চব্বিশের লোকসভা নির্বাচনে চূড়ান্ত হতাশাজনক ফলাফলের পরে বঙ্গ বিজেপিকে খানিক অক্সিজেন দিতেই বোধহয়, লোকসভা নির্বাচনের ফল ঘোষণার কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই রাজ্যে উপনির্বাচনের নির্ঘণ্ট প্রকাশ করে দিয়েছিল নির্বাচন কমিশন। হিসেব অনুযায়ী রাজ্যে মোট দশটি আসনে বিধানসভা উপনির্বাচন হওয়ার কথা। সাধারণত একসঙ্গে সব ক’টি আসনেই উপনির্বাচন আয়োজন করা দস্তুর। কিন্তু, গত এক দশকে নির্বাচন কমিশন যেভাবে দিল্লির শাসক দলের তল্পিবাহকতা করে এসেছে, তাতে এসব নিয়মের ব্যতিক্রম দেখলে এখন আর ভ্রম লাগে না। ফলে দশটি বিধানসভায় আপাতত বিধায়ক শূন্য থাকলেও ভোট হচ্ছে, ৪টি কেন্দ্রে। এই যে বেছে বেছে এই ৪টি কেন্দ্রেই কেন নির্বাচন হচ্ছে, সেটা বোঝার জন্য রাজনৈতিক পণ্ডিত হওয়ার প্রয়োজন নেই। বঙ্গ রাজনীতিতে শুভেন্দু-সুকান্ত জুটির ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে এই ৪ কেন্দ্রের উপনির্বাচনের ফলাফল। একথা সত্যিই যে, রানাঘাট দক্ষিণ, বাগদা এবং রায়গঞ্জে গত বিধানসভায় এবং গত লোকসভায় আশানুরূপ ফল করতে পারেনি তৃণমূল কংগ্রেস। সম্ভবত সেই কারণেই বিজেপি ভেবে নিয়েছিল, এই তিনটি কেন্দ্রে উপনির্বাচন যত দ্রুত সম্ভব করিয়ে নিতে পারলে এ-যাত্রায় অন্তত বঙ্গ বিজেপির নেতৃত্বের পদটা বেঁচে যাবে।
কিন্তু, রাজনীতির ছাত্র হিসেবে এই চার উপনির্বাচনের প্রচার পর্ব এবং বিভিন্ন দলের নেতা-কর্মী, সাধারণ মানুষদের সাথে কথা বলে এটুকু নিশ্চিত বলতে পারি, এই চার কেন্দ্রেই তৃণমূল কংগ্রেস জিততে চলছে। রাজনীতির স্বাভাবিক নিয়ম, উপনির্বাচনে সাধারণত শাসক দলই জেতে। কিন্তু এই নিয়মের কি ব্যতিক্রম নেই? অবশ্যই আছে। আর আছে বলেই, এই উপনির্বাচনের প্রচারও এতটুকু ঢিলেমি দেয়নি রাজ্যের শাসক দল।
চারটি বিধানসভার ক্ষেত্রে চার আলাদা আলাদা ‘স্ট্রাটেজি’ নিয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস। উত্তর কলকাতার মানিকতলা বিধানসভা যেমন বরাবর তৃণমূল কংগ্রেসের শক্ত ঘাঁটি। প্রয়াত সাধন পাণ্ডে-জায়া সুপ্তি পাণ্ডের সমর্থনে সেখানে বিরাট জনসভা, রোড শো হয়েছে। কুণাল ঘোষ, পরেশ পাল, অতীন ঘোষেরা একাধিক বড় সভা, মিছিল, রোড শো করছেন। জনতার মুখরিত সখ্যে হাজার হাজার মানুষের মিছিল হচ্ছে। দীর্ঘ আড়াই বছর বিধায়কহীন থাকার পরে, মানুষ কার্যত মুখিয়ে আছেন ভোট দান করার জন্য। এবং সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক হল, এমন একজন ব্যক্তির অপ্রয়োজনীয় মামলার জেরে মানিকতলার মানুষকে আড়াই বছর বিধায়কহীন থাকতে হল, তাঁকেই ফের প্রার্থী করেছে বিজেপি!
বাগদায় আবার তাঁর ঠিক উল্টো চিত্র। বড় জনসভা-রোড শো-র বদলে তৃণমূল প্রার্থী মধুপর্ণা ঠাকুরের সমর্থনে সেখানে নিবিড় সংযোগে মন দিয়েছেন তৃণমূলের নেতা কর্মীরা। নিবিড় সংযোগ, পাড়াবৈঠক, ছোট ছোট পথসভা করেছেন রাজ্যের মন্ত্রী সুজিত বসু, ব্যারাকপুরের সাংসদ পার্থ ভৌমিকেরা। তৃণমূল ছাত্র পরিষদের রাজ্য সভাপতি তৃণাঙ্কুর ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে একঝাঁক ছাত্র যুব তৃণমূল কংগ্রেস কর্মী বাড়ি বাড়ি ঘুরে জনসংযোগ করেছেন। গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে দীর্ণ বিজেপির এই বিধানসভায় হার এক প্রকার নিশ্চিত করে দিয়েছেন মতুয়া ঠাকুর পরিবারের সন্তান মধুপর্ণা ঠাকুর। আপাতত পিএইচডি করছেন তৃণমূল কংগ্রেসের এই প্রার্থী। মতুয়া ঠাকুরবাড়ি যে কোনও একজনের ব্যক্তিগত সম্পত্তি না, তা বারবার বুঝিয়ে দিয়েছেন মধুপর্ণা। লোকসভা নির্বাচনের কয়েক দিন আগেই মতুয়া ঠাকুরবাড়িতে বড়মা বীণাপাণি দেবীর ঘরের দরজায় তালা লাগানোকে কেন্দ্র করে দ্বন্দ্ব চরমে ওঠে। বিজেপি সাংসদ শান্তনু ঠাকুরের নির্দেশে জুতো পরে সিআরপিএফ জওয়ানেরা ঢুকে পরেন বড়মার ঘরের সামনে। প্রতিবাদে ধরনায় বসেন মধুপর্ণা। অসুস্থও হয়ে পড়েন! সেই প্রথম সংবাদমাধ্যমের নজরে আসেন কপিলকৃষ্ণ ঠাকুর এবং মমতাবালা ঠাকুরের কন্যা মধুপর্ণা ঠাকুর। হরিচাঁদ ঠাকুর-গুরুচাঁদ ঠাকুরের পরিবারের কন্যাকে জেতাতে তৈরি বাগদার বৃহত্তর মতুয়া সমাজ। জিতলেই নয়া রেকর্ডের অধিকারিণী হবেন তিনি। গোটা দেশের সর্বকনিষ্ঠা বিধায়ক হিসেবে নজির গড়বেন পঁচিশ বছর এক মাস বয়সি মধুপর্ণা ঠাকুর!
সি-এ-এ বা নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন যে আদতে ভাঁওতা তা এখন আরও স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে মতুয়া সমাজের কাছে। গোটা ভারতবর্ষের মতোই বাংলাতেও সি-এ-এর মাধ্যমে নাগরিকত্ব নেওয়ার আবেদনে সাড়া দিচ্ছেন না মতুয়ারা। আর এটাই স্পষ্ট ইঙ্গিত দিচ্ছে, যে মতুয়া সমাজকে আর বোকা বানিয়ে রাখতে পারবে না বিজেপি৷ মতুয়া-অধ্যুষিত রানাঘাট দক্ষিণ আসনটিতেও এবার বিজেপির পরাজয় নিশ্চিত! নদীয়া জেলায় মতুয়া-অধ্যুষিত রানাঘাট দক্ষিণে মুকুটমণি অধিকারী এবার দৃঢ়প্রত্যয়ী এই আসনটি জয়ের ব্যাপারে। এবং এই কাঙ্ক্ষিত জয় এলে তা, তৃণমূল কংগ্রেসের জন্যও একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জয় হবে। কারণ, অপ্রিয় হলেও একথা সত্যি যে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাজারো উন্নয়নের পরেও দক্ষিণবঙ্গের মধ্যে একমাত্র নদীয়া-রানাঘাট সাংগঠনিক জেলায় তৃণমূল কংগ্রেসের ফল কিছুতেই আশানুরূপ হচ্ছে না। উপনির্বাচনকে কেন্দ্র করে রানাঘাট সাংগঠনিক জেলার সকল নেতৃত্ব একযোগে নেমেছেন ময়দানে। যা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। যদিও উপনির্বাচন। কিন্তু তারপরেও বাগদা এবং রানাঘাট দক্ষিণের মতো ‘মতুয়াগড়ে’ বিজেপির হার প্রায় নিশ্চিত হলে তা কিন্তু ২০২৬-এর বিধানসভা নির্বাচনের আগে মতুয়া সমাজের তরফ থেকে একটা স্পষ্ট বার্তা যাবে, যে, তাঁরা আর বিজেপির ভুয়ো প্রতিশ্রুতিতে প্রভাবিত হচ্ছেন না!
আরও পড়ুন- ওটিটি-মাল্টিপ্লেক্সের যুগে রূপ-চরিত্র বদলে স্বমহিমায় যাত্রা
এবং অতি অবশ্যই রায়গঞ্জ। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী হওয়া ইস্তক তাঁর বরাবরের লক্ষ্য থেকেছে উত্তরবঙ্গের জেলাগুলিকে ঢেলে সাজানো। পরিকাঠামোগত উন্নয়ন সঙ্গে বিভিন্ন সামাজিক প্রকল্প তো রয়েছে। কিন্তু, ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচন থেকে যে উত্তরবঙ্গে একের পর এক আসনে বিজেপি নিজেদের জয় হাসিল করেছে, সেই বিজেপির জয়ের ধারাকেই ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনে রুখে দিতে সক্ষম হয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস। রাজবংশী-অধ্যুষিত কোচবিহার আসনে বিজেপির হেবিওয়েট প্রার্থী অমিত শাহের প্রাক্তন ডেপুটিকে হারিয়ে দিয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস। বিজেপির রাজ্য সভাপতিও কোনওক্রমে হারতে হারতে শেষ পর্যায়ে গিয়ে নিজের মুখ বাঁচিয়েছেন। এহেন উত্তরবঙ্গের রায়গঞ্জ আসনে এই উপনির্বাচনের দিকে শুধু উত্তর দিনাজপুর নয় গোটা রাজ্য রাজনীতির কারবারিদেরই নজর রয়েছে। রায়গঞ্জ আসনের ফলাফল এবার অনেক রাজনীতির পণ্ডিতদের চমকে দেবে! গত লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল অনুযায়ী, এই আসনে বিজেপি প্রায় ৪৭ হাজার ভোটে এগিয়ে। কিন্তু লোকসভার ফলাফল আর এই উপনির্বাচনে ফলাফল সম্পূর্ণ ভিন্ন হবে। একটা তথ্য মনে করিয়ে দিই, গত ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে এই জেলারই কালিয়াগঞ্জ আসনটিতে বিজেপি এগিয়ে ছিল ৫৬ হাজার ৭৬২ ভোটে। সেই কালিয়াগঞ্জেই ১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের কয়েক মাসের মধ্যে উপনির্বাচনে জয়লাভ করে তৃণমূল কংগ্রেস। লোকসভা আর রাজ্য বিধানসভার ভোটের প্রেক্ষিত সম্পূর্ণ আলাদা। লোকসভায় যেখানে দেশের বিভিন্ন ইস্যুতে মানুষ রায়দান করেন, রাজ্যের ক্ষেত্রে সেখানেই রাজ্যের বিষয় অগ্রাধিকার পায়! আর রাজ্যের ক্ষেত্রে এখনও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিকল্প কোনও মুখ রাজ্যের মানুষের কাছে নেই। যে পরিমাণ সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পগুলো রাজ্যের সাধারণ মানুষের কাছে রাজ্য সরকার পৌঁছে দেয়, তাতে রাজ্যের ভোটের ক্ষেত্রে মানুষ একজনকে দেখেই রায়দান করেন, তিনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাই, নিশ্চিতভাবে বলা যায় আজকের উপনির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষে চারে চার হওয়া স্রেফ সময়ের অপেক্ষা! বাউন্ডারি হচ্ছেই!