২০২২-এর মাঝামাঝি সময় বিবিসির সাংবাদিককে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ওশানগেট সিইও স্টকটন রাশ বলেছিলেন, আপনি যদি ‘সেফ’ থাকতে চান তবে আপনি আপনার বাড়ির বিছানায় থাকুন। বাড়ির বাইরে বেরোবেন না। গাড়ি চড়বেন না। আমি ঠিক অতটাও ‘সেফ’ থাকতে চাওয়ার মানুষ নই। গত কয়েকদিনে স্টকটন রাশ লোকটি কে সকলেই জেনে গিয়েছেন ডুবোযান (সাবমার্সিবল) টাইটানের (Titan Sub) শেষ হয়ে যাওয়ার চর্চার মধ্যে দিয়ে। স্টকটন রাশ ছিলেন ২০২১ থেকে সমুদ্রের ৪ হাজার মিটার নিচে ১১২ বছর ধরে পড়ে থাকা অভিশপ্ত জাহাজ টাইটানিক দর্শনে নিয়ে যাওয়া প্যাকেজ ট্যুর সংস্থার কর্ণধার। তিনি নিজে ও তাঁর স্ত্রী একাধিকবার গিয়েছিলেন টাইটানিক-দর্শনে। একজন অভিজ্ঞ ট্যুর অপারেটর যিনি মূলত ধনকুবেরদের নিয়ে সমুদ্রভ্রমণে যান। বিশেষত যিনি মনে করেন, পৃথিবীর উপরিভাগ বা মহাকাশের থেকে সমুদ্রের অতল গভীর অনেক বেশি নিরাপদ ও ভবিষ্যতে বাসযোগ্যও বটে। এই যাঁর বিশ্বাস তিনি যে বিবিসির সাংবাদিককে কটাক্ষ করে ‘সেফ’ থাকার ডেফিনেশন বাতলে দেবেন তাতে আর আশ্চর্য কী! তাঁরই ওশানগেট সংস্থার ‘টাইটান সাবমেরিন’ ধ্বংস হয়ে অকালমৃত্যু হল ৫ সমুদ্র অভিযাত্রীর।
টাইটান কি সাবমেরিন
প্রথমেই বলে রাখা ভাল টাইটান (Titan Sub) কোনও সাবমেরিন নয়। এটি একটি সাবমার্সিবল যান। প্রশ্ন জাগতে পারে— তা হলে একে সাবমেরিন বলা হচ্ছে কেন? আর যদি সাবমেরিন না-ই হবে তবে সমুদ্রের ৪ হাজার মিটার নিচে (১৩ হাজার ফুট গভীর) সে যায় কীভাবে? প্রথম প্রশ্নের উত্তরে আসা যাক। সাধারণত আমরা সাবমেরিন বলতে বুঝি ডুবোজাহাজ বা রণতরী যা কোনও দেশের সেনাবাহিনী (উপকূলরক্ষী বাহিনী) দেশের নিরাপত্তাজনিত কারণে ব্যবহার করে থাকে। এই ধরনের অত্যাধুনিক সাবমেরিন নিউক্লিয়ার সিস্টেমে চলে। এগুলি নানা ধরনের অস্ত্রে সজ্জিত থাকে। অফুরন্ত অক্সিজেনের ব্যবস্থা থাকে। কারণ, এই ধরনের নিউক্লিয়ার সাবমেরিনে কার্বনডাই অক্সাইডকে অক্সিজেনে রূপান্তর করার ব্যবস্থা বা বাতাসকে পুনর্ব্যবহারের ব্যবস্থা থাকে। ফলে অনায়াসে তা দীর্ঘদিন সমুদ্রের গভীরে ডুব দিয়ে থাকতে পারে। সেই সঙ্গে এই সাবমেরিনগুলির নিজস্ব নেভিগেশন সিস্টেম থাকে। এরা নিজেরাই নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এরা নিজেরা দরজা খোলে এবং বন্ধ করে সমুদ্রে ডুব দেয়। আকার ও আয়তনে হয় বিশাল। থাকে একাধিক কম্পার্টমেন্ট। আলাদা ডিউটি সেকশন। বিশ্রামের ব্যবস্থা। ডেক যেখানে সমুদ্রের ওপরে (সারফেস) গিয়ে দাঁড়ানো যায়। কাজ করা যায়। একসঙ্গে অন্তত ২৫-৩০ জন এই ধরনের সাবমেরিনে থাকেন। এই সাবমেরিনগুলি বাইরের ও ভিতরের আবরণ বা দেওয়াল-দরজা এতটাই পুরু পাত (টাইটেনিয়াম) দিয়ে তৈরি হয় যে সমুদ্রের কমপক্ষে হাজার ফুট গভীরে ডুব দিলেও সেখানকার জলের প্রেসারে তা অক্ষত থাকে। সর্বোপরি এতে মজুত থাকে অফুরন্ত শুকনো খাবার। কারণ এক-একটি সাবমেরিন অভিযানে বেরোলে কবে ফিরবে তার কোনও ঠিক থাকে না। আর এই সাবমেরিনে যাঁরা কাজ করেন তাঁরা প্রত্যেকেই বিভিন্ন ভাবে ট্রেনড। সমুদ্রের গভীরে কোনও ইলেট্রিক্যাল বা নিউক্লিয়ার সিস্টেমে সমস্যা দেখা দিলে সাবমেরিনে থাকা ইঞ্জিনিয়াররা নিজেরাই তা সারাতে পারেন। সর্বোপরি সমুদ্রের অতলে সাবমেরিনটি ভয়ানক কোনও বিপদে পড়লে সে উপকূলরক্ষী বাহিনীকে বিপদসংকেত পাঠাতে পারে উদ্ধারের জন্য। অনেক সময় যন্ত্র বিকল হলেও তা নিজে নিজেই সারফেসে উঠে আসতে সক্ষম। কিন্তু ট্যুর প্যাকেজে যাওয়া টাইটানে কি এতসব নিখুঁত নিশ্চিত-নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল? ছিল না, থাকা সম্ভবই নয়।
টাইটানে কী ছিল আর কী ছিল না
এতে নিজস্ব কোনও নেভিগেশন সিস্টেম নেই। সবটাই নিয়ন্ত্রিত হয় একটি গেম কন্ট্রোলার দিয়ে (লজিটেক এফ ৭-১০)।
টাইটানের (Titan Sub) দরজা অভিযাত্রীরা ঢুকে গেলে বাইরে থেকে বন্ধ করে দেওয়া হয়। ভিতর থেকে দরজা বন্ধ বা খুলতে পারে না টাইটান।
মাত্র ৯৬ ঘণ্টার অক্সিজেন মজুত রাখা যায়। কারণ নিজস্ব কোনও অক্সিজেন তৈরির (কার্বনডাই অক্সাইড পরিশোধন বা বাতাস পনুঃসঞ্চালন) সিস্টেমই নেই। স্বাভাবিক ভাবেই ৯৬ ঘণ্টা পার করে গেলে অক্সিজেনের অভাবেই মরে যাবেন অভিযাত্রীরা।
মাত্র ২২ ফুট (৬.৭ মিটার) লম্বা টাইটান। ভিতরে চেয়ারে জবুথবু হয়ে বসতে হয়। আলাদা ভাবে কোনও কেবিন কিংবা দাঁড়ানোর জায়গা নেই।
নিজে থেকে কোনও বিপদসংকেত পাঠানোর ব্যবস্থা নেই (বিকন)।
সমুদ্রের অতলে যোগাযোগের জন্য স্পেস-এক্সের স্টারলিংক স্যাটেলাইট ব্যবহার করা হয়। ফলে বোঝাই যাচ্ছে আদতে সাবমেরিন আর সাবমার্সিবল-এর মধ্যে তফাত কত ব্যাপক। টাইটান মূলত এক্সপেরিমেন্টাল পর্যটন ডুবোযান। সাবমেরিন তা নয়। ফলে এটুকু বলাই যায় চরিত্রগত ভাবে সব সাবমেরিনই সাবমার্সিবল। কিন্তু সব সাবমার্সিবল সাবমেরিন নয়।
আরও পড়ুন- মণিপুরের হাল খারাপ, স্বীকার করলেন মুখ্যমন্ত্রীই, তুলোধোনা বিরোধীদের
অভিশপ্ত টাইটানিক
১৯১২ সালের ১৫ এপ্রিল প্রথম অভিযানের দিনই কানাডার নিউফাউন্ডল্যান্ড থেকে ৬৯০ কিলোমিটার দূরে হিমশৈলের চূড়ায় ধাক্কা লেগে ডুবে যায় অভিশপ্ত বিশ্বখ্যাত অত্যাধুনিক প্রমোদ তরণী ‘টাইটানিক’। যার ধ্বংসাবশেস পড়ে আছে অতলান্তিক মহাসাগরের সাড়ে বারো হাজার ফুট নিচে। ১৯৮৫ সালে টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যায়। ডুবে যাওয়ার পর গত ১১২ বছর ধরে টাইটানিককে নিয়ে পৃথিবীতে কম চর্চা হয়নি। ১৯৯৭ সালে পরিচালক জেমস ক্যামেরন বানিয়ে ফেলেন বিস্ময়-জাগানো ছবি ‘টাইটানিক’। এই ভদ্রলোক ছবি তৈরির আগে ৩৩ বার গিয়েছিলেন টাইটানিককে খুঁটিয়ে দেখতে।
কেন এই দুর্ঘটনা
জানা যাচ্ছে, সমুদ্রের গভীরে দু ঘণ্টা যাওয়ার আগেই জলের চাপে টাইটানের (Titan Sub) ভিতরের অংশ চিঁড়ে-চ্যাপ্টা হয়ে যায়। আমেরিকা ও কানাডার উপকূলরক্ষী বাহিনী রোভক (বিশেষ সমুদ্রযান) পাঠিয়ে টাইটানিকের ১৬০০ ফুট দূরে টাইটানের ৫টি ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পেয়েছেন। বলে রাখা দরকার, টাইটানিক দু-টুকরো হয়ে ভেঙেছে এ-কথা সকলেই জানেন। কিন্তু সেই দুটি টুকরো একে অপরের থেকে ২ হাজার মিটার দূরত্বে পড়ে আছে নিজেই ইতিহাস হয়ে। আর জীবনের কী অদ্ভুত সমাপতন! আমেরিকার আর-এক ধনকুবের জয় ব্লুম ও তাঁর পুত্রকে স্টকটন বলেছিলেন, টাইটানে মাত্র দুটি আসন খালি আছে এই অসাধারণ সমুদ্র অভিযানে। তিনি কাজের ব্যস্ততা দেখিয়ে রাজি হননি। আসল কারণটি পরে ব্রিটিশ সংবাদ মাধ্যমকে বলেছেন। তিনি ওশেনগেট সিইওর কাছ থেকে সবটা জেনে বুঝেছিলেন এতে নিরাপত্তার বড়সড় গলদ রয়েছে। স্বাভাবিক ভাবেই জীবনের ঝুঁকি নেননি। বেঁচে গিয়েছেন পিতা-পুত্র। তাঁর জায়গায় টাইটানে চেপে বসেন আর এক পিতা-পুত্র। পাকিস্তানের ধনকুবের শাহাজাদা দাউদ ও তাঁর ১৯ বছরের পুত্র সুলেমান। যে বাবার সঙ্গে এই অভিযানে যেতেই চায়নি! নিমরাজি হয়ে বাবার কথায় অভিশপ্ত টাইটানিক দেখতে গিয়েছিল যে, টাইটানে চেপে সে আজ নিজেই অভিশপ্ত ইতিহাসের অংশ হয়ে রইল চিরকালের জন্য।