সুভাষচন্দ্র বসুর রাজনৈতিক শিক্ষাগুরু ছিলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ। তাঁর হাত ধরেই সুভাষ প্রথম প্রকাশ্য জনসভায় বক্তব্য পেশ করেন। বিলাসিতা ছেড়ে কীভাবে প্রকৃত বিপ্লবীর জীবন এগিয়ে নিয়ে যেতে হয়, সেটাও দেশবন্ধুর কাছেই শিখেছিলেন সুভাষ। লিখলেন রাতুল দত্ত
আরও পড়ুন-নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর জন্মদিবসে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শ্রদ্ধার্ঘ্য
‘চলে এসো’। দুটি শব্দে ডাক পেয়েছিলেন তাঁর রাজনৈতিক গুরুর কাছ থেকে। ইংল্যান্ডে সিভিল সার্ভিস ছেড়ে চলে এসেছিলেন অগ্নিযুগের সেনাপতি হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে। সুভাষচন্দ্র বসু। তাঁর আধ্যাত্মিক দীক্ষাগুরু যদি স্বামী বিবেকানন্দ হন, রাজনৈতিক শিক্ষাগুরু অবশ্যই দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ। যে মানুষটিই পরবর্তীকালে সর্বত্র বলেছিলেন, ‘‘আমার সুভাষকে আমি তোমাদের কাছে দিয়ে যাচ্ছি। ও কিন্তু আমার সবচেয়ে দামি হিরের টুকরো। অপেক্ষা করো, ও তোমাদের সবকিছু ফিরিয়ে দেবে।’’ (I have given you Subhas— my best jewel. Wait you will get everything.)। ১৯২১-এর ১৬ জুলাই দেশে ফিরে আসার আগে যে শিষ্য তাঁর গুরুকে লিখছেন : I had passed the Indian Civil Service in England in 1920, but finding that it would be impossible to serve both masters at the same time namely, the British government and my country। উত্তর এসেছিল, ওপরের দুটি শব্দে। বাবাকে নিয়ে লেখা একটি প্রবন্ধে অনিতাদেবী লিখছেন, ‘সুভাষ দেশে ফিরে এসেই বাবাকে তাঁর রাজনৈতিক গুরুর আসনে বসালেন।’
আরও পড়ুন-
কেন রাজনৈতিক গুরু? কারণ, দেশবন্ধু চেয়েছিলেন, আইনসভায় প্রবেশ করে ভেতর থেকে ঔপনিবেশিক আমলাতন্ত্রের বিরোধিতা করার পক্ষে। আর গান্ধীজির তত্ত্ব ছিল, আইনসভায় প্রবেশেরই বিপক্ষে। ফলে, কংগ্রেসে থেকে পূর্ণ স্বরাজ দলের ভাবনা, ১৯২২ সালে দেশবন্ধু ভাবতে পারলেও ১৯৩৯ সালে সুভাষ ভাবতে পারেননি। গয়া কংগ্রেসে নিজের মত প্রতিষ্ঠিত না হওয়ায় সভাপতি পদে ইস্তফা দিলেন দেশবন্ধু, আর কংগ্রেসের মধ্যেই তৈরি করেছিলেন স্বরাজ্য দল। মাথার ওপর গান্ধীজি থাকায়, সেদিন মতিলাল নেহরু যেমন দেশবন্ধুকে পূর্ণ সমর্থন করতে পারেননি, তেমনই পুত্র জওহরলালের সমর্থন পেলেন না সুভাষও। কংগ্রেসে থেকে আলাদা করে ফরওয়ার্ড ব্লক গঠনের পরেই সে বছরের ১১ অগাস্ট তাঁকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। ১৯৩৯-এর যে ত্রিপুরী কংগ্রেসের অধিবেশন নিয়ে সুভাষ-গান্ধীর সম্পর্কে অভিঘাত এল, সেখানে দেশবন্ধুকে রাজনৈতিক গুরু হিসেবে স্মরণ করে, সভাপতি হিসেবে বক্তব্য পেশ করছেন সুভাষ। বলছেন, A somewhat similar situation had risen at the time of Gaya Congress in 1922 and thereafter when Deshbandhu Das and Pandit Motilal Nehru of halloneed memory started the Swaraj Party. May the spirit of my late Guru and the other great sons of India inspire us in the present crisis…।
আরও পড়ুন-পাড়ায় সমাধানের সাফল্য দক্ষিণ হাওড়ায়
সুভাষ যে প্রথমে চিত্তরঞ্জনের কাছে এসেছিলেন তা কিন্তু নয়। বরং আইসিএস ছেড়ে দেশে ফিরে বম্বেতে নেমেই তিনি ছুটলেন গান্ধীজির সঙ্গে দেখা করতে। তিনি তখন বম্বের মণি ভবনে।। গান্ধীজির কাছে বারবার ৩টি প্রশ্ন করেছিলেন সুভাষ, যার মধ্যে ২টি ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ ছিল : ১. কংগ্রেসের আগামী দিনের পথ; ২. দেশের স্বাধীনতা কোন পথে আসবে। সুভাষ বলছেন, তিনি গান্ধীজিকে একাধিকবার প্রশ্ন করেও ফল না পেয়ে হতাশ হয়ে বম্বে থেকে যখন কলকাতা আসছেন, ভাবছেন, গান্ধীজি যে পথ দেখাতে পারলেন না, চিত্তরঞ্জনের পক্ষে কি সেই পথ দেখানো আদৌ সম্ভব! এরপর মূলত বাসন্তীদেবীর সাহায্যেই দ্রুত দেশবন্ধুর সাক্ষাৎ পেলেন সুভাষ। প্রথম সাক্ষাতের বিবরণ দিচ্ছেন এইভাবে— বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমায় বহিষ্কার করার পর কলকাতার নামকরা আইনজীবীদের মধ্যে বিখ্যাত চিত্তরঞ্জনের কাছে একবার এসেছিলাম। তখন তিনি দিনে অন্তত ১০০০ টাকা উপার্জন করতেন, আবার পরক্ষণেই সেই টাকাই খরচ করে ফেলতেন। আজ দেখলাম যেন এক অন্য মহাপুরুষকে। ইনি তরুণের বন্ধু। এরকম একজনকেই তো নেতা হিসেবে খুঁজছিলাম। আজ এক যথার্থ নেতার সন্ধান পেয়েছি। তাঁকেই আজীবন অনুসরণ করব ঠিক করলাম। সুভাষ লিখছেন, By the time our conversation came to end, my mind was made up. I felt that I had found a leader and I meant to follow him.
আরও পড়ুন-স্মৃতি রক্ষায় লাল-হলুদের উদ্যোগ সুভাষের মূর্তি সংগ্রশালায়
দেশবন্ধুর হাত ধরেই সুভাষের প্রথম প্রকাশ্য জনসভায় বক্তব্য রাখতে শুরু করা। ১৯২১-এর ২২ অগাস্ট। কলেজ স্কোয়্যারে এক মঞ্চে সেদিন বছর ৪০-এর গুরুর সঙ্গে ২৪ বছরের শিষ্যর যৌথ ভাষণ। বলতে গেলে, কলকাতা পুরসভা এলাকায় সুভাষের এই প্রথম ভাষণ। শিষ্যকে এগিয়ে দিচ্ছেন, পথ দেখাচ্ছেন এক রাজনৈতিক গুরু। সভার মূল বিষয় ২টি : ১. প্রিন্স অফ ওয়েলস কলকাতায় আসছেন এবং কলকাতা পুরসভা তাঁকে সংবর্ধনা দেওয়ার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তার বিরোধিতা করা; ২. এই বিষয়ে কলকাতার নাগরিকদের কী কর্তব্য, তা বোঝানোর চেষ্টা করা। পরবর্তীকালে ১৯২৪-এর এপ্রিলে, সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জিকে পরাজিত করে চিত্তরঞ্জন যখন কলকাতার মেয়র হচ্ছেন, প্রিয় সুভাষকেই পুরসভার চিফ এগজিকিউটিভ করে পাশে ডেকে নিলেন তিনি। মূলত দেশবন্ধু-সুভাষের উদ্যোগেই পুরসভা থেকে কলকাতা মিউনিসিপ্যাল গেজেট নামে একটি সাপ্তাহিক কাগজ বেরতে শুরু করল, যেখানে শহরের মানুষের সমস্যা ও সমাধানের কথা লেখা থাকত।
আরও পড়ুন-আলবিদা সুভাষ
বিলাসিতা ছেড়ে কীভাবে প্রকৃত বিপ্লবীর জীবন এগিয়ে নিয়ে যেতে হয়, সেটাও গুরুর কাছেই শিখেছিলেন সুভাষ। নাগপুর কংগ্রেস। প্রবল বিলাসিতা, গড়গড়া টানার বিলাসময় জীবন ছেড়ে দেশবন্ধু কীভাবে একদিনেই মোটা খাটো খদ্দরের ধুতি-ফতুয়ার দিনলিপিতে ঢুকে পড়েছিলেন, চোখের সামনে প্রত্যক্ষ করেছিলেন শিষ্য। শুধু গুরু নয়, গুরুপত্নী বাসন্তীদেবীও কীভাবে মিহি শান্তিপুরি শাড়ি ছেড়ে মোটা খদ্দরের জীবন বেছে নিলেন, দেখেছেন সুভাষ। আর তাতে গুরুর প্রতি শ্রদ্ধা অনেকটাই বেড়েছে বই কমেনি।
আরও পড়ুন-নয়া সংসদ ভবন তৈরির খরচ বাড়ল ২৯%
১৯২৪-এর ২৫ অক্টোবর। বেঙ্গল অর্ডিন্যান্স আইনের প্রয়োগ করে গ্রেফতার করা হল শিষ্য সুভাষকে। তিনি তখন পুরসভার চিফ এগজিকিউটিভ। অর্ডিন্যান্স জারির কারণ দেখিয়ে সরকার বলল, দেশ বিপ্লবীতে ভরে গিয়েছে। তারা দেশের উন্নতিতে বাধা দিচ্ছে। তাদের হাত থেকে দেশকে উদ্ধার করতে সহৃদয় সরকার এই অর্ডিন্যান্স জারি করেছে। এদিকে, আমলাতন্ত্রের কবলে নিজের শিষ্যকে পড়তে দেখে গর্জে উঠলেন চিত্তরঞ্জন। ব্রিটিশদের সঙ্গে যেন সরাসরি যুদ্ধ ঘোষণা করলেন তিনি। তেজোময় বক্তৃতায় বললেন, ওঁরা সুভাষকে ধরেছে! এবার গভর্নমেন্টকে কাঁপিয়ে দেব। সুভাষ তো আমারই মতো বিপ্লবী। সুভাষ যদি গ্রেফতার হয়, আমাকেও গ্রেফতার করা হচ্ছে না কেন! দেশকে ভালবাসা যদি আইন ভাঙার মতো অপরাধ বলে ধরা হয়, তা হলে তাতে তো আমিও সমান অপরাধী! এই কর্পোরেশনের প্রধান কর্মাধ্যক্ষ হিসেবে শুধু সুভাষ তো অপরাধী নয়, তার মেয়রও সমানভাবেই অপরাধী। ব্রিটিশরা মেয়রকে ধরছে না কেন! প্রিয় শিষ্য সুভাষকে এতটাই ভালবাসতেন গুরু চিত্তরঞ্জন। গবেষকরা দ্ব্যর্থ ভাষায় বলেন : সেদিন যদি দেশবন্ধুর দেখানো পথে নেতাজির হাতে দেশকে এগোতে দেওয়া হত, অনেকদিন আগেই আমরা প্রকৃত স্বরাজ পেতাম। আর ভারতকেও টুকরো করে স্বাধীনতা পেতে হত না।