কাল গিয়েছে ন্যাড়া পোড়া, আজ আমাদের দোল

আজ রং-খেলার উৎসব। আজই দোলদুলাল চৈতন্যমহাপ্রভুর জন্মতিথি। এই উৎসবের উৎসকথা ও বিবর্তনের বর্ণনায় দেবাশিস পাঠক

Must read

রসসৃজনকারী, রসানুভূতির সুখদায়ক, চিত্তবিনোদনকারী মধুবসন্তে মহামিলনোৎসব দোল-উৎসবের (Dol Yatra) জয় হোক।
প্রথমেই একটা কথা বলে নেওয়া ভাল। শ্রীচৈতন্যের জন্মের পূর্বে শ্রীকৃষ্ণের দোলযাত্রা বলে কোনও ধর্মীয় অনুষ্ঠান ছিল না। আচার্য সুকুমার সেন ‘দোলের কথা’ বলতে বসে একথা সুস্পষ্টভাবে বলেছেন।বঙ্গদেশের নবদ্বীপে ফাল্গুনী পুর্ণিমার দিন জন্ম নিলেন দোলদুলাল চৈতন্যদেব। তাঁর তিরোভাবের পর ষড় গোস্বামীরা যখন বৈষ্ণবের আচরণীয় বিধি সংস্কৃতে গ্রন্থবদ্ধ করতে বসলেন, তখন তাঁরাই মহাপ্রভুর জন্মতিথিকে বিশেষ তাৎপর্যে মুড়ে দেওয়ার বাসনাতেই তার সঙ্গে জুড়ে দিলেন পশ্চিম ভারতের লোক উৎসব হোলিকে। এই উৎসবে লৌকিক গান ও ছড়ার সুতো ধরে রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলার যোগ আগে থেকেই ছিল। এবার, বস্তুতপক্ষে, চৈতন্য পার্ষদ ষড় গোস্বামীর সৌজন্যে পশ্চিম ভারতের হোলি বাংলায় দোলযাত্রার রূপ পেল।

বিবেকানন্দের ভাই মহেন্দ্রকুমার দত্ত ‘কলিকাতার পুরাতন কাহিনী ও প্রথা’র কথা বলতে বসে জানিয়েছেন, “আগে কলকাতায় দোলটা খুব জাঁকিয়ে হত। লোকে কথায় বলিত, হিন্দুর বাটী, দোল-দুর্গোৎসব করিতে হয়। দোল-দুর্গোৎসবে শাক্ত-বৈষ্ণব ছিল না। সামর্থ্য অনুযায়ী উভয় দলই করিত।“
আসলে কলকাতার এই ‘রং’বাজি চলে আসছে শেঠ-বসাকদের জমানা থেকে।

ষোড়শ শতকে মুকুন্দরাম শেঠ একটা উঁচু জমি কেনেন নবাবদের কাছ থেকে। সেই জমিতে জঙ্গল কাটেন, পুকুর কাটেন। সেই পুকুর পাড়ে তৈরি করেন গোবিন্দ জিউয়ের মন্দির। এই মুকুন্দরামের ছেলে লালমোহন। তিনি একটা বড় দিঘি কাটলেন। বাড়ির কাছে বসালেন বাজার। সেই বাজারের নাম হয়ে গেল লালবাজার।
বড়িশার সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের ছেলে অতুলকৃষ্ণ রায় ছিলেন কলকাতার সহকারী জনগণনা আধিকারিক। আজ থেকে ১২২ বছর আগে বেঙ্গল সিভিল সার্ভিসের সদস্য হিসেবে তিনি রচনা করেন সেন্সাস রিপোর্ট। ৭ খণ্ডে বিস্তৃত ছিল সেই রিপোর্ট। সেটির প্রথম খণ্ডে অতুলকৃষ্ণ ওরফে এ কে রায় কলকাতা শহরের একটি সংক্ষিপ্ত ইতিহাস ঢুকিয়ে দেন।

আরও পড়ুন: হলুদ পলাশের টানে দোলে বড় আকর্ষণ বেড়ো

তিনি জানাচ্ছেন, সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের কাছারি বাড়িটা ছিল কলকাতার একেবারে কেন্দ্রস্থলে। ইংরেজদের ফোর্ট উইলিয়ামের পূর্ব দিকে ছিল লালমোহনের খনন করা দিঘি। সাবর্ণ রায়চৌধুরীরা তাঁদের কুলদেবতা শ্যাম রায়ের বিগ্রহটিকে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন কালীঘাটে। কিন্তু দোল-উৎসব পালন করতে আসতেন সেই দিঘির পাড়েই। দিঘির জলে আবির গুলে রং-খেলা হত। ‘আবিরে ইহার জল লাল হইয়া যাইত’। তার থেকে দিঘিটির নাম হয়ে যায় লালদিঘি।
জগন্নাথ শেঠের সময়ে ‘দিঘির উত্তর ও দক্ষিণে দুইটা দোলমঞ্চ ছিল। দক্ষিণের মঞ্চে গোবিন্দজিউ এবং উত্তরের মঞ্চে রাধারানিকে স্থাপন করিয়া যাত্রীগণ আবির যুক্ত করিত। রাধারানির উত্তরে যে বাজারটি বসিত তাহা তাঁহার নামানুসারে রাধাবাজার নামে খ্যাত। ওই নাম আজিও রহিয়াছে।’

সাবর্ণ রায়চৌধুরীরা তাঁদের দোলোৎসব (Dol Yatra) করতেন বড়িশায় নয়, কলকাতার কাছারি বাড়িতে। ১৬৮৮ সালের ঘটনা। সেই কাছারি বাড়িতে দোল উৎসব দেখার জন্য ঢোকার চেষ্টা করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ব্রিটিশ কর্মচারীরা। তাদের আটকান যিনি তিনিও অহিন্দু খ্রিস্টান। সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের সেই বিদেশি কর্মচারীটির নাম ছিল অ্যান্টনি। খবরটা পেয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন স্বয়ং জোব চার্নক। চাবুক দিয়ে পেটান অ্যান্টনিকে। অপমান সহ্য করতে না পেরে অ্যান্টনি কলকাতার পাট উঠিয়ে কাঁচড়াপাড়ায় গিয়ে বসবাস করতে শুরু করেন।
এই অ্যান্টনিই ছিলেন অ্যান্টনি কবিয়ালের ঠাকুর্দা।
এমন সব বর্ণিল গল্পের কোলাজে দোল উৎসব আরও রঙিন হয়ে ওঠে।

Latest article