাইরয়েড হল খুব কমন এক শারীরিক রোগ। এই রোগ মূলত মহিলাদের মধ্যেই বেশি দেখতে পাওয়া যায়। দিনে দিনে বাড়ছে থাইরয়েড রোগীর সংখ্যা। এই কারণে প্রতি বছর জানুয়ারিতে বিশ্ব জুড়ে পালিত হয় থাইরয়েড সচেতনতা মাস। এটি সর্বপ্রথম উদযাপন শুরু হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আমেরিকান থাইরয়েড অ্যাসোসিয়েশনের সহযোগিতায়। এর উদ্দেশ্য ছিল শরীরে থাইরয়েড রোগের প্রভাব এবং তাদের কারণে সৃষ্ট সমস্যা সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করা কারণ আমেরিকায় বহু মানুষ এই রোগে আক্রান্ত। পরবর্তীকালে এই দিনটি আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃতি লাভ করে। এর ফলে এখন অনেক দেশেই এই থাইরয়েড সচেতনতা মাস পালিত হয়। থাইরয়েডের জন্য সচেতন হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে কেন?

আরও পড়ুন-থাইরয়েড

থাইরয়েড কী
থাইরয়েড বা অন্তঃক্ষরা গ্রন্থি হল শরীরের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ যা বিপাক, বৃদ্ধি এবং বিকাশকে নিয়ন্ত্রণ করে। প্রজাপতি আকৃতির মতো দেখতে এই গ্রন্থি থাকে গলার শ্বাসনালির সামনে দুই পাশে। থাইরয়েড গ্রন্থির কাজ হল আমাদের শরীরের কিছু অত্যাবশ্যকীয় হরমোন উৎপাদন করা। যে হরমোন আমাদের তাপমাত্রা এবং হার্ট রেটকে নিয়ন্ত্রণ করে। এছাড়া বিপাক ক্রিয়া, বাচ্চাদের স্বাভাবিক বেড়ে ওঠা, বুদ্ধির বিকাশ, বয়ঃসন্ধির লক্ষণ, মহিলাদের ক্ষেত্রে ঋতুচক্র, গর্ভধারণ ইত্যাদি নির্ভর করে থাইরয়েড গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত হরমোনের উপর। থাইরয়েড হরমোন দু’প্রকার– টি-থ্রি বা ট্রাইয়োডোথাইরোনিন এবং টি-ফোর অর্থাৎ থাইরক্সিন।
শরীরের জন্যে থাইরয়েড হরমোনের একটি নির্দিষ্ট মাত্রা আছে। নির্দিষ্ট মাত্রার থেকে কম বা বেশি হরমোন উৎপাদিত হলেই শরীরের ওপর তার বিরূপ প্রভাব পড়তে শুরু করে। সেটাই হল থাইরয়েড ডিজঅর্ডার।
ধরন
দুই ধরনের থাইরয়েড রোগ রয়েছে—হাইপোথাইরয়েডিজম ও হাইপারথাইরয়েডিজম। প্রথমটার ক্ষেত্রে রক্তে থাইরয়েড নিঃসৃত হরমোনের পরিমাণ কমে যায় এবং দ্বিতীয় ক্ষেত্রে রক্তে থাইরয়েড নিঃসৃত হরমোনের পরিমাণ বেড়ে যায়। এই উভয় পরিস্থিতিতে রোগী বিভিন্ন ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে পারেন। থাইরয়েড ডিজঅর্ডারের কারণ সম্পর্কে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বংশগতি, শরীরে আয়োডিনের ঘাটতি, কিছু অটোইমিউন রোগ, ক্যানসার বা কোনও বিশেষ থেরাপি বা চিকিৎসার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও এর জন্য দায়ী হতে পারে। থাইরয়েড হলে শরীরে কিছু পরিবর্তন দেখা যায়। শরীরে এই ধরনের লক্ষণ থাকলে বুঝতে হবে থাইরয়েডের সমস্যা রয়েছে।
হাইপারথাইরয়েডিজম
এই ক্ষেত্রে রক্তে থাইরয়েড নিঃসৃত হরমোন বেড়ে যাওয়ার ফলে নানা উপসর্গ দেখা দেয়। যেমন, বুক ধড়ফড় করা, ওজন কমে যাওয়া, শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়া, একটা চোখের আকার বেড়ে যাওয়া, গরম সহ্য না হওয়া, ঋতুস্রাবের সমস্যা, এমনকী খুব বেশি পরিমাণে মানসিক সমস্যাও দেখা দিতে পারে।
হাইপোথাইরয়েডিজম
এই ক্ষেত্রে দুর্বলতা, ওজনবৃদ্ধি, বেশি ঠান্ডা লাগা, পেশি এবং অস্থিসন্ধিতে ব্যথা, চুল পড়ে যাওয়া, পা ও মুখ ফুলে যায়, গলার স্বর পাল্টে যাওয়া, ত্বক শুষ্ক হওয়া, মনে রাখার ক্ষমতা কমে যাওয়া, কিছু ভাল না লাগা, ভীষণ অবসাদ, বেশি দুশ্চিন্তা,অস্থিরতা, নখে ফাটল, কোষ্ঠকাঠিন্য, অনিয়মিত ও অতিরিক্ত ঋতুস্রাব ইত্যাদি দেখা যায়। গর্ভাবস্থায় এই রোগ থাকলে বাচ্চার নানা ধরনের সমস্যা হতে পারে। জন্মের পরেই কোনও শিশু এই রোগে আক্রান্ত হলে তার বুদ্ধির স্বাভাবিক বিকাশ, পড়াশোনা, বয়ঃসন্ধির সময়ে নানা সমস্যা হতে পারে।
কেন হয় থাইরয়েডজনিত সমস্যা
বিভিন্ন কারণে থাইরয়েডের সমস্যা দেখা দেয় যেমন হাইপোথাইরয়েডিজম হতে পারে খাবারে আয়োডিনের অভাব থেকে, কিছু অটো ইমিউন রোগ থেকে, থাইরয়েডের অপারেশন হলে, রেডিয়েশন থেরাপি নিলে, কিছু ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থেকে, জন্মগত ত্রুটি অর্থাৎ জন্ম থেকেই হয়তো থাইরয়েড গ্রন্থি তৈরি হয়নি, এছাড়া কিছু খাদ্যবস্তু যেগুলো খেলে থাইরয়েড হতে পারে।
হাইপারথাইরয়েডিজ়ম-এর কারণ কিছু অটো ইমিউন রোগ, থাইরয়েড হরমোন বেশি থাকলে, থাইরয়েড গ্রন্থিতে কোনও সংক্রমণ হলে, থাইরয়েড টিউমার হলে।

আরও পড়ুন-উধাও ঠান্ডা, ১২ বছরে উষ্ণতম পৌষসংক্রান্তি

পরীক্ষানিরীক্ষা
এফ টি ফোর বা টি ফোর এবং টিএসএইচ টেস্ট— এই দুটো টেস্ট-এ ধরা পড়ে থাইরয়েড। হাইপোথাইরয়েডে এফ টি ফোর বা টি ফোর কমে যায়, টিএসএইচ বেড়ে যায় এবং হাইপারথাইরয়েডে এফটি ফোর বা টি ফোর বেড়ে যায় টিএসএইচ কমে যায়। এছাড়া অ্যান্টি টিপিও অ্যান্টিবডি, থাইরয়েড স্টিমিউলেটিং, ইমিউনোগ্লোবিউলিন ইত্যাদি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা যেতে পারে।
হবু মায়ের শরীরে থাইরয়েড নিঃসৃত হরমোনের পরিমাণ স্বাভাবিক মাত্রায় থাকা জরুরি। তাই গর্ভবতী মহিলার থাইরয়েড পরীক্ষা করা দরকার। বিশেষ করে ভ্রূণের মস্তিষ্কের উন্নতির জন্য গর্ভবতী হওয়ার পরে শরীরে থাইরয়েড হরমোনের চাহিদা বেড়ে যায় এবং সেজন্য থাইরয়েড গ্রন্থি থেকে বেশি পরিমাণ টি-থ্রি, টি-ফোর নিঃসৃত হয়। এই অবস্থায় খাদ্যে আয়োডিনের পরিমাণ কম থাকলে শরীরে থাইরয়েড নিঃসৃত হরমোনের অভাব দেখা দেয়।
চিকিৎসা
একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ থাইরয়েড হরমোন ট্যাবলেট আকারে রোগীকে খেতে হয়। টিএসএইচ এবং টি-ফোর বা এফটি-ফোরের মাত্রা রক্তে কত তার ওপর থাইরয়েড হরমোনের ডোজ নির্ভর করে। নিয়মিত ওষুধ খেলে থাইরয়েড নিয়ন্ত্রণে আসে। হাইপোথাইরয়েডিজমের ক্ষেত্রে থাইরয়েড হরমোন কম তৈরি করার ওষুধ দেওয়া হয়। যদি আয়োডিনের অভাবে দেখা যায় তবে রোগীকে নুন এবং অন্যান্য আয়োডিন যুক্ত খাবার খেতে বলা হয়। রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা বেশি থাকলে ওষুধ দিয়ে তা নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। এগুলোতেও রোগ নিয়ন্ত্রণে না এলে রেডিও আয়োডিন থেরাপি দিয়ে থাইরয়েড গ্রন্থিকে ধ্বংস করে দেওয়া হয় বা অস্ত্রোপ্রচারের মাধ্যমে গ্রন্থিকে বাদ দেওয়া হয়।
মধুমেহ এবং গলগণ্ড
থাইরয়েড নিঃসৃত হরমোন রক্তে বেশি হলে বা কমলে ইনসুলিনের সংবেদনশীলতা কমে যায়। ফলে ডায়াবেটিসও দেখা দিতে পারে। থাইরয়েড থেকেই গলগণ্ড রোগ হয়। গলার অগ্রভাগ ফুলে যায়।
হাইপোথাইরয়েডিজম এবং হাইপারথাইরয়েডিজম— দু’টি ক্ষেত্রেই গলগণ্ড হতে পারে।

Latest article