পরিসংখ্যান অনুযায়ী প্রতি ৫০ সেকেন্ডে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে একটি শিশুর মৃত্যু হয়। এই রোগে শিশুমৃত্যুর হারই বেশি। কী শিশু কী প্রাপ্তবয়স্ক, নিউমোনিয়ার চিকিৎসায় সামান্য অসতর্কতাও রোগীর মৃত্যুর কারণ হতে পারে। সর্বশেষ পরিসংখ্যান বলছে, বিশ্বজুড়ে শিশু এবং বয়স্ক মিলিয়ে এই রোগে মৃত্যু হয়েছে প্রায় ৩০ লক্ষেরও বেশি মানুষের। তাই প্রতি বছর ১২ নভেম্বর পৃথিবী জুড়ে পালিত হয় ‘বিশ্ব নিউমোনিয়া দিবস’। এই দিনটি উদযাপনের মূল উদ্দেশ্য রোগটি সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করা। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, সময়মতো নিউমোনিয়ার চিকিৎসা না হলে তা মারাত্মক মহামারীর আকার নিতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) রিপোর্ট অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী শিশুদের মৃত্যুর সবচেয়ে বড় সংক্রামক কারণ নিউমোনিয়া। প্রতি বছর এই বিশ্ব নিউমোনিয়া দিবসের একটি করে থিম থাকে। ২০২৪ এই দিনটি উদযাপনের থিম ছিল ‘Every Breath Counts : Stopping Pneumonia in Its Tracks’।
আরও পড়ুন-প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা করেই অর্থনৈতিক নীতি প্রণয়নে গুরুত্ব, আন্তর্জাতিক জলবায়ু সম্মেলন
নিউমোনিয়া কী
নিউমোনিয়া একটা জটিল সংক্রমণ যা ফুসফুসের বায়ুথলিগুলোকে আক্রমণ করে এবং ফুসফুসে সংক্রমণ ঘটায়। যার কারণে রোগীর শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। এই সংক্রমণ ফুসফুস থেকে দ্রুত সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রমণে নিউমোনিয়া হতে পারে।
স্ট্রেপ্টোকক্কাস নিউমোনি নামের ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ নিউমোনিয়া রোগের একটি অন্যতম প্রধান কারণ। এছাড়া ছত্রাকজনিত কারণেও নিউমোনিয়া হয়।
ফুসফুসের লোয়ার রেসপিরেটরি ট্র্যাক্টে যে সংক্রমণ তাকেই নিউমোনিয়া বলে। নিউমোনিয়াকে আগে বলা হত অ্যাকিউট রেসপিরেটরি ইনফেকশন বা এআরআই। নিউমোনিয়া হল বিশেষ করে শিশুদের ‘লিডিং কজ অফ ডেথ’। পাঁচবছরের নীচে যেসব শিশুর মৃত্যু হয় তার মধ্যে ২০% শিশুর মৃত্যুর কারণ নিউমোনিয়া। এই কুড়ি শতাংশের মধ্যে তিন-চতুর্থাংশ মৃত্যু ঘটে এশিয়া এবং আফ্রিকার মতো উন্নয়নশীল দেশগুলিতে। পাঁচ বছরের মধ্যে দু’বছরের নীচের শিশুর মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি। ন’মাস, ছ’মাস এবং তিনমাসের শিশুর সবচেয়ে বেশি সম্ভাবনা থাকে নিউমোনিয়ায় মৃত্যুর। একবছরের নীচে বয়স এমন শিশুদের প্রায় ২৫ থেকে ৩০ শতাংশের নিউমোনিয়া হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।
নিউমোনিয়ার উপসর্গ
নিউমোনিয়ার প্রাথমিক লক্ষণ হল জ্বর। তার সঙ্গে কাশি। পাশাপাশি, শ্বাসকষ্টও থাকে। সংক্রমণ যত বাড়ে, শ্বাসকষ্টও বাড়তে থাকে। বুকে ব্যথা হতে পারে। বুকের ব্যথার এই ধরন তবে একটু আলাদা। সাধারণত, গভীর শ্বাস নেওয়ার সময়ে এই বুকের ব্যথা অনুভূত হবে। ফুসফুসের প্রদাহের কারণে এই ব্যথা হয়। এছাড়া, মাথায় যন্ত্রণা, ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়া, খাওয়ায় অনীহা, সারাক্ষণ বমি বমি ভাবও আনুষঙ্গিক লক্ষণের মধ্যে পড়ে।
শিশুদের উপসর্গ
শিশুর ক্ষেত্রেও প্রাথমিক লক্ষণ ধুম জ্বর, কাশি, সর্দি। এটা কমন ভাইরাল ফিভারের লক্ষণ তাই এর সঙ্গে দেখতে হবে শিশুর শ্বাস নেওয়ার যে রেট পরিবর্তন তা হয়েছে কি না। ধরুন প্রাপ্তবয়স্করা শ্বাস নেয় ১২টা থেকে ১৬টা। একটি শিশু বিভিন্ন বয়স অনুযায়ী বিভিন্ন নম্বরে শ্বাস নেয়। মোটামুটি মিনিটে পঞ্চাশটা। একটু লক্ষ্য করলেই বোঝা যাবে শিশুটি এর চেয়ে বেশি শ্বাস নিচ্ছে অর্থাৎ হাঁপাচ্ছে। এছাড়া স্ট্রাগল ব্রিদিং অর্থাৎ কষ্ট করে শ্বাস নিচ্ছে। বুকের ও পেটের সংযোগস্থলে পাঁজরের নীচটা ভিতর দিকে ঢুকে ঢুকে যাচ্ছে, একে বলে চেস্ট ইনড্রয়িং। আর একটি উপসর্গ হল শ্বাস নেওয়ার কাজ আশি শতাংশ করে ডায়াফ্রাম। দেখা যাবে ডায়াফ্রাম ওই শ্বাসবায়ুকে সাপোর্ট করছে না। শরীরে অনেক মাসল দিয়ে শিশু শ্বাস নিচ্ছে এবং নাকের পাটার অংশ ফুলে ফুলে উঠছে। একে বলা হয় অ্যালিন্যাজাল ফ্লেয়ারিং। এছাড়া টেনে টেনে শ্বাস নেওয়া, রেস্টলেস ভাব, একটানা কেঁদে চলা ইত্যাদি।
আরও পড়ুন-মহিলা নিরাপত্তা নিয়ে মোদি সরকারকে তুলোধোনা তৃণমূলের, কাকলির প্রশ্নে ল্যাজেগোবরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক
ঠান্ডা লাগলেই কি নিউমোনিয়া হতে পারে
শীতকালে তাপমাত্রা কম থাকায় উপযুক্ত আবহাওয়া পেয়ে নিউমোনিয়া সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়া কিংবা ভাইরাস আরও বেশি সক্রিয় হয়ে ওঠে। সামান্য ঠান্ডা লাগা থেকেও কেউ কেউ নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হতে পারেন। তবে সকলেই যে সামান্য ঠান্ডা লাগলেই নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হবেন তা নয়। যাঁদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তুলনামূলক বেশি, তাঁদের ক্ষেত্রে সামান্য ঠান্ডা লাগা থেকে নিউমোনিয়া সাধারণত হয় না।
তবে যাঁদের প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল, বিশেষ করে শিশু কিংবা প্রবীণ মানুষের ক্ষেত্রে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশ বেশিই।
কখন গুরুতর
রোগীর জ্বর কমতেই চাইছে না। শ্বাসকষ্ট বাড়ছে। বুকে বেশ ব্যথা। কাশির সঙ্গে কফ উঠছে এবং কফে অল্প রক্তও মিশে থাকতে পারে। রোগী স্বাভাবিক থাকছে না বেশির ভাগ সময় ঝিমিয়ে পড়ছে। শিশু এবং বয়স্ক উভয় ক্ষেত্রেই জ্বর এবং স্যাচুরেশন দেখতে হবে। যদি দেখা যায় ৯৫-এর কম তখন দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
রোগনির্ণয়
অবস্থা গুরুতর হলে দ্রুত চিকিৎসকের কাছে যান। অনেক সময় এক্স-রে, সিটি স্ক্যান করে দেখা হয়। তবে রোগী বিশেষে কী ধরনের পরীক্ষা করতে হবে, সেটা চিকিৎসকই ঠিক করতে পারবেন। নিউমোনিয়া হলে রোগীকে পরিমিত জল খাওয়ানো উচিত। জলশূন্যতা বা ডিহাইড্রেশন নিউমোনিয়া রোগীর জন্য খারাপ। সময়মতো চিকিৎসা শুরু হলে জটিলতা বাড়ার সম্ভাবনা অনেকটাই কমে।
আরও পড়ুন-উপনির্বাচনের আগেই তৃণমূলের তুমুল সাফল্য, কাঁথিতে সমবায় নির্বাচনে সবুজ-ঝড়
বয়স্কদের সতর্কতা
বয়স্ক ব্যক্তিদেরও ঠান্ডা লাগানো একেবারেই চলবে না। শরীর সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে। উপসর্গের দেখা দিলেই দেরি না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। এছাড়া, কেউ যদি অপুষ্টিতে ভোগেন, কিংবা যদি কোনও ব্যক্তির আগে থেকেই ফুসফুসে কোনও সমস্যা থাকে, তাঁদের আরও বেশি সাবধানে থাকা দরকার।
টিকা
নিউমোনিয়া প্রতিরোধক টিকা রয়েছে। এই ধরনের টিকা দু’ভাবে নেওয়া যেতে পারে। বছরে একবার নেওয়া যেতে পারে এবং পাঁচ বছর অন্তর নেওয়া যেতে পারে। একে ‘বুস্টার ডোজ’ বলা হয়। বাচ্চাদের ক্ষেত্রে নিউমোনিয়ার টিকা আগাম রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরির জন্য দেওয়া হয়। তবে সব ক্ষেত্রেই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া দরকার।