কালীপুজোর পরে ভাইফোঁটা। বাঙালিদের প্রাণের উৎসব। এই বিশেষ দিনের অপেক্ষায় থাকেন হিন্দু পরিবারের প্রত্যেক ভাই-বোন। মঙ্গল কামনায় ভাইয়ের কপালে ফোঁটা দেন বোনেরা। তারপর? প্রণাম, আশীর্বাদ, উপহার, পেটপুজো, আড্ডা। হইহই করে কেটে যায় দিনটি। সাধারণ মানুষের পাশাপাশি এই উৎসবে মেতে ওঠেন সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিশিষ্টরাও।
আরও পড়ুন-ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে প্রথম ৪ বঙ্গনারী
কিংবদন্তি অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় নিয়মিত ভাইফোঁটা নিতেন বোনের কাছে। আশীর্বাদে ভরিয়ে দিয়ে বোনের হাতে তুলে দিতেন উপহার। একসঙ্গে জমিয়ে খাওয়া দাওয়া করতেন। ‘অপরাজিত’ নায়ক গতবছর ভাইফোঁটার আগের দিন চিরবিদায় নিয়েছেন। শোকের আবহে বন্ধ ছিল পরিবারের এই উৎসব।
জানালেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কন্যা মঞ্চ-অভিনেত্রী ও পরিচালক পৌলমী চট্টোপাধ্যায়। পৌলমীও মেতে ওঠেন ভাইফোঁটা উৎসবে। কথায় কথায় বললেন, ‘‘গতবছর আমরা ভাইফোঁটা উদযাপন করতে পারিনি। কারণ আগের দিন বাবা আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। তবে অন্যান্য বছর রীতিমতো হইচই করে আমরা দিনটা কাটাই। আমি ফোঁটা দিই আমার দাদা সৌগত চট্টোপাধ্যায়কে। দাদা আমাকে প্রতিবছর বই উপহার দেন। আমি উপহার দিই টি-শার্ট অথবা শার্ট। ভাইফোঁটা উপলক্ষে জমজমাট খাওয়া দাওয়ার আয়োজন করা হয়। আমার ছেলে রণদীপ এবং মেয়ে মেখলার মধ্যে বয়সের ব্যবধান মাত্র দুই। তারা বন্ধুর মতো। দু’জনের মধ্যে দারুণ বন্ডিং। প্রতিবছর আমার মেয়ে তার দাদাকে ফোঁটা দেয়। বাবা যতদিন ছিলেন, আমার পিসি বাবা এবং কাকাকে ফোঁটা দিতেন। বাবা ভালবাসতেন পারসে মাছ। আজ বাবা নেই। তাই পিসি ফোঁটা দেবেন শুধু কাকাকে। আমার মেয়ে তার দাদুকে অর্থাৎ আমার বাবাকে ফোঁটা দিত। ছোটবেলায় দেখেছি, মা ফোঁটা দিতেন আমার মামাদের। ভাইফোঁটায় আমরা একবেলা মামার বাড়ি, একবেলা পিসির বাড়ি যেতাম। খুব আনন্দ হত। সেই দিনগুলো আর ফিরে আসবে না। গতবছর বাবা চলে যাবার পরপরই চলে গেলেন মা।”
এইবছর দিনটি কীভাবে সেলিব্রেট করবেন? পৌলমী জানালেন, ‘‘এইবছর আমরা সল্টলেকে মামাতো ভাইয়ের বাড়িতে ভাইফোঁটা সেলিব্রেট করব। আমার মাসতুতো বোন যাবে। দাদাও যাবেন। এবারের রান্নার পরিকল্পনা করেছে আমার মামাতো ভাইয়ের বউ। খাবার তালিকায় আছে মাংস, চিংড়ি, মিষ্টি ইত্যাদি। আমার দাদা মাংস খেতে খুব ভালবাসেন। ভাই-বোন মিলে জমজমাট আড্ডা হবে। সঙ্গে গান-কবিতা। দাদা খুব ভাল কবিতা লেখেন। তাঁকে বলব কবিতা শোনাতে। আমার মাসতুতো বোন, মামাতো ভাই আমার মতো থিয়েটার ভালবাসে। যদিও তারা থিয়েটার করে না। হবে থিয়েটারের গল্প। আড্ডায় মা-বাবার কথা বারবার ফিরে ফিরে আসবে। আগে যখন আমাদের বাড়িতে ভাইফোঁটার অনুষ্ঠান হত, তখন আমার বাবা শাঁখ বাজাতেন। মনে পড়ছে সেই কথাও। প্রতি মুহূর্তে মা-বাবার অভাব অনুভব করছি। তবু আমরা এইবছর ভাইফোঁটা উদযাপন করব। কারণ আমার বাবা বলতেন, জীবন চলমান। থেমে থাকে না। জীবনকে দূরে সরিয়ে রাখতে নেই, আলিঙ্গন করতে হয়। তাই ভাইফোঁটার মতো সুন্দর একটা সামাজিক অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়েই আমরা জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যাব, উপভোগ করব। আমরা যদি বাবার কথা ভেবে ভাইফোঁটা না করি, তাহলে যেখানেই থাকুন না কেন, বাবা হয়তো কষ্ট পাবেন। আমরা চাই না তিনি কষ্ট পান। তাই আমরা ভাইফোঁটায় খুব আনন্দ করব। এখন মাঝেমাঝে ছোটবেলার কথা খুব মনে পড়ে। আমার দাদা বরাবর খুব ভাল মানুষ। নরম মনের মানুষ। মিষ্টভাষী। আমিই বরং দুষ্টু ছিলাম। ডানপিটে। দাদাকে খুব বিরক্ত করতাম। তবে দাদা আমাকে কোনওদিনও বিরক্ত করেননি। খুব মনে পড়ে সেইসব দিনের কথা। আমরা সারা বছর অপেক্ষা করি ভাইফোঁটা দিনটার জন্য। আশাকরি এইবছর দিনটা খুব ভাল কাটবে।”
এইমুহূর্তে মুম্বইয়ে রয়েছেন থিয়েটার ও চলচ্চিত্র পরিচালক রেশমি মিত্র। ভাইফোঁটায় থাকতে পারছেন না বাড়িতে। তাই তাঁর মনখারাপ। টেলিফোনে কথা বললেন তিনি। জানালেন, ‘‘আমার দাদা আছেন। নাম সমর মিত্র। থিয়েটারে অভিনয় করেন। তাঁকে আমি ভাইফোঁটা দিই। আমার জেঠতুতো, খুড়তুতো বোনেরাও তাঁকে ফোঁটা দেন। সবমিলিয়ে আমরা ৯ বোন। দাদা একজনই। দিনটায় আমরা খুব আনন্দ করি। বিভিন্ন রকমের রান্নাবান্না হয়। সকালে আয়োজন করি বোনেরা। রাতে দাদা। জমিয়ে হয় খাওয়া-দাওয়া। সবটাই বাঙালি খাবার। সারাদিন চলতে থাকে আড্ডা। দাদা আমাদের সুন্দর সুন্দর উপহার দেন। আমরাও দিই।”
বড় পরিবার। বাড়িতে দীর্ঘদিন ধরেই হয় দুর্গাপুজো, কালীপুজো। উৎসব শুরু হয়ে যায় অনেক আগেই। রেশমি বললেন, ‘‘আমাদের পারিবারিক ব্যবসা। বিশ্বকর্মা পুজো থেকেই শুরু হয় আমাদের উৎসব। তখন থেকেই নতুন পোশাক। তারপর দুর্গাপুজো, লক্ষ্মীপুজো, কালীপুজো, দীপাবলি, ভাইফোঁটা। ভাইফোঁটা দিয়েই আমাদের উৎসব শেষ হয়। তারপর মনের মধ্যে নেমে আসে মনখারাপের অন্ধকার। এইবছর আমার মন খুবই খারাপ দুটো বিশেষ কারণে। প্রথমত, দুই বছর আগে দাদার সেরিব্রাল অ্যাটাক হয়েছিল। যদিও আপাতত তিনি কিছুটা সুস্থ। তবে অনেক কিছু মনে রাখতে পারছেন না। তাই একটু মনখারাপ। দ্বিতীয় কারণ, এইবছর আমি ভাইফোঁটায় থাকতে পারছি না। আছি মুম্বইয়ে। লক্ষ্মীপুজোর পরে এসেছি। মুম্বইয়ে দুটো হিন্দি ছবি সাইন করছি। চলছে তারই কাজ। ভাইফোঁটায় দাদাকে ফোঁটা দিতে পারব না বলে মনখারাপ। তবে অন্য বোনেরা আসবে। একদিকে নতুন কাজের আনন্দ, অন্যদিকে ভাইফোঁটায় বাড়িতে থাকতে না পারা, এই মুহূর্তে দুইরকমের অনুভূতি জন্ম নিয়েছে আমার মনের মধ্যে।”
ছোটপর্দার জনপ্রিয় ধারাবাহিক ‘করুণাময়ী রানি রাসমণি’। এই ধারাবাহিকে শ্রীরামকৃষ্ণের চরিত্র ফুটিয়ে তোলেন অভিনেতা সৌরভ সাহা। পর্দার পাশাপাশি বাস্তব জীবনেও তিনি মা কালীর ভক্ত। তাঁর বাড়িতেও জমিয়ে সেলিব্রেট করা হয় ভাইফোঁটা। তিনি বললেন, ‘‘জেঠতুতো-খুড়তুতো মিলিয়ে আমরা ৬ ভাই। আমাদের আছে একটিমাত্র বোন। আমার কাকার মেয়ে। নাম প্রতিষ্ঠা। সে সবার ছোট। বড় আদরের। তাই সবার কাছেই স্পেশাল। আমাদের বাড়িতে সবথেকে জমজমাট অনুষ্ঠান ভাইফোঁটা। সবাই একসঙ্গে মেতে উঠি। বোন আমাদের ফোঁটা দেয়। আমরা উপহার দিই। এই ফোঁটার জন্য আমাকে ১৬ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। একসঙ্গে হইহই, আড্ডা, খাওয়া-দাওয়া হয়। সারাবছর আমরা অপেক্ষা করি এই দিনটার জন্য।”
এইবছর দিনটি কীভাবে কাটবে? সৌরভ জানালেন, ‘‘এখন ভাই-বোনেদের অনেকেই কাজকর্ম, পড়াশোনার জন্য বাইরে থাকে। তাই ভাইফোঁটার সেলিব্রেশনটা গত কয়েকবছর ঠিকমতো হচ্ছে না। বোনও বাইরে থাকে। ফলে এইবছরেও তেমন কিছু হবে না। দিনটা এলে পুরনো দিনের কথা খুব মনে পড়ে।”
আরও পড়ুন-উপেক্ষিত তিনকন্যা
উৎসবের দিনে তাঁরা সবাই এক। সৌরভ বললেন, ‘‘আমাদের বাড়ির সবাই খেতে খুব ভালবাসে। এখন খড়দায় থাকলেও আমরা আসলে বরিশালের লোক। ফলে সেই অঞ্চলের কিছু বিশেষ পদ রান্না হয়। সারাবছর আলাদা হেঁশেল হলেও, উৎসবের দিনগুলোয় আমরা সবাই এক। মা-কাকিমাদের হাতের রান্নার কোনও তুলনাই হয় না। যাইহোক, আশাকরি আগামী দিনে আমরা সবাই আবার আগের মতো ভাইফোঁটায় এক হব। এইবছর দূর থেকেই আমার বোনকে করব আশীর্বাদ। হয়তো ফোনে বা ভিডিও কলে কথা হবে। আমি শুভেচ্ছা জানাচ্ছি আমাদের অভিনয় জগতের বোনেদেরও, যারা আমাকে ভালবাসে, সম্মান করে।”