এটা খুব বলতে শোনা যায় যে মেয়েরা মাল্টিটাস্কার। তাঁরা দশভুজা, জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ সব পারেন। আসলে বিষয়টা ভুল। সুপার উইমেন বলে কিছু হয় না। জানেন কি মনোবিদেরা বলছেন মাল্টিটাস্কিং মোটেই ভাল না! মাল্টিটাস্কে কোনও কাজেই আদতে মন বসে না। বরং বেশি বেশি অ্যাড্রিনালিন হরমোন ক্ষরণ করে মানসিক চাপ বাড়ায়। কী নারী, কী পুরুষ মানসিক চাপ, স্ট্রেস, অ্যাংজাইটি ভাল না। নিউ নর্মাল যুগে পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে কম-বেশি সকলকেই বেগ পেতে হয়েছে। নানারকম প্রতিকূলতার সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে বিপর্যস্ত হয় মানসিক স্বাস্থ্যও। পরিসংখ্যান বলছে পৃথিবীতে মৃত্যুর দ্বিতীয় বৃহত্তম কারণ আত্মহত্যা। করোনা-পরবর্তী বিশ্বের সব থেকে বড় অতিমারি এখন মানসিক অবসাদ। করোনার আগে বিশ্বে প্রতি ৪০ সেকেন্ডে এক জন আত্মহত্যা করতেন। এখন সেই সময়ের ব্যবধান কমে হয়েছে ৩৪ সেকেন্ড। তাই মনকে সুস্থ রাখা এবং সেই সম্পর্কে সচেতন হওয়ার অধিকার সকলের রয়েছে
তাই ইদানীং মহিলাদের মুখেও ধোঁয়ার সুখটান। ধূমপান না করলে নাকি এখন আর ঘরে-বাইরে স্ট্রেস-ফ্রি হওয়া অসম্ভব। ধূমপানে নারী-পুরুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলছেন। কিন্তু সিগারেটের সেই সুখটান যে এক দিন দুখটান হয়ে যেতে পারে এটা ভাবেন ক’জন। তাৎক্ষণিক স্ট্রেস কমালেও ধূমপান পাঁজরাকে ঝাঝরা করে দেয় নিঃশব্দেই, হ্রাস পায় মেয়েদের প্রজনন ক্ষমতা। স্ট্রেস বাড়াতে এর জুড়ি নেই। এই কথা বলছি তার কারণ, মে শুধু মানসিক স্বাস্থ্য, সচেতনতা মাস নয়, ৩১ মে হল ‘ওয়র্ল্ড নো টোব্যাগো ডে’। তাই মানসিক স্বাস্থ্য উন্নত করতে যে কোনও নেশাই পরিহার করুন।
মনকে চাপমুক্ত রাখা যার প্রথম ধাপ হল শারীরিক সুস্থতা। শুগার, প্রেশার নেই তো? কোলেস্টেরল? বদহজম, গ্যাস অম্বলের সমস্যা? ওজন নিয়ন্ত্রণে আছে তো? পায়ে ব্যথা, কোমরে ব্যথা, মাথায় ব্যথা, কোন বাজে নেশা— এ-সবগুলো নেই তো? উত্তরে খুব হাতগোনা মানুষই বলবেন নেই। আসলে মানসিক স্বাস্থ্য মানে হল সুস্থ শরীর। তাই বয়স ৩৫-এর উপর হলে দরকার প্রতিমাসে একটা সম্পূর্ণ হেল্থ চেক-আপ। তার কম হলে তিনমাস অন্তর। মনিটরিং মাস্ট। দেখে নিন এবং সেইমতো চিকিৎসা শুরু করুন। ওষুধ খেতে অনীহা করবেন না।
আট ঘণ্টা ঘুম খুব জরুরি। সকালে ঘুম থেকে উঠে জানালা দিয়ে বাইরে সবুজ বা বাগানের সবুজের দিকে তাকিয়ে থাকুন। এটা আমাদের চোখ এবং মস্তিষ্ককে আরাম দেয়। তারপর এক গ্লাস হালকা গরম জলে এক চামচ মধু দিয়ে খান। না হলে শুধু গরম জলই খান। পেট পরিষ্কার হলে মনটাও ঝরঝরে থাকবে। বাওয়েল ক্লিয়ার থাকে না বলেই শরীরের ওজন বেশি দেখায়। এই সময়টাই আপনার প্রাণায়াম আর যোগাসনের জন্য আদর্শ। দশ থেকে পনেরো মিনিট বসা যেতেই পারে।
মন ভাল রাখতে চিকিৎসকেরা ‘স্ক্রিন টাইম’ কমিয়ে ‘গ্রিন টাইম’ বাড়িয়ে তুলতে বলেছেন সবসময়। এতে মানসিক চাপ, উদ্বেগ, অবসাদ কেটে যায়। তবে নতুন গবেষণা বলছে, মানসিক স্বাস্থ্য উন্নত করতে ‘গ্রিন টাইম’-এর তুলনায় ‘ব্লু স্পেসেস’ আরও বেশি উপকারী। অর্থাৎ, প্রকৃতির সবুজ গাছপালা, জঙ্গলের চেয়েও বেশি কার্যকরী হল সমুদ্রের জল বা নদীর জল, হ্রদের জল। কারণ সেই জলের বহমানতা। অনবরত সমুদ্রের গর্জন কানে গেলেও কিন্তু মন শান্ত হয়। অবিরাম ঢেউয়ের যে ছন্দ তা মনের জন্য আরামদায়ক। তাই অনেকদিন ধরে কাজের চাপ নিতে থাকার পর একটা ছোট্ট ব্রেক নিয়ে সমুদ্রে বেড়িয়ে আসতে পারেন।
কোনও একটা কাজ একা একটানা মনোনিবেশ করাই কিন্তু মেডিটেশন। সে বইপড়া হোক বা বাগানে গাছপালার যত্ন নেওয়া বা ছবি আঁকা। এই নিবিড় মনঃসংযোগটাই আপনাকে রিল্যাক্স করবে। দেখবেন রাজ্যের চিন্তা তখন মাথাতেই নেই। তাই ধ্যান করার সময় না থাকলে এইভাবে ভাল থাকতে পারেন।
গৃহিণীসুলভ মাল্টিটাস্কিং ছেড়ে বরং একটা কাজ সেরে নিয়ে অন্য কাজে হাত দিন। মস্তিষ্ক যেন একটা সময় একটা দিকেই নজর দিতে পারে। এতে প্রথমেই যেটা হবে অ্যাড্রিনালিন ক্ষরণ কমবে আর সঙ্গে সঙ্গে চাপটাও কমতে থাকবে।
হতেই পারে সকালে ব্যায়ামের সময় নেই। হেঁটে দোকান-বাজার করুন। চাকরিরতা হলে চেষ্টা করুন হেঁটে বেশ খানিকটা গিয়ে বাস-ট্রাম-ট্রেন ধরতে। সাইকেল চালাতে জানলে বেরিয়ে পড়ুন। এগুলোও ব্যায়াম।
একটানা কম্পিউটারে থাকলে দু-ঘণ্টা পর-পর চোখ বন্ধ করে হাতের তালু আলতো করে চোখে চেপে ধরুন আর ছাড়ুন— এরকম দশবার করুন। একটু চোখ-মুখে জলের ঝাপ্টা দিন।
কেবলমাত্র দায়দায়িত্ব বা কাজকর্ম থেকেই যে মানসিক চাপ তৈরি হয় তা নয়, চারপাশের সম্পর্কগুলি থেকেও প্রচণ্ড অস্থিরতা ও উদ্বেগ তৈরি হতে পারে। ধরুন সহকর্মী বা বসের সঙ্গে ঝামেলা অথবা পরিবারের ঘনিষ্ঠ মানুষগুলির সঙ্গে সম্পর্কের রসায়ন মনের উপর প্রচণ্ড প্রভাব ফেলে। এদের বাদ দিয়ে কিন্তু আমাদের জীবন নয় কাজেই যে-কোনও সম্পর্কে সমস্যা তৈরি হলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সমাধানের চেষ্টা করুন৷ এটাও মানসিক স্বাস্থ্য ভাল রাখার বড় একটা উপায়।
সারাক্ষণ অন্যের দিকে তাকিয়ে কষ্ট পাবেন না। একটা কথা জানবেন আপনার প্রাপ্যটুকুই পাচ্ছেন। যা পাচ্ছেন না তা আপনার নয়। ঈর্ষা জাগলে সাবধান৷ ঈর্ষা, জটিলতা আপনার উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তার বড় কারণ৷
মনের কথা কারও কাছে খুলে বললেও কষ্ট কমতে পারে। কাউন্সিলিংয়ের প্রয়োজন হলে লজ্জার কিছু নেই খোলাখুলি মনোবিদের পরামর্শ নিন। আলোচনাতেই সমাধান মেলে। এতে আখেরে আপনার লাভ।
মন ভাল রাখতে
অনেক শিক্ষিত, সচেতন মানুষও নিজের মানসিক অবসাদের কথা বুঝতে পেরেও চিকিৎসকের কাছে যান না। শরীরের মতোই মনেরও কিন্তু অসুখ হতে পারে। তার চিকিৎসা জরুরি। তাই মনের স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে মে-তে পালিত হয় ‘বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা মাস’। লিখছেন শর্মিষ্ঠা ঘোষ চক্রবর্তী
