খানাপিনা

আজ বিশ্ব খাদ্য দিবস। পাশাপাশি জাতীয় লিকার দিবস। জমজমাট খানাপিনার দিনটি উদযাপিত হচ্ছে সর্বত্র। সেই উপলক্ষে আজকের 'রবিবার'-এর পাতায় সাজিয়ে দেওয়া হল খাদ্য এবং পানীয় নিয়ে তিনটি বিশেষ প্রতিবেদন

Must read

বাঙালির সুরাপান

দীপ মুখোপাধ্যায়: অষ্টাদশ শতকে সাহেবরা বাঙালিদের মদ চিনিয়েছে। চুঁচুড়ার বাবু প্রাণকৃষ্ণ হালদার বন্ধু-অতিথিদের সামনে যে মাত্রাহীন মদ-বিলাসিতা দেখিয়েছিলেন তার পরিণতি বিষয়সম্পত্তি নিলাম ও সাতবছরের জন্য দ্বীপান্তর। দ্রুত উত্থান এবং ততধিক দ্রুত পতন। এইভাবে মদ্যবিলাসীরা দ্রুত হারিয়ে গেছেন কলকাতার আসর থেকে। দুর্গাপুজোও ছিল মদবৈভব প্রদর্শন করার বাৎসরিক আয়োজন। ক্যালকাটা ক্রনিকেল থেকে জানা যায় প্রাণকৃষ্ণ সিংহ কেষ্টচাঁদ মিত্র, নারায়ণ মিত্র, রামহরি ঠাকুর বা বারাণসী ঘোষের হুজুগে মদ বৃত্তান্ত। রাজা নবকৃষ্ণের বাড়িতে তখন লর্ড বেন্টিঙ্ক আসেন মৌতাতে মজতে তেমনি দু-চারজন এডুকেটেড ইয়াং বেঙ্গলও ইয়ার দোস্ত সমেত মদে-ভাতে প্রসাদ পেতেন। মদ আড়ম্বরের বাড়াবাড়ি তখন এঁদেরই করতলগত। তবুও অফুরন্ত কালের প্রবাহে এগুলি বুদবুদ মাত্র।

আরও পড়ুন-বাঙালি ও ফুড-ব্লগার

দেওয়ান কার্ত্তিকেয় চন্দ্র রায় লিখছেন, হিন্দু কালেজের শিক্ষিত ছাত্রগণের মধ্যে যাঁহারা এদেশের সমাজ সংস্কার করিতে ব্রতী হইয়াছিলেন, তাঁহারা সকলেই সুরাপান করিতেন। তিনি নিজেই ফের লিখছেন, কৃষ্ণনগরের সুশিক্ষিত ডেপুটি কালেক্টর মাধবচন্দ্র মল্লিকের বাড়িতে তাঁরা চার-পাঁচজন মিলে মদিরা পান করতেন এবং বড়ই সুখি হইতেন।
রাজনারায়ণ বসুর মদ্যপান বৃত্তান্ত শুনিয়েছেন শিবনাথ শাস্ত্রী মশাই। রাজনারায়ণ মদ্যাসক্ত ছিলেন ষোলো-সতেরো বছর বয়স থেকেই। হিন্দু কলেজে পড়ার সময়েই। বাবা নন্দকিশোর বসু সে খবর জানতে পেরে একদিন আলমারি থেকে মদের বোতল এবং গেলাস বের করে নিজে হাতে তাঁকে সার্ভ করেছিলেন। এবং বলেছিলেন, যখনই মদ খাবে আমার সঙ্গে খাবে, অন্যত্র নয়। রাজনারায়ণ বসু তাই সাফাই গেয়েছেন, তখনকার সময়গুণে ডিরোজিওর যুবক শিষ্যদিগের এমনি সংস্কার হইয়াছিল যে, মদ খাওয়া, খানা খাওয়া সংস্কৃত ও জ্ঞানালোকসম্পন্ন মনের কার্য। তাঁরা মনে করতেন এক গ্লাস মদ খাওয়া কুসংস্কারের উপর জয়লাভ করা।

আরও পড়ুন-আজ নন্দীগ্রাম যাচ্ছেন কুণাল, পতাকা ছিঁড়ে তৃণমূলকর্মীদের মেরে নন্দীগ্রামে গেরুয়া-সন্ত্রাস

রাজা রামমোহন রায় পরিমিত মদ্যপান করতেন। জনশ্রুতি, তাঁর এক শিষ্য তাঁকে এক গ্লাস অতিরিক্ত মদ খাইয়েছিলেন বলে তিনি ছ-মাস তার মুখদর্শন করেননি। পথ্যপ্রদান এবং কায়স্থের সহিত মদ্যপান বিষয়ক বিচার গ্রন্থে মদের সপক্ষে অনেক সালিশি করেছিলেন তিনি। তাঁর অনুগামী প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর মদ্যপানে রীতিমতো আসক্ত ছিলেন। তাঁর বেলগাছিয়ার বাগানবাড়িতে প্রায় মদ্যপানের আসর বসত। মদ জোগাত ব্যবসায়ী বিশ্বনাথ লাহা। মদ আমদানি করত তাঁর কার টেগোর অ্যান্ড কোম্পানি। রূপচাঁদ পক্ষী গান বেঁধেছিলেন, কি মজা আছেরে লালজলে জানে ঠাকুর কোম্পানি/ মদের গুণাগুণ আমরা কী জানি?

আরও পড়ুন-ট্রেইল পাস জয়

ঠাকুর পরিবারকে নিয়ে চুটকি ছিল, দুধে আর মদে আছে বলেই ওরা এত ফর্সা। যৌবনে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথও মদ বিমুখ ছিলেন না। এর মধ্যেই প্যারিচরণ সরকারের নেতৃত্বে সুরাপান নিবারণী সমিতি গঠিত হয়েছে। ঈশ্বর গুপ্ত ইয়ং বেঙ্গলের মদ্যপানকে পরিহাস করলেও নিজে প্রচণ্ড মদ্যপ ছিলেন। তাঁকে সমাজে তাই হেয় হতে হয়েছে বারবার। তিনি নিজেই ছড়া কেটেছেন, সেরি চেরি বীর ব্র্যান্ডি ওই দেখ ভরা/ একবিন্দু পেটে গেলে ধরা দেখি সরা।
মদ্যপ বলে খ্যাতনামা ছিলেন হিন্দু পেট্রিয়টের সম্পাদক হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় এবং রাধানাথ শিকদার। এঁরা প্যারিচাঁদ মিত্রের ‘মদ খাওয়া বড় দায়, জাত রাখার কি উপায়’ প্রহসনের সমালোচনা করতেও ছাড়েননি।
মাইকেল মধুসূদন দত্তকে মৃত্যুর পথে ঠেলে দিয়েছে এই মদ্যাসক্তি। তিনি মনমোহন বসুকে বলেছিলেন, দিস ইজ এ প্রসেস ইকোয়ালি সিয়োর বাট লেস পেনফুল।

আরও পড়ুন-ট্রেইল পাস জয়

কে না মদ খেয়েছেন? হুতোম পেঁচার নকশার লেখক কালীপ্রসন্ন সিংহ থেকে শুরু করে বঙ্কিমচন্দ্র, হেমচন্দ্র, নবীনচন্দ্র সকলে। রবীন্দ্রনাথের স্কচের পেটি একদা সাবাড় করে দিয়েছিল লরেন্স নামে এক ব্রিটিশ ছোকরা। কবি স্ত্রীকে পত্রে লিখছেন, বোধহয় ক’দিন খুব মদ চালাচ্ছিল। আজ সকালেও আমার কাছ থেকে একটু হুইস্কি চেয়ে নিয়ে খেলে। রবিঠাকুর চিরকুমার সভায় মদ নিয়ে লিখছেন, দেশে অন্নজলের হল ঘোর অনটন/ খাও হুইস্কি সোডা আর মুরগী-মটন। কিংবা, অভয় দাও তো বলি আমার wish কী/ এক ছটাক জলের সাথে বাকি তিনপোয়া whisky।
নাট্যাচার্য গিরিশচন্দ্রের মদের আসক্তির কথা মিথ পর্যায়ে উঠে গেছে। ঠাকুর রামকৃষ্ণ এ ব্যাপারে বোধহয় তাঁকে প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয় দিয়ে গেছেন। নরেন্দ্রনাথ দত্ত অবধি উইলসন হোটেলে মদ চেখেছেন। স্ত্রী বিয়োগের পর আসক্ত হয়েছেন দ্বিজেন্দ্রলাল রায়।
সেই কলকাতার মদ্যপানের প্রভাব পড়েছে তৎকালীন সাহিত্যে, ছড়ায় এবং গানে। অসহযোগ আন্দোলনে মদের দোকানে পিকেটিং হয়েছে। জেলে পাড়া থেকে সঙ বেরিয়েছে। মদ্যপায়ীরা কিন্তু অতীতের কলকাতাকে ভুলতে পারেন না। কলুটোলা, বউবাজার, চিনেবাজার, ড্যামজেন লেন ছিল দেশি আরকের ঠেক।

আরও পড়ুন-কোভিড মন্দা কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন চুরমার, ধনতেরাসের মুখে ধাক্কা বউবাজারের স্বর্ণশিল্পে

কলকাতায় প্রাচীনতম মদের দোকানটি ১৭৭৬ সালে স্থাপিত কলুটোলার ফৌজদারি বালাখানা অঞ্চলে। ক্যাচ ক্লাব, গাজলিং ক্লাব পর্ব পেরিয়ে বেঙ্গল ক্লাব। দামেও সস্তা। বিয়ার বা ওয়াইন আট আনা মাত্রা প্রতিষ্ঠিত হল। ফ্রি-ম্যাসন লজের মতো মদ্যপানের আখড়া। পরবর্তীকালে সিসিএফসি, ক্যালকাটা সুইমিং ক্লাব, টালিগঞ্জ ক্লাবগুলিতে ইংরেজরা বিভেদনীতিই চালিয়ে গেছে। ডগস অ্যান্ড নেটিভস্ নট অ্যালাউড।
বাঙালি কিন্তু এতে দমে যায়নি। তাই স্বাভাবিক কারণে বাঙালিয়ানা বজায় রেখে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ক্যালকাটা ক্লাব কিংবা লেক ক্লাব। সেখানে কালো চামড়া ঢুকতে পারবে কিন্তু ক্লাবের নিয়মকানুন মান্য করে। সভপতি হবেন একবছর সাহেব তো অন্যবছর বাঙালি। আরসিজিসি প্রথম বাঙালি সদস্যপদ নেয় ১৯৪৬ সালে। অন্যান্য ক্লাবগুলি ১৯৫০ নাগাদ। পরে গড়ে ওঠে আউট্রাম ক্লাব, হিন্দুস্তান ক্লাব বা ক্যালকাটা পাঞ্জাব ক্লাব।
একসময় বিলিতি মদের ব্যবসা মূলত ডালহৌসি অঞ্চলেই ছিল এবং ঠিকানা ছিল ট্যাঙ্ক স্কোয়ার। মালিকও বিদেশি। অবশ্য শুঁড়ি সাহারা এই ব্যবসায় অচিরেই নেমে পড়েন। পথিকৃৎ ছিলেন বিশ্বনাথ লাহা, শিবচরণ দত্ত বা এনসি বিশ্বাস। ১৯ শতকেই কলকাতায় বহু অনশপ গড়ে ওঠে। ১৮৭২ সালে মাধবচন্দ্র সাহা প্রতিষ্ঠিত কলকাতার অন্যতম প্রাচীন পানশালাটি এখনও অতিজীবিত। মেট্রোগলির মতি শীল স্ট্রিটের শ-ব্রাদার্স-এর আদরের নাম ছোটা ব্রিস্টল। ষাটের দশকের শেষে মদ্যপানের এই স্বর্গরাজ্য থেকে স্পেন্সেস উঠে গেলেও পার্ক স্ট্রিটের পার্ক হোটেল আত্মপ্রকাশ করে। কেতাদুরস্ত হয়ে সেজে ওঠে এপিজে স্ট্রিট থুড়ি থুক্কি পার্ক স্ট্রিট। দাম একটু বেশি হলেও নব্যবাঙালি ঘাবড়ান না। চুকুচুকু বিলাসিতায় এখানে শহরকে অনেক রঙিন দেখেন। ধোয়া-ধুলো কিছুই নেই যেন!

আরও পড়ুন-খোয়াইহাটে বহু সুবিধাযুক্ত ভ্রাম্যমাণ বাস চালু

একালের বাঙালির সুরাপান পর্বে অনুপ্রবেশ করতে হলে সেকালকে ঠিকঠাক জেনে নিতেই হবে। বিশেষ করে উনিশ শতকীয় বাঙালি সমাজ ফুটে উঠেছে হুতোম প্যাঁচার নকশায়। হুতোম কলকাতার চড়ক পার্শ্বন প্রসঙ্গে লিখছেন, আবগারীর আইন অনুসারে মদের দোকানের সদর দরজা বন্ধ হয়েছে অথচ খদ্দের ফিচ্চে না। এই নিয়ে আপনার মুখ আপুনি দেখ প্রহসনে দোকানের পেছনে ছোট দরজার খোঁজ মেলে। বাবুর কৌতূহল মিটিয়ে একজন জানান দিচ্ছেন, সদর দরজা দিয়া ইতর লোকেরা দুই চার পয়সার মদ কিনে খায় বৈ তো নয়। আমারদিগের মতন কতকগুলিন গৃহস্তগোচ ভদ্রলোকের ছেলেরা যে মাতাল হয়ে উটেচেন, তাহারা মুখে কাপড় জড়িয়ে সেই ছোট দরজা দিয়া দোকানে প্রবেশ করে, এক এক জন এক এক বোতল ধান্যেশ্বরী সহজেই দাঁড়াভোগ দ্যান কিম্বা একেকালে দুই বোতল দুই বগলে নিয়ে চাদর ঢাকা দিয়া বাহির হইয়া আসেন।… সে ছোট দরজা সর্ব্বদাই খোলা থাকে। আইন হলেই তাই ফাঁক থাকে।

আরও পড়ুন-মুখ্যমন্ত্রীর সফরকে ঘিরে মালবাজারে প্রস্তুতি তুঙ্গে

হুতোম এক ব্রাহ্মবাবুর রেলে চেপে মদ্যপানের বৃত্তান্ত জানাচ্ছেন। সেই বাবু… পকেট হতে প্রেসিডেনসি মেডিকেল ল্যাবেল দেওয়া একটী ফায়েল বার করে সিসির সমুদায় আরকটুকু গলায় ঢেলে দিয়ে খানিক মুখ বিকৃত করে রুমালে মুখ পুচে জেব হতে দুড়ুমো সুপুরি বাই করে চিবুতে লাগলেন।
ডাঃ ব্রজনাথ বন্ধু অ্যান্ড কোং অর্থাৎ প্রেসিডেন্সি মেডিক্যাল হল ছাড়াও বহু ডিসপেনসারিতে বে-আইনি মদ বিক্রি হত। ১৮৭৫ সালে প্রকাশিত ডাক্তারবাবু প্রহসনে পেয়েছি, কিবা ফন্দি ডাকতারি বলিহারি যাই/এ হেন শুঁড়ি ভায়ার মুখে দিলে ছাই/নাহি লাগে ঘুসঘাস, নাহি লাইসেন, ডজন ডজন আসে ব্র্যান্ডি শ্যামপেন/ মদকে ওষুধ বলে বেচে দিনরাত/ চেয়ে থাকে এক্সাইজ গালে দিয়ে হাত। শহরে মাতাল বেড়েই চলেছিল। হুতোম বলছেন, সহরের ইতর মাতালদের ঘরে ধরে রাখবার লোক নাই বলেই আমরা নর্দামায়, রাস্তায়, খানায়, গারদে ও মদের দোকানে মাতলামি কত্তে দেখতে পাই। সহরে বড় মানুষ মাতালও কম নাই, শুদ্ধ ঘরে ধরে পুরে রাখবার লোক আছে বলেই তাঁরা বেরিয়ে মাতলামি কত্তে পান না।… ছোটলোক মাতালের ভাগ্যে-চারিআনা জরিমানা, একরাত্তির গারদে বাস-পাহারাওয়ালাদের ঝোলায় শোয়ার হয়ে যাওয়া ও জমাদারের দু এক কোঁৎকা মাত্র, কিন্তু বাঙালী বড় মানুষ মাতালদের সকল বিষয়ে শ্রেষ্ঠ। এই শ্রেষ্ঠত্বের খবর জানাচ্ছে ১৮৬২ সালের সোমপ্রকাশ পত্রিকা, গত ১৮ জ্যৈষ্ঠ এই কলকাতার কলুটোলা নিবাসী একটি ভদ্রলোক বেশ্যালয়ে মদিরাপানে উন্মত্ত হইয়া উপপত্নীর সহিত ছাদের উপর নৃত্য করিতে ছিলেন, নৃত্য করিতে করিতে তাহার উপপত্নী তাহাকে উপহাস করিয়া বলিল তুমি আমাকে কেমন ভালবাস দেখি? তুমি যদি এই ছাদ হইতে লম্ফ দিয়া নীচে পড়িতে পার তবে আমি তোমার চিরকালের দাসী হইয়া থাকিব। বাবুটির মত্ত আনন্দের পরিণতি… মস্তকাস্থি প্রায় ভগ্ন হইয়াছে, হস্তপদাতিতে ক্ষত এবং অস্থিতে চোট লাগিয়াছে, জীবন সংশয়। চিকিৎসার্থে হস্পিটালে আনিত হইয়াছে। এই আমোদের নাম, পাকি হয়ে পড়ে মরা। বারাঙ্গনা গৃহে মানে সোনাগাছি, হাড়কাটা গলি বা কালীঘাটের বেশ্যাপট্টির এমন মদ-কাহিনি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে আলালের ঘরে দুলাল, সমাজ চিত্র, সধবার একাদশী কিংবা মদ খাওয়া বড় দায়, জাত থাকার কি উপায়-এর মতো প্রহসনে। পাঁচালি লিখেছেন দাশরথি রায়। গিরিশচন্দ্র, অমৃতলাল, রজনীকান্ত, মোহিতলাল কে না লেখনী ধরেছেন মদ নিয়ে। রসরাজ অমৃতলাল লিখছেন, আমি আর গুরুদেব যুগল ইয়ার/ বিনির বাড়িতে যাই খাইতে বিয়ার/বিয়ার ফুরায় পর পুনঃ বিয়ার/ তিনশত্রু বধ তবু জানেনা চিয়ার।

আরও পড়ুন-জামতাড়ায় মাটির নিচে অস্ত্র কারখানা খুঁজে পেল এসটিএফ

সংবাদ প্রভাকরের সম্পাদকীয় স্তম্ভে ১২৬৪ সালে বিদ্যোৎসাহিনী সভার সম্পাদক কালীপ্রসন্ন সিংহ মহাশয় লিখছেন, … বারঘোষাকুল সমস্ত রাত্রি মদ্যপান দ্বারা গীতবাদ্যাদির কোলাহলে এত উৎপাত আরম্ভ করে যে ভদ্রলোক মাত্রেই উক্ত পল্লীতে শয়নাগার ত্যাগকরণে বাধ্য হন। মদের সঙ্গে বুজরুক সাধু-সন্ন্যাসীর সংযোগও মেলে। হুতোম জানাচ্ছেন,… সন্ন্যাসী নতুন সরায় মদ ঢেলেই একটি হুহুঙ্কার ছাড়লেন, ক্ষুদে ক্ষুদে ছেলেরা আঁতকে উঠল… এককুশি জল ফেলামাত্র মদ দুদের মত সাদা হয়ে গ্যাল।
তবে এই বুঝরুক সন্ন্যাসীর জারিজুরি ভেঙে দিয়েছিলেন মজলিসের এক অ্যাসিস্ট্যান্ট সার্জন। তাঁর মতে মার্কিন আনিস নামের মদে জল দেওয়া মাত্র সেটা সাদা হয়ে যায় দুধের মতো। এরপর সন্ন্যাসীর করুণ দশা বর্ণনা নিষ্প্রয়োজন।

আরও পড়ুন-খোয়াইহাটে বহু সুবিধাযুক্ত ভ্রাম্যমাণ বাস চালু

সেকাল মানে সেই কাল থেকে এবার ঢুকে পড়া যাক একালে। এখন কলকাতায় উচ্চবিত্ত বাঙালির জন্য যেমন রয়েছে পাঁচতারা মদ্যবিলাসিতা তেমনি হুজুগে ছোকরাদের মদ্যরাজ্য কিছু নাচন কোঁদনের নাইট ক্লাব। বাঙালির চুকুচুকু সংস্কৃতি ভুলিয়ে দেয় সব দুঃখ-কষ্ট আর যন্ত্রণা। নেশার মানচিত্রে পরিক্রমা করতে করতে আলোর মালায় সাজানো পার্ক স্ট্রিটের ড্রিঙ্কিং হাবের দিকে পা-দুটো হাঁটাহাটি করতে থাকে। শহরের বেশিরভাগ পানশালাই এই অঞ্চলে।
এখনও চৌরঙ্গি অঞ্চলের পুরনো পানশালাগুলোর বেশ নামডাক। ওয়েলিংটনের একটি বারে অভিনেতা জহর গাঙ্গুলি নিয়মিত আসতেন। তেমনই বেকবাগানের একটি পানশালা ছিল প্রমথেশ বড়ুয়ার মদ্যক্ষেত্র। তাঁর জন্য বেরোত কাটগ্লাসের পানপাত্র।

আরও পড়ুন-মাল-দুর্ঘটনা ছটপুজোয় সতর্কতা

একদা সুনীল, শক্তি, সন্দীপন, শরৎকুমার, তারাপদ শ্যামবাজারের ভবনাথ সেন স্ট্রিটের ঠেক কিংবা একবালপুরের স্বপ্না গুরুং-এর ঠেক পরিক্রমা করে দেশিমদমনস্ক হয়ে ঠেকেছিলেন খালসিটোলায়। পদধূলি পড়েছিল, কমলকুমার মজুমদার, অমিতাভ দাশগুপ্ত বা শিল্পী পৃথ্বীশ গঙ্গোপাধ্যায়ের। জানবাজারের কাছে বাংলার সেলেব ঠেক বারদুয়ারিতে সগর্বে ঢুকতেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। তেমনি গরচার দত্তবাবুদের ঠেক কিংবা গাঁজা পার্কের বাংলার ঠেকে পান করে অজস্র বাঙালির ফুটপাথ বদল হয়েছে মাঝরাতে। রাত গড়িয়ে বুধসন্ধ্যা হয়েছে বুঁদসন্ধ্যা। কারণ-রসে উথলে উঠেছে তৃষ্ণার্ত বাঙালি মদ্য কনোসিয়র। ফুরফুরে মেজাজে বাকতারাগুলো যে ইয়ার পরিবৃত না হয়ে ঝাড়া যায় না। অরসিকে কী একথা বুঝতে পারবে?
বাঙালির মদ্যপানের ইতিবৃত্ত তাই নানা অধ্যায় থেকে উঠে আসা চেনা অচেনা মদ্যপের মিছিল। ঘটনার পর ঘটনা ঘটেছিল এবং ঘটেই চলেছে।

Latest article