আরতি, সুব্রতর সংসার
নিউ ভারত ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্টেন্ট সুব্রত মজুমদার সংসদ চালাতে হিমশিম খান। বাড়িতে আছেন বাবা যিনি অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক, মা, স্ত্রী আরতি, বোন, ছেলে। এদের প্রত্যেকের নানান ধরনের চাহিদা আছে অথচ মাস গেলে হাতে পান মাত্র আড়াইশো টাকা। স্বামীর বোঝা হালকা করার জন্য আরতি চাকরির দরখাস্ত করেন। শ্বশুরমশাই মেনে নিতে পারেন না। তবু আরতি চাকরি শুরু করে। আরতির এই পরিবর্তন সুব্রতর কাছেও ভাল লাগে না। আরতিকে চাকরি ছেড়ে দেওয়ার পরামর্শ দেয়। পরের দিন আরতি তার পদত্যাগপত্র নিয়ে অফিসে যায়। কিন্তু হঠাৎ আরতির কাছে সুব্রতের ফোন আসে ‘আরতি তুমি চাকরি ছেড়ো না। আমাদের ব্যাঙ্ক ফেল পড়েছে। আমি এখন বেকার।’ কীভাবে সেই আরতি ও সুব্রত আবার তাঁদের ভাঙা সংসারটা জোড়া লাগাবে সেই নিয়ে গল্প লিখলেন নরেন্দ্রনাথ মিত্র। কাহিনির নাম ‘অবতারণিকা’। বিশ্ববন্দিত পরিচালক সত্যজিৎ রায় সেই গল্প নিয়ে ছবি করলেন। নাম দিলেন ‘মহানগর’। সুব্রত ও আরতির চরিত্রে অভিনয় করলেন অনিল চট্টোপাধ্যায় (Anil Chatterjee) এবং মাধবী মুখোপাধ্যায়। দুজনেই দাপটের সঙ্গে অভিনয় করলেন। সুব্রতর চরিত্রের নানান দিক অনিল চট্টোপাধ্যায় নিখুঁতভাবে তুলে ধরলেন এ ছবিতে। বার্লিন ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে এবং মেক্সিকোর একাপুলকো ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে তিনি সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে সংবর্ধিত হলেন।
সংগ্রামের কথা
আজীবন পড়াশোনায় তুখড় অনিল চট্টোপাধ্যায় (Anil Chatterjee) সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে ইকনমিক্সে অনার্স নিয়ে গ্র্যাজুয়েট হওয়ার পর চাকরির জগতে এলেন। জার্মান কোলাবরেশনের একটি ফার্মে তখনকার দিনে ৮০০ টাকা মাইনের চাকরিতে ঢুকলেন। কিন্তু ভাল লাগল না বলে চাকরি ছাড়লেন। আকাশবাণীতে ঘোষক পদের ইন্টারভিউ দিলেন। প্রথম হলেন তিনি। দ্বিতীয় হলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। একটাই পদ। সৌমিত্রের জন্য অনিল এই চাকরিতে ঢুকলেনই না! ভাবা যায় আজকের দিনে? স্বর্ণযুগের স্বনামধন্য পরিচালক অর্ধেন্দু মুখোপাধ্যায়ের সহকারী হিসেবে ঢুকলেন ছবির জগতে। বেতন ৫০ টাকা। তখন কিন্তু তিনি বিবাহিত।
ছোট্ট ছোট্ট পায়ে
অভিনয়ের পূর্বে কিছু অভিজ্ঞতা ছিল। সেন্ট জেভিয়ার্সে পড়াকালীন উৎপল দত্ত পরিচালিত কয়েকটি নাটকে অভিনয় করেছিলেন। কিন্তু ছবিতে প্রবেশ আকস্মিক। নির্ধারিত শিল্পীর অনুপস্থিতিতে পিনাকী মুখোপাধ্যায়ের ‘যোগ-বিয়োগ’ ছবিতে ছোট্ট একটি চরিত্রে পরিচালকের নির্দেশে অভিনয় করলেন। সঙ্গে ছবি বিশ্বাস ও তুলসী চক্রবর্তীর মতো ডাকসাইটে দুই শিল্পী ছিলেন। প্রত্যেকটা শট ‘ওকে’। একটাও ‘এনজি’ হল না। দুই শিল্পী মুগ্ধ হলেন। এইভাবে ছোট ছোট চরিত্রে তাঁর প্রবেশাধিকার ঘটল অভিনেতা হিসেবে। ঢুলি, সাজঘর, চলাচল, নাগরিক, অযান্ত্রিক, রাজলক্ষ্মী শ্রীকান্ত, মরুতীর্থ হিংলাজ, দীপ জ্বেলে যাই প্রভৃতি ছবিতে ছোট ছোট চরিত্রে দর্শকদের নজর কাড়তে শুরু করলেন।
যখন তিনি নায়ক
নরেশ মিত্র পরিচালিত ‘উল্কা’ ছবিতে প্রথম নায়ক সুধীরের চরিত্রে। এক এক করে আহ্বান, পোস্টমাস্টার, আগুন, বন্ধন, শেষ চিহ্ন, কুমারী মন, রক্ত পলাশ, দুই বাড়ি, বর্ণচোরা, নির্জন সৈকতে, মহানগর, কোমল গান্ধার, কালস্রোত, জয়া, সিঁদুরে মেঘ প্রভৃতি ছবিতে। পাশাপাশি চরিত্রাভিনয়ে সবাইকে চমকে দিয়ে অভিনয় করলেন ঋত্বিক ঘটক পরিচালিত ‘মেঘে ঢাকা তারা’ ছবিতে নায়িকা নীতার (সুপ্রিয়া দেবী) দাদা শঙ্করের চরিত্রে। ‘সন্ধ্যা দীপের শিখা’ ছবিতে আফতাবের চরিত্রের শিল্পী, বড় কাছের মানুষ। ‘দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন’ ছবিতে তিনি নামভূমিকায় অনবদ্য অভিনয় করলেন। দেশবন্ধুর স্ত্রী বাসন্তীদেবী মুগ্ধ হয়েছিলেন সেই অভিনয় দেখে। কিন্তু শ্রেষ্ঠ অভিনেতার রাষ্ট্রপতি পুরস্কার একটুর জন্য ছিটকে গেল। অশোককুমার পেয়েছিলেন হিন্দি ‘আশীর্বাদ’ ছবির জন্য। ‘অমানুষ’ ছবিতে তিনি দাপুটে দারোগা ভুবন রায়।
আরও পড়ুন: রক্ত-মাখানো ভাতের স্মৃতি, সিপিএমের রাজনীতি
ভিলেন চরিত্রেও সাবলীল
তাঁর শ্রেষ্ঠ নিদর্শন ‘সাগিনা মাহাতো’ ছবিতে অনিরুদ্ধের চরিত্রে। সাগিনার (দিলীপকুমার) সংগ্রামকে ব্যর্থ করে দেওয়ার জন্য তাঁর আবির্ভাব। ‘অগ্নিসংস্কার’ ছবিতে পাক্কা ভিলেন। ‘আলোর ঠিকানা’ ছবিতে অসৎ, লোভী চরিত্রে। ‘আমি সে ও সখা’ ছবিতে সখারূপে নার্সিংহোমে নানান রকম অপকর্মে তিনিই লিপ্ত ছিলেন। ‘সব্যসাচী’ ছবিতে দেশপ্রেমিক সব্যসাচীর (উত্তমকুমার) নানান প্ল্যান ভেস্তে দেওয়ার কাজে তিনি সক্রিয়।
মাতিয়েছিলেন হিন্দি দর্শকদেরও
বোম্বেতে প্রথম তাঁকে নিয়ে গেলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। ‘রক্তপলাশ’ ছবির হিন্দি রিমেক ‘ফারার’ ছবির নায়ক তিনি। ছবি অবশ্য জমেনি। ‘সন্নাটা’ ছবিও জমল না। মৃণাল সেন অনিল চ্যাটার্জিকে প্রথমবারের জন্য নিলেন ‘একদিন আচানক’ ছবিতে (একদিন প্রতিদিনের হিন্দি)। অসাধারণ অভিনয় প্রদর্শন করলেন অরুণবাবুর চরিত্রে। অমল পালেকার ‘আঁখে’ ছবি এবং তাঁর হিন্দি সিরিয়াল ‘নকাভ’-এ তিনি অভিনয় করেন। তপন সিংহের ‘এক ডক্টর কি মৌত’ এবং ‘আজকি রবিনহুড’ ছবি দুটিতে তিনি মুখ্য অভিনেতা। গৌতম ঘোষের ‘পার’ ছবিতেও তিনি অসাধারণ অভিনয় করলেন।
অনবদ্য সহশিল্পী
অনিল চট্টোপাধ্যায়ের (Anil Chatterjee) সঙ্গে প্রথম কাজ করার সুযোগ আসে ‘বৌদি’ ছবিতে। দ্বিতীয় কাজ ‘তীরভূমি’ ছবিতে। আমার দিদির চরিত্রে ছিলেন মাধবী মুখোপাধ্যায়। তাঁর স্বামীর চরিত্রে তিনি। ‘দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন’। ছবিতে আমি তাঁর ছোট ভাই বরদারঞ্জনের চরিত্রে। তাঁর এমন অমায়িক ব্যবহার ভোলার নয়।
অনিল চট্টোপাধ্যায় প্রথম বিধায়ক রূপে কলকাতার বিধানসভাতে প্রবেশ করতে পেরেছিলেন ১৯৯১ সালে। ১৯৯৬ সালের ১৭ মার্চ তিনি আমাদের ছেড়ে চলে যান।