কুণাল ঘোষ: উৎপল দত্তর ‘টিনের তলোয়ার’ (Tiner Talowar) আবার সফলভাবে ফিরিয়ে আনলেন বিশিষ্ট নাট্যসংগঠক ও অভিনেতা তৃণমূল বিধায়ক পার্থ ভৌমিক। সোমবার আকাদেমি মঞ্চে তিনি ও তাঁর সহকর্মীরা যেন আবার ফিরিয়ে আনলেন সাতের দশকের রবীন্দ্রসদনকে।
সেই ১৯৭১-এর ১২ অগাস্ট রবীন্দ্রসদনে প্রথম প্রদর্শন। তার পঞ্চাশ বছরেরও পর সোমবার সন্ধ্যায় আকাদেমি অফ ফাইন আর্টস মঞ্চে অভিনীত এই ‘টিনের তলোয়ার’ (Tiner Talowar), অনুভূতি বলল, হয়তো প্রেক্ষিত বদলেছে, কিন্তু উৎপল দত্ত যে চোখ দিয়ে তৎকালীন সমাজকে বিঁধেছিলেন, তার দৃষ্টি ছিল নির্ভুল ও সুদূর নিক্ষেপিত। মূল সমস্যাগুলো আজও যেন খুব চেনা, বড়ই মন খারাপ করা।
উৎপল দত্তর নাটককে আবার ফিরিয়ে আনলেন নৈহাটি নাট্যসমন্বয়ের কলাকুশলীরা, পার্থ ভৌমিকের (Partha Bhowmik) নেতৃত্বে, যিনি অন্য পরিচয়ে তৃণমূল বিধায়কও বটে। রাজনৈতিক কর্মসূচির ব্যস্ততার ফাঁকে রাতভর মহড়ায় তিনি যে তীক্ষ্ণ এক নাট্যচরিত্র, আগেও প্রমাণ হয়েছে, আবারও হল।
উৎপল দত্তের ‘টিনের তলোয়ার’ (Tiner Talowar) ছিল এক বিপ্লব। কন্টেন্ট এবং মেকিং— দু’দিক থেকেই।
সেই ১৮৭৬ সালের চালচিত্র। বঙ্গের রঙ্গমঞ্চে একদিকে ব্রিটিশের দমনপীড়ন, সরকারবিরোধী প্রচার থামাতে নানা অপবাদ দিয়ে পুলিশি তাণ্ডব। অন্যদিকে, কিছু পয়সাওয়ালা বাবু, যাঁরা ব্রিটিশের তল্পিবাহক, আবার নাটকের গোষ্ঠীগুলির আর্থিক নিয়ন্ত্রণের সুবাদে একাধিক অভিনেত্রীর দখলদার। এই কঠিন সময়ের মধ্যেই গিরিশ ঘোষরা কাজ করেছেন। উৎপলবাবুর বেণীমাধব যেন গিরীশের ধাঁচে গড়া। ময়না যেন বিনোদিনী। বসুন্ধরা যেন স্বপ্নভাঙা একাধিক পতিতাপল্লির সদস্যার প্রতিনিধি, যাঁরা নাটককে ঘিরে নতুন জীবনের গান গাইতে চেয়েছিলেন। আর প্রিয়নাথ চরিত্রটি বেড়া ভাঙার হুঙ্কার দেওয়া নতুন প্রজন্মের কণ্ঠ। নাটকে তৎকালীন সমস্যার সবকিছুরই উল্লেখ।
আরও পড়ুন: আট বছরে অষ্টরম্ভা
আর মেকিং-এও অভিনবত্ব এনেছিলেন উৎপল। যাত্রার উপস্থাপনার কায়দাকে তথাকথিত নাক উঁচু মঞ্চের সংস্করণে রূপান্তরিত করেছিলেন তিনি। আলো, মিউজিক, গানের প্রয়োগও ছিল তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে।
পার্থ ভৌমিকদের নাটক এই মূল ভাব ধরে রাখতে পুরোপুরি সফল। মুরারি মুখোপাধ্যায়ের নির্দেশনা, অরিত্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রযোজনা নিয়ন্ত্রণ দারুণ। দু’-তিনজন অভিনেতা, অভিনেত্রীর অভিনয় দেখার জন্য একাধিকবার নাটকটি দেখা যায়। নাটকের ফিনান্সার নারীলোভী ‘বাবু’ বীরকৃষ্ণ দাঁর চরিত্রে পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায় একশোয় দুশো। চরিত্রটিকে অসাধারণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন পার্থ। বসুন্ধরার চরিত্রে দেবযানী সিংহ দক্ষতার ছাপ রেখেছেন। রাস্তার সব্জিওয়ালি থেকে নাটকে রাজকুমারীর ভূমিকায় পৌঁছে, তারপর ‘বাবু’র হাতছানিতে সন্ধিক্ষণে দাঁড়ানো ময়নার ভূমিকায় রায়তি ভট্টাচার্য মানানসই। প্রিয়নাথের ভূমিকায় নভোজিত দেব যথাযথ। বারবার নজর কেড়েছেন হরবল্লভের ভূমিকায় সুনীত ভট্টাচার্য। সুনীত দক্ষ ভিডিও এডিটর জানতাম, তবে মঞ্চের চরিত্রে এরকম নজরকাড়া চুম্বক হয়ে উঠতে পারেন, সেটা এতটা ভাবতে পারিনি। বাকি একাধিক চরিত্র, বিশেষ করে গায়কের ভূমিকাও সুঅভিনীত এবং সুউপস্থাপিত।
এবং পার্থ ভৌমিক। বেণীমাধবের চরিত্রে অনবদ্য। তিনিই যেন গিরীশ ঘোষ, কখনও নিজস্ব নাট্যশালা গড়ার তাগিদে নিজের হাতে তৈরি ময়নাকে তুলে দিচ্ছেন বীরকৃষ্ণর হাতে। কখনও নাটক বাঁচাতে তিনি আপসের পথে। কখনও তাঁর বিশ্বাস, নাটকে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে বললেই কি ব্রিটিশ চলে যাবে? উল্টে এতগুলো ছেলেমেয়ে পথে বসবে। কখনও তিনি এক টিমলিডার। কখনও তাঁর মুখে নিঃসঙ্গতার হাহাকার। আবার ক্লাইম্যাক্সে এই বেণীমাধব যখন ‘সধবার একাদশী’ নাটক করতে করতে অত্যাচারী ল্যামবার্ড সাহেবকে দেখে মানসিক অগ্ন্যুৎপাতে ‘তিতুমীর’-এর সংলাপ বলতে থাকেন, সহঅভিনেতারাও বদলে যান দেশপ্রেমের সজ্জায়। শিল্পীর মধ্যে থেকে বেরিয়ে আসে বিপ্লবী চেতনার আগুন। অনেক গোষ্ঠীই নিশ্চয়ই এর মধ্যে নাটকটি করেছেন। কিন্তু বড়বড় ছাপ রাখল নৈহাটি নাট্য সমন্বয়।
টিনের তলোয়ারের প্লট ১৮৭৬-এর। মঞ্চে এল ১৯৭১-এ, আরেক ইতিহাসের বাঁকে। এবং এখন ২০২২-এ দেখার সময়ও মনে হচ্ছে, সমাজটা তো রোগমুক্ত হল না। শোষকের চেহারা বদলেছে, শোষণের পদ্ধতি বদলেছে, শোষণ বন্ধ হল কই? শিল্পী তাঁর দল রাখতে, পেট চালাতে আপস করবেন নাকি ঝুঁকি নিয়ে বিপ্লব করবেন? ময়নারা অনেক কষ্টে তিল তিল করে নিজেদের তৈরি করার পর স্বাধীন জীবন বাছবে নাকি বীরকৃষ্ণদের কাছে আত্মসমর্পণে বাধ্য হবে? শিল্পের টিম লিডার মানুষের কথা ভাববেন নাকি ফিনান্সারের স্বার্থসিদ্ধিতে বাধ্য হবেন? প্রশ্নগুলো থেকেই যাচ্ছে, সম্ভবত থেকেও যাবে। আর তাই যুগে যুগে পার্থ ভৌমিকদেরও দরকার, যাঁরা বাংলা নাটকের মঞ্চে উৎপল দত্তের ‘টিনের তলোয়ার’-এর চরিত্রগুলিকে হাজির করে দেখাবেন— অ্যাকশন রিপ্লে।
সাধুবাদ পার্থ
অভিজিৎ ঘোষ: ‘টিনের তলোয়ার’ ১৮৭৬-এর পটভূমি। বউবাজার কিংবা শোভাবাজার নাট্যশালার জীবন্ত ছবি। ১৯৭১ সালে উৎপল দত্তের হাত ধরে প্রথম মঞ্চ উপস্থাপনা। বহুচর্চিত এবং বহু অভিনীত। কিন্তু এই ধরনের একটি নাটককে মঞ্চস্থ করার কলিজা থাকা দরকার। শুধু সময়কে ধরা নয়, জটিল চরিত্রকে বর্তমানের আবহে উপস্থাপনা করা কম কথা নয়। প্রথমেই পার্থ ভৌমিককে সাধুবাদ জানাতে হয় এই ধরনের একটি বহুচর্চিত নাটককে ফের মঞ্চে নিয়ে আসার জন্য। দ্বিতীয়বার সাধুবাদ জানাই বেণীমাধব চরিত্রে অভিনয় করার সাহস দেখানোর জন্য। বেণীমাধব যেন ফেলে আসা শতাব্দীর গিরিশ ঘোষ। একদিকে কাল্ট ফিগার অন্যদিকে নাটকের নায়কের জটিল চরিত্র। অবাক করার বিষয় হল, সারাদিন রাজনীতির আবহে ঘোরাঘুরি করে পার্থ অসাধারণ ভঙ্গিমায় সংলাপ বলেছেন, কবিতা আউড়েছেন। কে বলবে তিনি বিধায়ক। শেষে আর একটি বিষয় বলতেই হয়, তা হল—বামপন্থী উৎপল দত্তর নাটক মঞ্চস্থ করতে এতটুকু দ্বিধাবোধ না করা। প্রচলিত কথা আছে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সিপিএমের চেয়ে বড় বামপন্থী। সিপিএম দলের বাইরে | বামপন্থাকে বিসর্জন দিলেও সেই বোধ ধরে রেখেছেন তিনি এবং তাঁর সৈনিকরা। পার্থ সেই সেনাদলের অন্যতম কমান্ডার।