‘আমার কাছে মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ে সাধারণ মানুষের দাম অনেক’

Must read

শাওনী দত্ত
উত্তরপ্রদেশে মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথই নাকি শেষ কথা! প্রশাসনিকভাবে সাধারণ মানুষের জীবনরক্ষা বা নারীর সম্মান রক্ষায় তাঁর সেই ভূমিকা অবশ্য দেখা যায় না। তবে কড়া প্রতিদ্বন্দ্বীর মুখে পড়লে উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীও যে সাধারণ মানুষের পর্যায়ে নেমে আসতে বাধ্য, তা দেখিয়ে দিয়েছেন একজন বাঙালি। উত্তরপ্রদেশের মতো রাজ্যে থেকেও নিজের সততা ও নিষ্ঠার জোরে খোদ মুখ্যমন্ত্রীর আর্জিও ফিরিয়ে দিয়েছিলেন বাঙালি চিকিৎসক তপনকুমার লাহিড়ী (Tapan Kumar Lahiri)। কারণ তাঁর কাছে হেভিওয়েট মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ে সাধারণ মানুষের দাম কোনও অংশে কম নয়। একসময় বিদেশের হাসপাতালে লক্ষ লক্ষ ডলার রোজগারের হাতছানি ছিল, ছিল আয়েশি জীবনের সুযোগ। কিন্তু সেইসব কিছুকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে বেনারসের গলিতে গলিতে আজও জীবন্ত ভগবান ডাঃ তপনকুমার লাহিড়ী। ৮৩ বছর বয়সের এই বাঙালি চিকিৎসক আজও হাতে কালো ছাতা আর কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে প্রতিদিন নিয়ম করে পৌঁছে যান হাসপাতালে, লক্ষ্য একটাই— গরিব মানুষের সেবা। উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ একবার অসুস্থ হয়ে ডাঃ লাহিড়ীকে নিজের কাছে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু সাধারণ মানুষের এই প্রিয় ডাক্তারবাবু তখন সোজাসাপ্টা জানিয়ে দেন, অসুখ যখন আপনার, তখন রোগী হিসাবে আপনারই আমার কাছে আসা উচিত। আপনার কাছে যেতে যে সময় নষ্ট হবে, সেই সময়ে অন্তত পাঁচজন গরিব মানুষ বিনা চিকিৎসায় ফিরে যাবে।

১৯৪১ সালে কলকাতায় জন্ম নেওয়া তপনবাবুর ছোটবেলা কেটেছে অভাবের তাড়নায় সাধারণ মানুষের চিকিৎসা না পাওয়ার কষ্ট দেখে। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ থেকে ডাক্তারি পাশ করার পর পাড়ি দিয়েছিলেন ইংল্যান্ডে। ১৯৬৯ সালে এফআরসিএস এবং পরে থোরাসিক সার্জারিতে এমসিএইচ ডিগ্রি লাভ করেন। বিদেশে রাজকীয় মাইনের চাকরির প্রস্তাব থাকলেও ১৯৭২ সালে তিনি ফিরে আসেন দেশে। মাত্র ২৫০ টাকা বেতনে যোগ দেন বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটির ইনস্টিটিউট অফ মেডিক্যাল সায়েন্সে।

সারাজীবন মানব সেবা করতে গিয়ে নিজের ঘর বাঁধা হয়নি তাঁর। ডাক্তার লাহিড়ী (Tapan Kumar Lahiri) মনে করেন, সুস্থ হয়ে ওঠা রোগীর মুখের হাসিই তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার। একসময় তিনি সরকারি মাইনে নিতেও অস্বীকার করেন। ২০০৩ সালে অবসরের পর পেনশনের সিংহভাগ টাকা দান করে দেন বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিলে। বিনিময়ে তাঁর দাবি ছিল অতি সামান্য— সেখানের কোয়ার্টারে একটি ঘরে থাকতে দিতে হবে তাঁকে। নিজের যৎসামান্য প্রয়োজনটুকু বাদ দিয়ে বাকি সবটুকু বিলিয়ে দেন গরিবের সেবায়। অবসর নেওয়ার সাতদিনের মধ্যে বিদেশের পাঁচটি হাসপাতাল লক্ষাধিক টাকার প্যাকেজ অফার করে তাঁকে। কিন্তু তাতেও কান দেননি তিনি।

আরও পড়ুন-বাড়ি-বাড়ি গিয়ে ভোট হলে হিয়ারিং নয় কেন? ভার্চুয়াল বৈঠকে প্রশ্ন অভিষেকের

চিকিৎসাক্ষেত্রে তাঁর এই নিঃস্বার্থ অবদানের জন্য ভারত সরকার তাঁকে ‘পদ্মশ্রী’ সম্মানে ভূষিত করেছে। যদিও কোনও প্রচার বা সম্মানের প্রতি তাঁর কোনও মোহ নেই। অবসর নেওয়ার ২০ বছর পরেও তাঁর জন্মদিন ধুমধাম করে পালন করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। আজও প্রতি বছর ৩ জানুয়ারি তাঁর জন্মদিনে বেনারসের গঙ্গায় হাজার হাজার প্রদীপ ভাসান কৃতজ্ঞ রোগীরা। রোগীর মঙ্গল কামনায় যে চিকিৎসক জীবনের শেষ দিনটুকু কাটিয়ে যাচ্ছেন, তাঁর জন্য যখন তাঁর রোগীরাই মঙ্গল কামনা করেন, তার থেকে বড় প্রাপ্তি একজন চিকিৎসকের আর কীই-বা হতে পারে? তাতেই তৃপ্ত বেনারসের বাঙালি চিকিৎসক তপন কুমার লাহিড়ী।

Latest article