এক মাসের কঠোর ‘সিয়াম’ ব্রত পালনের পর এসেছে ইদ (Eid)। আরবি মাস রমজান। বিশ্বের মুসলমানদের কাছে অত্যন্ত পবিত্র। এই মাসেই পবিত্র কোরান অবতীর্ণ হয়েছিল। এই মাসেই আছে সৌভাগ্যের রাত্রি। এই মাসেই সাবে মিরাজ। ইসলামেপ প্রধান ৫টি অবশ্য পালনীয় স্তম্ভের মধ্যে অন্যতম রোজা। (আরবিতে সিয়াম)। এক মাস ব্যাপী দিনের বেলায় উপবাস পালন। সন্ধ্যা লগ্নে ‘ইফতার’। আমরা সোজা বাংলায় তাকে বলি ‘রোজা খোলা’ বা উপবাস ভঙ্গ। তবে ‘ইফতার’ শব্দটি এখন বাংলা শব্দ তালিকায় ঢুকে গেছে। কাউকে অর্থ বলতে হয় না। ভাষা যে একটি সজীব বস্তু তা এতেই প্রমাণ হয়।
ইদের (Eid) চাঁদ দেখে পরের দিন খুশির নামাজ। ইদল ফিতর। এই নামাজে যেমন খুশি বা আনন্দ আছে। আমার কর্তব্যও আছে। কর্তব্য হল কেউ যেন নিরানন্দ না থাকে সেটা নিশ্চিত করা। অর্থাৎ ফিতর বা ফেতরা দেওয়া। দান করা। যত পারো দান কর। যেন প্রতিবেশীর মুখ শুকনো না থাকে। প্রতিবেশীকে অভুক্ত রেখে কোনও ইবাদত গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। সবাইকে নিয়ে আনন্দ করতে পারলে সেটাই হবে প্রকৃত ‘ইদুল ফিতর’। এক মাসের কঠোর উপবাস ব্রতের অন্যতম প্রধান বিষয় হচ্ছে সংযম থাকা। আমাদের দৈনন্দিন চাহিদার কুৎসিত বৃত্তকে যতটা সম্ভব ছোট করে মানুষের ভাল করার চেষ্টা চালানো। সব ধর্মের শেষ চাহিদা ‘শান্তি’। ইসলাম তো শান্তির ধর্ম। এই ধর্মের প্রধান পয়গম্বর হজরত মহম্মদ সে. যতই যুদ্ধ করুন না কেন শেষ পর্যন্ত অস্ত্রাঘাত করে আল্লার কাছে দু’হাত তুলে মোনাজাত করেছেন সারা পৃথিবীতে, সব মানুষের মধ্যে শান্তি নেমে আসুক এই আবেদনে।
আমাদের সকলের জীবনে ইদের (Eid) বার্তা ছড়িয়ে পড়ুক এটা আমাদের প্রাণের চাওয়া। মধ্যপ্রাচ্যের আমাদের উত্তর বা পূর্ব ভারতের চাইতে একদিন আগে রোজা শেষ হয় ও ইদ হয়। দক্ষিণ ভারতের কোথাও কোথাও সেই ভাবেই হয়। আসলে আরবি চান্দ্রমাসের হিসাবে ইসলামি অনুষ্ঠানগুলির সময় নির্ধারিত বলে এমন হয়। আমাদের বাংলা বা ইংরেজি বর্তে রমজান মাস বা ইদের দিন এ-কারণেই এগিয়ে পিছিয়ে যায় আসে। তবে বর্ষ গণনায় ইসলামের অবদান পৃথিবী বিখ্যাত। কার্যত বর্ষ গণনার বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি আরবদের কাছ থেকেই শিখেছে ইউরোপ।
এবারের রোজা পালনের সময় অনেক ঘটনা সামনে এসেছে। সামান্য হলেও একটু উল্লেখ করা প্রয়োজন মনে করি। এবার রমজানের সময় সময় বসন্ত উৎসব অর্থাৎ বঙ্গের উৎসব ছিল। যা বাংলার বড় উৎসবগুলির অন্যতম। সবাই বলি আমরা ‘রঙ যেন মোর মর্মে লাগে’। ভারতের বিস্তীর্ণ প্রান্তে ছিল হোলি উৎসব। ওইদিন ছিল শুক্রবার। জুম্মা নামাজের দিন। মসজিদ না গিয়ে জুম্মা বাড়িতে পড়া যায় না। উত্তরপ্রদেশে মুসলমানদের উপর প্রকাশ্যে হুমকি দেওয়া হল সেদিন যেন তাঁরা বাড়ির বাইরে না যান। হিন্দুত্ববাদীদের নগ্ন প্রকাশ দেখা গেল। উন্নাও শহরে জুম্মা পড়তে বেরিয়ে রং নিতে অস্বীকার করার জন্য প্রতিবেশীদের হাতে খুন হতে হল শরিফকে। এর পরেও আছে। পুলিশের পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হল সম্ভল শহরের অন্যতম প্রধান মসজিদ কাজে মসজিদ-সহ ১০টি মসজিদকে প্লাস্টিক বা তারপলিন দিয়ে ঢেকে রাখার জন্য দোলের দিনে। ধর্মীয় আচার পালনের সংবিধানিক অধিকার কেমনভাবে খর্ব করা হচ্ছে তা সহজেই বোঝা যাচ্ছে।
আরও পড়ুন-অক্সফোর্ডে অসভ্যতা আর বাঁদরামি নিয়ে শুরু শকুনের লড়াই, ছ’পিস রাম-বামের চক্রান্ত ফাঁস
ঠিক উল্টো চিত্র বাংলায়। মুসলমানদের অনেক সংগঠন নিজেরাই ঘোষণা করেছিলেন জুম্মা একটু দেরি করে শুরু করা হবে। সকালে আবির বা দোল খেলার পর। সব জায়গায় সেটা হয়নি। আবার কোথাও হয়েছে। কিন্তু আমার মন ভরে গেছে এই ছবি দেখে যে সিউড়িতে একই রাস্তার ধারে আবির খেলছেন ছেলেমেয়েরা, রাস্তার অন্যধার দিয়ে জুম্মা পড়তে যাচ্ছেন নামাজীরা। কোনও অসুবিধা হয়নি। বরং যাঁরা আবির খেলছেন তাঁরা রাস্তা নিয়ন্ত্রণ করছেন যাতে নামাজীদের কোনও অসুবিধা না হয়। এই আমার প্রিয় বাংলা। এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে না কো তুমি। এই সোনার বাংলায় যে যার ধর্ম পালন করে নিজের মতো করে। কিন্তু ধর্মের উৎসবে মিলিত হয় সবাই। সবাই সবাইকে বুকে জড়িয়ে ধরে হৃদয়ের উষ্ণতা বাড়ায়। একারণেই বাংলায় সরস্বতী পূজার ফল কাটতে আসে মুসলমান। মা দুর্গার চালচিত্র তৈরি করে মুসলমান। ইদ উৎসবের দিনে ময়দানে অপেক্ষা করে অসংখ্য হিন্দু ভাই কোলাকুলি করবে বলে। প্রতিটি অনুষ্ঠান বাংলায় এভাবেই রং ছড়ায়। আমরা রঙিন হয়ে উঠি। বাংলার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির আবহমান কাল ধরে এটাই হয়ে আছে।
সব উৎসবের দিনেই আমাদের সহনশীলতা, বহুত্ববাদ ও সমন্বয়বাদের পরীক্ষা দিতে হয়। এটা শুধু সংখ্যালঘু মুসলমানদের জন্য প্রযোজ্য নয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। বরং আরও বেশি করে প্রযোজ্য। যারা সংখ্যায় বেশি তাদের হতে হবে বেশি দায়িত্ববান। সংখ্যাগরিষ্ঠের হাতেই থাকে সংখ্যালঘুর ন্যায্য অধিকার রক্ষার দায়। আর ধর্মনিরপেক্ষতার প্রমাণ কেবল মুসলমানকে দিতে হবে কেন? সবাইকে এবং সমানভাবে দিতে হবে। আমাদের দেশের সংবিধান সে-পথের নিশানা দেখিয়েছে অনেক দিন আগে।
আসুন, এবার উৎসবে ফিরি। আমাদের ইদের পুরনো স্মৃতি হারিয়ে গেছে প্রায়। আগের দিন সন্ধ্যায় ইদ চাঁদ দেখার সৌরভ নেই। এখন টেলিভিশনেই চাঁদ দেখা যাচ্ছে। শীত-বর্ষায় ভেদ নেই। আমাদের ছোটবেলায় রাজশাহী বেতারে চাঁদ দেখার খবর শুনতাম। ইদের সকালে নতুন জামাকাপড়। আতর মাথা তুলোর পুঁটলি। কানে গোঁজা। সুরমাদানি থেকে কাঠি দিয়ে সুরমা চোখে লাগানো। বাবার দেওয়া দুটো টাকা। কমবেশি করে সবই আছে। কিন্তু সেই সৌরভ নেই। আসলে আমাদের বয়স হয়েছে। সময় পাল্টেছে। মেহেন্দির বদলে ট্যাটু। সুরমা’র বদলে আধুনিক কাঠির কাজল। আতরের বদলে দামি পারফিউম। মায়ের হাতে তৈরি সিমাই নয়, মেসিনে তৈরি সিমাই। আর দু’টাকা? একথা শুনে আমাদের ছেলেমেয়েরা হেসে কুটোপাটি।
ইদ উৎসবে আধুনিকতার ছোঁয়া। ইদ উপলক্ষে মেলা বসছে। সেখানে হাঁড়িকুড়ি চাকতা বেলন সবই বিক্রি হচ্ছে। কোথাও নাগরদোলা। কোথাও আয়োজন হয়েছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সেখানে হিন্দু-মুসলমান সবাই যোগ দিচ্ছে। কোরান আবৃত্তির প্রতিযোগিতাও হচ্ছে। আমাদের সময়ের মতো ম্যাড়মেড়ে ভাবটা নেই। রঙিন হয়ে উঠছে উৎসব। তবে ধর্মীয় অনুষঙ্গটি পাল্টাবে না। তা উচিতও নয়। সব চাইতে বড় পরিবর্তন হয়েছে মেয়েরা আলাদা জামাত করে নামাজ পড়ছে। আর আমাদের সল্টলেকে ছেলেমেয়ে আলাদা বসার ব্যবস্থা করে একসঙ্গেই ইদের নামাজ পড়া হচ্ছে। এমন অগ্রগমন বাংলাতেই সম্ভব। আসুন সবাই এই মিলনের উৎসবে অংশ নিই। ভাল থাকবেন। ইদ মুবারক।