যতই কর বঞ্চনা, পঞ্চায়েতে জিতবে না

সব অপপ্রচার, কুৎসা উড়িয়ে, কেন্দ্রের অভিসন্ধিকে পর্যুদস্ত করে, নতুন জেদে, নব প্রত্যয়ে জেগেছে জোড়া ফুল। পরিস্থিতি বিশ্লেষণে প্রবীর ঘোষাল

Must read

বাগে পেতেই ঘিরে ধরেছিলেন গ্রামের অনেক মানুষ। বাঁকুড়ার ইন্দাসের ঘটনা। বিধায়ক নির্মলকুমার ধাড়া এসেছিলেন মানুষের মন যাচাই করতে। যেহেতু তিনি পদ্মফুল প্রতীকের প্রার্থী ছিলেন, তাই হয়তো ভেবেছিলেন, গ্রামবাসী তাঁকে ফুল-মালা দিয়ে বরণ করবেন। না, তা তাঁরা করেননি। উল্টে কয়েকটি প্রশ্ন করেছেন। তাতেই বিপাকে পড়ে গিয়েছেন বিধায়ক। গ্রামবাসীদের প্রশ্নের কোনও সদুত্তর দিতে পারেননি। মানে মানে সরে পড়ছেন। যাকে বলে রণ ভঙ্গ দেওয়া!

আরও পড়ুন-সুজনকে অত্যাচারী বললেন শোভনদেব

প্রশ্ন ছিল, ১০০ দিনের কাজ বন্ধ হল কেন? কেন আবাস যোজনায় কেন্দ্রের সরকার টাকা দিচ্ছে না? ভোটের সময় তো বলেননি, রেশন দেওয়া বন্ধ হবে? কেবল ইন্দাস নয়, গোটা গ্রাম বাংলায় এইসব প্রশ্ন গমগম করছে। ফুটছেন গ্রামবাসীরা। বিজেপির বিধায়ক-সাংসদরা তো গ্রামবাসীদের বিক্ষোভের ভয়ে জনসংযোগ কর্মসূচি কার্যত বন্ধই করে দিয়েছেন।
১০০ দিনের কাজ আর আবাস যোজনার ‘দুর্নীতি’ নিয়ে বিজেপি-কংগ্রেস-সিপিএম খুব সরব। সরকারি সূত্র বলছে, গত এক বছরে এ রাজ্যে গ্রামোন্নয়ন প্রকল্প, মানে ১০০ দিনের প্রকল্প এবং আবাস যোজনা প্রকল্পগুলির কাজ খতিয়ে দেখতে মোট ৭১টি কেন্দ্রীয় টিম রাজ্যে এসেছে। কিছু পদ্ধতিগত ত্রুটি ছাড়া আর কিছুই তারা খুঁজে পায়নি। অথচ শুধুমাত্র এই দুটি প্রকল্পেই প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা চেপে রেখেছে, দেয়নি দিল্লির সরকার। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতেই, তারা একাজ করছে। প্রতিহিংসার রাজনীতি। তাই পঞ্চায়েত ভোটের প্রচারে এই অবিচারকে সামনে রেখে গ্রামে গ্রামে প্রচারে তুফান তুলতে হবে তৃণমূল কংগ্রেসের সর্বস্তরের নেতা-কর্মী-সমর্থকদের। জনদরদীর ছদ্মবেশী বিরোধীদের মুখোশ টেনে খুলে দিতে হবে।

আরও পড়ুন-পর্যটকদের কাছে আরও রূপসী হয়ে উঠবে দিঘার অমরাবতী

১৯৭৮ সালে পশ্চিমবঙ্গে ত্রিস্তর পঞ্চায়েত ব্যবস্থা কায়েম হয়। সেই ভোটে ৬৩ হাজারের মতো আসন ছিল। বামফ্রন্ট সরকার সবে ক্ষমতায় এসেছে। সিপিএম তো বটেই, বামফ্রন্টের অন্য শরিকরাও সব আসনে প্রার্থী খুঁজে বার করতে হিমশিম খায়। শেষমেশ যাকে পারে তাকেই ভোটে দাঁড় করিয়ে দেয়। এমনকী ত্রিস্তর পঞ্চায়েতে বাম শরিকদের টিকিটে কংগ্রেসি পরিবারের অনেকেই জিতে যান। সেভাবেই চলতে শুরু করে পঞ্চায়েত ব্যবস্থা।
পঞ্চায়েত ভোটের কয়েকমাস পরেই রাজ্যে বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে ভয়াবহ বন্যা হয়। সেই বন্যায় পঞ্চায়েতগুলি কোথাও কোথাও প্রাণপাত করে দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়ায়। ত্রাণসামগ্রী পৌঁছে দেয়। গৃহহারা লক্ষ লক্ষ মানুষের অস্থায়ী আশ্রয়েরও ব্যবস্থা করে। কিন্তু সদ্য পঞ্চায়েতে ক্ষমতা পাওয়া শাসক দলের একাংশ বন্যার ত্রাণসামগ্রী নিয়ে বাঁহাতে রােজগারের পথও খুঁজে পায়।

আরও পড়ুন-৪৮০ রাস্তায় বরাদ্দ ১৬১ কোটি

দুর্নীতির সেই শুরু। ঘুঘুর বাসা তৈরি হয় পঞ্চায়েতগুলিতে। ক্রমশ বল্গাহীন হয়ে ওঠে চুরির প্রবণতা। পাশাপাশি বেড়ে চলে পার্টিবাজি। পার্টির লোক না হলে, কেউ কোনও সরকারি সুবিধা পাবে না। আগে সিপিএমের কাছ থেকে লিখিয়ে আনতে হবে, তুমি পার্টির লোক। পঞ্চায়েতে দুর্নীতি যে লাগামছাড়া হচ্ছে, সেটা আলিমুদ্দিন স্ট্রিটেরও নজরে আসে। কিন্তু তখন পার্টি নেতৃত্বের একটা অংশ যুক্তি দেয়, ‘আরে ওদের পঞ্চায়েতে করেকম্মে খেতে দাও। পার্টিফান্ডের টাকাটা ঠিক থাকলেই হল। কারণ ওরাই ভোটের সময় লেঠেলবাহিনী হয়ে বুথ দখল করে। ভোটে সিপিএমকে জিতিয়ে আনে।
দুর্নীতির সঙ্গে পঞ্চায়েত কর্তাদের হার্মাদও হয়ে উঠতে দেখল বঙ্গবাসী। গ্রামে তাদের কথাই আইন। থানা নয়। হয় পঞ্চায়েত নয়তো সিপিএমের অফিসে বসেই যাবতীয় আইন-শৃঙ্খলার সমস্যা সমাধান করা হত। দুর্নীতি আর অত্যাচার এভাবেই হাত ধরাধরি করে বাংলার গ্রামাঞ্চলকে গ্রাস করল। এই অপশাসন থেকে সাধারণ মানুষ মুক্তি চাইছিল।

আরও পড়ুন-অপহরণ ও খুনের মামলায় যাবজ্জীবন

রাজ্য রাজনীতিতে তখন ‘ঝড়ের পাখি’ হিসাবে মাঠে-ঘাটে চষে বেড়াচ্ছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অভিভক্ত কংগ্রেসের মধ্যে যারা সিপিএমের এজেন্ট ছিল তারা নানা কৌশলে মমতার পায়ে বেড়ি পরানোর চেষ্টা করছিল। কিন্তু অগ্নিকন্যাকে রোখার ক্ষমতা সিপিএম-কংগ্রেসের যৌথ নেতৃত্বের ছিল না। তৃণমূল কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা হল। অবশেষে ২০১১ সালে রাজ্যবাসী মুক্তির আলো দেখল। মমতার নেতৃত্বে মা-মাটি মানুষের সরকার ক্ষমতায় এল। ৩৪ বছরে রাজ্যকে শ্মশানে পরিণত করা বাম শাসনের অভিশাপ বাংলাকে ঘোর অন্ধকারে ডুবিয়ে দিয়েছিল। সেখান থেকে তাকে টেনে তোলা খুব সহজ কাজ ছিল না। কঠিন অর্থনৈতিক অবস্থার মধ্যে থেকেও মমতার নেতৃত্বে বাংলা ঘুরে দাঁড়িয়েছে। তাঁর মস্তিষ্কপ্রসূত ৬৩টি জনমুখী সমাজকল্যাণমূলক প্রকল্প মানুষের বহু সমস্যা মিটিয়ে দিয়েছে। ‘দিদিকে বলো’ থেকে ‘দুয়ারে সরকার’ এবং ‘দিদির সুরক্ষা কবচের’ মতো কর্মসূচির মাধ্যমে বাম জনতা সরাসরি প্রশাসনিক সুবিধা পাচ্ছে। রাজ্যের সিংহভাগ মানুষ, জাতি-ধর্ম- নির্বিশেষে এইসব প্রকল্পগুলি ভোগ করছে। তাতেই তো বিরোধীদের ভীষণ গাত্রদাহ হচ্ছে। কেন সরকারি প্রকল্পের সুযোগ সরাসরি উপভোক্তারা পাবে?

আরও পড়ুন-

২০১৮ সালে পঞ্চায়েত নির্বাচন হয়েছিল। পরের বছর লোকসভা ভোটে এ রাজ্যে ১৮টি আসন দখল করেছিল বিজেপি। বিরোধীরা ঊর্ধ্ববাহু হয়ে বলতে শুরু করেছিল, ‘তৃণমূল কংগ্রেসের আয়ু খতম।’ কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে মানুষের দুয়ারে গিয়ে সরকারের এবং দলের ছোটখাটো ভুলত্রুটি সংশোধন করে নেবেন, সেটা তাদের মগজে ঢোকেনি। আসলে মানুষের মনের কথা এ রাজ্যে কেউ যদি পড়তে পরেন, তার নাম মমতা। বিগত বিধানসভা ভোটে রাজ্যবাসী তা বুঝিয়ে দিয়েছিল।

আরও পড়ুন-সিঙ্গুর থেকে পথশ্রী-রাস্তাশ্রী প্রকল্পের সূচনা মুখ্যমন্ত্রীর, তৈরি হবে কর্মসংস্থান

সাগরদিঘি বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনের ফলাফলে বিরোধীরা অক্সিজেন পেয়েছে। কিন্তু সেটাও আগামী দিনে শূন্যগর্ভে বিলীন হবে। দলীয় বৈঠকে তৃণমূল কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় বলে দিয়েছেন, ‘‘যে কোনও কেন্দ্রে মুখ্যমন্ত্রীর ছবি সামনে রেখে ভোট হলে, কেউ লড়াইয়ের ময়দানে থাকবে না। তৃণমূল কংগ্রেসেই শেষ হাসি হাসবে। যে সংখ্যালঘু হোক, আদিবাসী হোক আর বর্ণ হিন্দুই হোক। আসলে ২০১১ সাল থেকে মানুষ তো দেখছে কীভাবে কাজ করছে মা-মাটি-মানুষের সরকার।’’

আরও পড়ুন-‘কেন্দ্রীয় সরকারকে বুঝিয়ে দিতে হবে, বাংলার বুদ্ধি আছে, মেধা আছে’ পথশ্রী-রাস্তাশ্রী প্রকল্পের শিল্যানাস করে দাবি মুখ্যমন্ত্রীর

হ্যাঁ, মমতা তো বটেই, অভিষেকও বৈঠকে জেলার নেতাদের নির্দেশ দিয়েছেন, ‘‘ঘরে কেউ বসে থাকবেন না। জনংসযোগের কাজে আরও জোর দিন। দুয়ারে সরকারে যান। বিনয়ের সঙ্গে মানুষের অভাব-অভিযোগ শুনুন। আর সেসব সুরাহার জন্য সরাসরি মুখ্যমন্ত্রীর দফতরে পাঠান। ‘দিদির সুরক্ষা কবচ’ কর্মসূচির মূলমন্ত্র এটাই। সুতরাং পঞ্চায়েত নির্বাচন পাখির চোখ করে জোট বাঁধুন, তৈরি হোন। সামনে যুদ্ধ আসছে।

Latest article