‘ক্ষুদিরামের সহজ প্রবৃত্তি ছিল মৃত্যুর আশঙ্কা তুচ্ছ করে দুঃসাধ্য কাজ করা। তার স্বভাবে নেশার মতো অত্যন্ত প্রবল ছিল সাহস।’
অমর শহিদ বীর ক্ষুদিরাম বসু সম্পর্কে এই মন্তব্য হেমচন্দ্র কানুনগোর। তিনিও ছিলেন অগ্নিযুগের আর এক বিপ্লবী। বয়সে অবশ্য ক্ষুদিরামের চেয়ে বড়। কাজী নজরুল ইসলাম তাঁকে ‘অগ্নিযুগের অস্ত্রগুরু দ্রোণাচার্য’ রূপে অভিহিত করেছেন।
আরও পড়ুন-৪৭ লক্ষ টাকায় পুরসভার উদ্যোগে আলোয় সাজছে দুর্গাপুরের নগরবন
সন ১৯০২ । ক্ষুদিরাম যোগ দিলেন বিপ্লবীদের একটি নবগঠিত দলে। নাম যুগান্তর। সেসময় বিপ্লবী নেতা অরবিন্দ এবং ভগিনী নিবেদিতা মেদিনীপুরে এলেন। জনসম্মুখে বক্তৃতা করলেন। তাঁদের বক্তৃতায় অনুপ্রাণিত ক্ষুদিরাম বিপ্লবে যোগ দিতে দ্বিধা করেননি। পরবর্তী কালে ঋষি রাজনারায়ণ বসুর ভাইয়ের ছেলে সত্যেন্দ্রনাথ বসুর সান্নিধ্য পান। সত্যেন্দ্রনাথ বসু ছিলেন ক্ষুদিরামের শিক্ষক। ১৯০৩-এ ক্ষুদিরাম মেদিনীপুর কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হন। পড়েন অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত।
সন ১৯০৫। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী স্বদেশি আন্দোলনের ঢেউয়ে উত্তাল বাংলা। ক্ষুদিরাম পড়াশোনা ছেড়ে সত্যেন বসুর গুপ্ত সমিতিতে যোগ দিলেন। শিখলেন পিস্তল চালনা। অংশ নিলেন ইংল্যান্ডে উৎপাদিত কাপড় পোড়ানো ও ইংল্যান্ড থেকে আমদানিকৃত লবণ বোঝাই নৌকা ডোবানোর কাজে।
১৯০৬ এর মার্চ মাস। মেদিনীপুরের এক কৃষি ও শিল্পমেলায় বিপ্লবী পত্রিকা ‘সোনার বাংলা’ বিলি করার সময়, ক্ষুদিরাম প্রথম পুলিশের হাতে ধরা পড়েন, কিন্তু পালিয়ে যেতে সমর্থ হন। পরের মাসে আর এক ঘটনা। একই কাজ করার জন্য পুলিশের হাতে ধরা পড়েন। আদালতে বিচার। এবার ছাড়া পেলেন অল্প বয়সের জন্য।
আরও পড়ুন-ইস্তফা দেওয়া পদে ফেরানো হল ঘাটালের সাংসদ দেবকে
১৯০৭। হাটগাছায় বিপ্লবীরা ডাকের থলি লুঠ করলেন। ক্ষুদিরাম সেই দলেও ছিলেন। অন্তত পুলিশের খাতায়। বছরের ৬ ডিসেম্বর নারায়ণগড় রেল স্টেশনের কাছে বঙ্গের ছোটলাটের বিশেষ রেলগাড়িতে বোমা আক্রমণের ঘটনার সঙ্গেও নাকি তাঁর যোগ ছিল। ওই পুলিশের খাতা অনুসারে।
এসব সরকার বিরোধী কাজের জন্য জামাইবাবুর সরকারি চাকরিতে অসুবিধা হচ্ছে। এই সময় তাঁকে আশ্রয় দিয়েছিলেন মেদিনীপুরের উকিল সৈয়দ আব্দুল ওয়াজেদের বোন।
এই সময় ঘটল সেই ঘটনা। কলকাতার প্রধান প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ড আলিপুর আদালত প্রাঙ্গণে ‘বন্দেমাতরম’ ধ্বনি উচ্চারণ করার জন্য সুশীল সেন নামের ১৬ বছরের এক কিশোরকে প্রকাশ্য স্থানে বেত মারার আদেশ দেন। কিংসফোর্ড বিপ্লবীদের ঘৃণার পাত্র হয়ে যান। যুগান্তর বিপ্লবী দলের পক্ষ থেকে ‘কিংসফোর্ড’কে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেয়।
১৯০৮-এ ক্ষুদিরামের কাঁধে দেওয়া হয় বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের অত্যন্ত গুরুদায়িত্ব। সেই কাজে তাঁর সঙ্গী ছিলেন আর এক বিপ্লবী প্রফুল্ল চাকী। মুজফ্ফরপুরের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ডকে হত্যার দায়িত্ব ন্যস্ত করা হয় তাঁদের ওপর। ক্ষুদিরাম ও প্রফুল্ল চাকী বিহারের মুজফ্ফরপুরে পৌঁছন এবং সুযোগ বুঝে কিংসফোর্ডের গাড়ি লক্ষ্য করে বোমা ছোঁডেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় গাড়িতে কিংসফোর্ড ছিলেন না। ওই গাড়িতে ছিলেন আর এক ব্রিটিশ অফিসার প্রিঙ্গল কেনেডির স্ত্রী ও মেয়ে। তাঁরা এই ঘটনায় মারা যান। বেঁচে যান অত্যাচারী কিংসফোর্ড। ক্ষুদিরামকে গ্রেফতার করে ব্রিটিশ পুলিশ।
এরপর বিচারের নামে প্রহসন। মৃত্যুদণ্ড হয় ক্ষুদিরামের। তিনি যেদিন শহিদ হন তখন তাঁর বয়স ছিল ১৮ বছর ৮ মাস ৮ দিন। ১৯০৮-এর ১১ অগাস্ট মুজফ্ফপুর জেলে তাঁকে ফাঁসি দেওয়া হয়। ভারতীয় দণ্ডবিধি ৩০২ ধারা অনুসারে তাকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়েছিল।
ফাঁসির আদেশ শুনে ক্ষুদিরাম বসু হাসিমুখে বলেন যে, মৃত্যুতে তার কিছুমাত্র ভয় নাই। ফাঁসী কার্যকর করার আগে তার শেষ ইচ্ছা কী জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন যে, তিনি বোমা বানাতে পারেন। এর পরিবর্তে দ্বিতীয় ইচ্ছা পূরণের কথা বলা হলে তিনি তাঁর বোন অরূপাদেবীর সাথে দেখা করতে চান। কিন্তু তার জামাইবাবুর বাধায় সে ইচ্ছা পূর্ণ হয়নি। তবে মেদিনীপুরের উকিল সৈয়দ আব্দুল ওয়াজেদের বোন যিনি তাঁকে একদা বোনের স্নেহে আশ্রয় দিয়েছিলেন, তিনি বিপদ মাথায় নিয়ে ক্ষুদিরামের সাথে দেখা করেছিলেন। বিভিন্ন নথিতে এ-বিষয়ে ভিন্ন একটি তথ্য আছে। তদনুসারে, ফাঁসির আগে ক্ষুদিরামের শেষ চারটি ইচ্ছে ছিল। প্রথম, তিনি একবার তাঁর জন্মভূমি মেদিনীপুরকে দেখতে চেয়েছিলেন। দ্বিতীয়, দিদি ও ভাগনে ললিতের সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলেন। তৃতীয়, জানতে চেয়েছিলেন ভাগনি শিবরানির বিয়ে হয়েছে কি না। চতুর্থত, সিদ্ধেশ্বরী কালীমায়ের পাদোদক পান করতে চেয়েছিলেন। এর মধ্যে তিনটে ইচ্ছেই পূরণ হয়নি। ক্ষুদিরামকে শুধু জানানো হয়েছিল শিবরানির বিয়ে হয়ে গিয়েছে।
আরও পড়ুন-সফরের আগেই ফিরল অ্যাডিলেডে ৩৬ অলআউটের স্মৃতি, গোলাপি বলের প্রস্তুতি ম্যাচ ভারতের
ভগবত গীতা হাতে ফাঁসি কাঠের দিকে এগিয়ে গিয়ে হাসিমুখে ফাঁসির দড়ি গলায় পরেছিলেন অকুতোভয় বীর বিপ্লবী ক্ষুদিরাম। আজকের দিনে। ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে। মজফফরপুর জেলে।
ফাঁসি হওয়ার আগের দিন অর্থাৎ ১০ অগাস্ট মেদিনীপুরের নির্ভীক সন্তান ক্ষুদিরাম বসু আইনজীবী সতীশচন্দ্র চক্রবর্তীকে বলেছিলেন, ‘রাজপুত নারীরা যেমন নির্ভয়ে আগুনে ঝাঁপ দিয়া জওহর ব্রত পালন করিত, আমিও তেমন নির্ভয়ে দেশের জন্য প্রাণ দিব। আগামীকাল আমি ফাঁসির আগে চতুর্ভুজার প্রসাদ খাইয়া বধ্যভূমিতে যাইতে চাই।’ ফাঁসির মঞ্চে উপস্থিত হলে তার গলায় ফাঁসির দড়ি পরানো মাত্রই জল্লাদকে তিনি প্রশ্ন করেছিলেন, ‘ফাঁসির দড়িতে মোম দেওয়া হয় কেন?’ শুনে চমকে গিয়েছিল জল্লাদও।