প্রতিবেদন : বৃহস্পতিবার নন্দীগ্রামে শহিদ তর্পণে সোচ্চার তৃণমূল কংগ্রেস (Nandigram TMC- Shahid Tarpan), কোণঠাসা বিজেপি। গোকুলনগরের করপল্লিতে সকাল ১০টার অনেক আগে থেকেই ভিড় জমতে শুরু করে। ঠিক সাড়ে দশটায়— যখন তৃণমূল নেতৃত্ব শহিদ বেদিতে মালা দিচ্ছেন তখন সামনের রাস্তা লোকারণ্য। সেই রেশ ধরে রেখেই পাশেই ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির মঞ্চে শুরু হল ২০০৭-এর ১০ নভেম্বর কালো দিনটার স্মৃতিচারণ। শহিদ-মা ফিরোজা বিবি থেকে সদ্য বিজেপি ছেড়ে তৃণমূলে যোগ দেওয়া সকলেই দৃপ্তকণ্ঠে জানিয়ে দিলেন, আন্দোলনের পবিত্র মাটি নন্দীগ্রামে গদ্দার-বিশ্বাসঘাতকদের কোনও জায়গা নেই। আগামী পঞ্চায়েত নির্বাচনে নন্দীগ্রামের মানুষ তা বুঝিয়ে দেবে৷ এদিন শহিদ স্মরণে সভা চলাকালীন গ্রামবাসীরা পোস্টার হাতে বিক্ষোভ দেখিয়ে বলতে থাকেন, নন্দীগ্রামের পবিত্র মাটিতে গদ্দার শুভেন্দুকে ঢুকতে দেব না। তাঁরা শহিদ বেদির সামনে ধরনায় বসেন। সঙ্গে বসেন তৃণমূল নেতৃত্ব। নন্দীগ্রামের ভূমিপুত্ররা কেউ এদিন বিজেপির সঙ্গে ছিলেন না। খেজুরি-চণ্ডীপুর-এমনকী ঝাড়গ্রাম থেকে গাড়িতে করে লোক আনতে হয়েছে। এমনকী যে বটকৃষ্ণ দাসকে এই শহিদ স্মরণে আনবে বলে অনেক কসরত করেছেন শুভেন্দু, সেই বটকৃষ্ণ শেষ পর্যন্ত বিজেপির সভায় আসেননি৷ যা দেখে প্রচণ্ড খেপে গিয়ে বিজেপি নেতাদের অপদার্থ বলতেও ছাড়েননি শুভেন্দু৷ তৃণমূলের শহিদ তর্পণে গোকুলনগরের করপল্লির মানুষদের আবেগ, স্বতঃস্ফূর্ততার কাছে ধূলিসাৎ হয়ে গিয়েছে বাইরে থেকে লোক এনে শুভেন্দুর মেকি শহিদ স্মরণ।
শহিদ তর্পণের মঞ্চে শুভেন্দু ও বিজেপিকে তুলোধোনা করেন শহিদ-মা ফিরোজা বিবি, ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি শেখ সুফিয়ান, মন্ত্রী অখিল গিরি, বিপ্লব রায়চৌধুরী, নন্দীগ্রাম ১ নং ব্লকের সভাপতি বাপ্পাদিত্য গর্গ, নন্দীগ্রাম ২-এর সভাপতি অরুণাভ ভুঁইয়া, সদ্য বিজেপি ছেড়ে দলে যোগ দেওয়া জয়দেব দাস, তন্ময় ঘোষ-সহ অন্যরা। দলের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক ও মুখপাত্র কুণাল ঘোষ শুভেন্দুকে ধুইয়ে দিয়ে বলেন, নন্দীগ্রামে শুভেন্দুর লোক আর বিজেপি বলে কিছু নেই। বাইরের লোক আনতে হচ্ছে। ‘আগে ঘর সামলা পরে ভাববি বাংলা’। তাঁর সংযোজন, ও বলে ৮০ শতাংশ গালমন্দ কেন ওকে দেওয়া হয়। তার কারণ, তৃণমূলে থাকাকালীন ৮০ শতাংশ পদ-সহ সবকিছু শুভেন্দু ও তার পরিবার নিয়েছিল।
সভা চলাকালীন আচমকাই গ্রামবাসীরা পোস্টার হাতে চিৎকার করতে থাকেন। বিশ্বাসঘাতক, গদ্দার শুভেন্দুকে এখানে ঢুকতে দেব না। শহিদ বেদি অপবিত্র করতে দেব না। নন্দীগ্রামের আন্দোলনে ওর কোনও ভূমিকা নেই। এরপরই শুরু হয় গো-ব্যাক শুভেন্দু স্লোগান সঙ্গে হাতে পোস্টার। তাদের থামানো যাচ্ছিল না। এই সময় কুণাল ঘোষ বিক্ষোভকারী গ্রামবাসীদের জিজ্ঞেস করেন আপনারা কী চান? তাঁরা বলেন আমরা গদ্দারকে ঢুকতে দেব না। কুণাল বলেন ঠিক আছে আপনাদের আবেগকে আমরা শ্রদ্ধা করি কিন্তু একটা সভা চলছে শহিদ-তর্পণ চলছে, তার মাঝখানে এটা না করে সভা শেষ হলে আপনারা যদি ধর্নায় বসতে চান তাহলে আমরা আপনাদের সঙ্গে ধর্নায় বসব। সেইমতো সভা শেষে শহিদ বেদির ওপরে ও সামনের রাস্তায় গোকুলনগরের বাসিন্দারা ধর্নায় বসে পড়েন। সঙ্গে ধর্নায় বসেন ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি শেখ সুফিয়ান, মন্ত্রী অখিল গিরি, নন্দীগ্রাম ১নং ব্লকের সভাপতি বাপ্পাদিত্য গর্গ, নন্দীগ্রাম ২নং ব্লকের সভাপতি অরুণাভ ভুঁইয়া এবং কুণাল ঘোষ। চলতে থাকে টানা স্লোগান। পুলিশের তরফে ধর্না তুলে নিতে অনুরোধ করা হলে কুণাল পাশেই ধর্নায় বসা এক গৃহবধূকে দেখিয়ে বলেন সিপিএমের যে হার্মাদরা অত্যাচার করে এই বোনকে ধানের জমিতে অজ্ঞান করে ফেলে চলে গিয়েছিল এর মতো গ্রামের মহিলারা অথবা স্বজনহারা পরিবারের সদস্যরা চাইছেন না সেই হার্মাদদের সঙ্গে নিয়েই শুভেন্দু এখানে ঢুকুক। তাই এই প্রতিবাদ আন্দোলন ধর্না। আমি বোঝানোর চেষ্টা করছি, প্রশাসনকে সহযোগিতা করবে। এরপর সকলের সঙ্গে আলোচনা করে কুণাল ও স্থানীয় নেতৃত্ব পুলিশকে জানান গ্রামবাসীরা বলছেন, আমরা ধর্না তুলতে পারি কিন্তু একটা শর্ত আছে। কী সেই শর্ত? ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটি ও গ্রামবাসীদের বক্তব্য, শুভেন্দু এখানে ঢুকতে পারে একটাই শর্তে— শহিদ বেদিতে এই ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির তরফে যে মালা দেওয়া হয়েছে সেই মালা সরানো যাবে না। এর অন্যথা হলে পাল্টা কর্মসূচি নেবে তৃণমূল কংগ্রেস। এরপর ধর্না তুলে নেন গ্রামবাসীরা।
আরও পড়ুন-পঞ্চায়েত নির্বাচন জেলায় জেলায় তৃণমূলের প্রতিনিধি
শুভেন্দুকে ঘিরে গ্রামবাসীদের স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভের পোস্টার কলকাতা থেকে আনা হয়েছে বলায় কুণাল ঘোষ পাল্টা জানিয়ে দেন, গত তিনদিন আমি এই জেলাতেই আছি ফলে যা হয়েছে সেটা স্থানীয় মানুষদের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। আসলে শুভেন্দু ভাবতেই পারেনি নন্দীগ্রামে (Nandigram TMC- Shahid Tarpan) ওকে ঢুকতে দেব না বলে বিক্ষোভ দেখাতে পারে৷ এদিন গঙ্গাজল দিয়ে শহিদ বেদি ধোয়ার প্রসঙ্গে সাংবাদিকরা জিজ্ঞেস করলে কুণাল বলেন, ও গঙ্গাজল দিয়ে ধুলে আমাদের তো কার্বলিক অ্যাসিড দিয়ে শহিদ বেদি ধোয়া উচিত। ও এখন শয়নে স্বপনে আমায় দেখছে। ইয়ে ডর হামে আচ্ছা লাগা। এতদিন ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটি ছিল এবার শুভেন্দু উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটি তৈরি হবে!
শহিদ তর্পণ শেষে শেখ সুফিয়ানের বাড়িতে দলের কর্মীদের নিয়ে বৈঠক করেন। এরপর বিকেল তিনটেয় নন্দীগ্রামের হাজরাকাটায় আরও একটি স্মরণসভায় যোগ দেন কুণাল। সেখানেও ছিল উপচে পড়া ভিড়। সঙ্গে ছিলেন ফিরোজা বিবি, সৌমেন মহাপাত্র, অখিল গিরি, সুপ্রকাশ গিরি। এই সভা থেকেও আগামী পঞ্চায়েত নির্বাচনে সব বুথে বিজেপিকে ধুয়ে-মুছে সাফ করার শপথ নেন তৃণমূল নেতৃত্ব। শহীদ সমাবেশে নন্দীগ্রামের আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা গান গেয়ে পুরনো স্মৃতি উসকে দেন অন্যতম আন্দোলনকারি শিল্পী নারায়ণ মন্ডল।