ভারতীয় ভূখণ্ডে বসন্তকালে সেই কবে থেকে যে মানুষ দোলের সময় এক অপরকে রং দিয়ে আসছে তার সন তারিখের হিসেব নথিতে পাওয়া দুষ্কর! তবে খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে মধ্যপ্রদেশের রামগড় গুহালিপিতে খুঁজে পাওয়া যায় হোলি খেলার বর্ণনা। নারদপুরাণ, ভবিষ্যপুরাণ, পদ্মপুরাণ-এও দোল উৎসবের কথা রয়েছে। সপ্তম শতাব্দীর একটি শিলালিপি থেকে জানা যায়, রাজা হর্ষবর্ধন পালন করতেন ‘হোলিকা উৎসব’। বাৎস্যায়নের কামসূত্র-তেও দোলের উল্লেখ আছে। সুলতান মহম্মদ-বিন-তুঘলক দোল খেলতেন হিন্দুদের সঙ্গে। আল-বেরুনির বিবরণে জানা যায় যে, মধ্যযুগে কোনও কোনও অঞ্চলে মুসলমানরা হোলির উৎসবে সংযুক্ত হতেন।বসন্তকালে পূর্ণিমার আলোয় যখন ভেসে যায় ব্রজধাম, তখন রাধা ও তাঁর সখী-গণের সঙ্গে রং খেলায় মেতে ওঠেন কৃষ্ণ। আবার বিভিন্ন পুরাণে এ-কথাও শোনা যায় যে, শ্যামবর্ণ হওয়ায় কৃষ্ণের খুব দুঃখ। অন্য দিকে, রাধা ও তাঁর সখীরা যথেষ্ট উজ্জ্বল বর্ণের অধিকারিণী। অসহায় কৃষ্ণ কী করবেন? যশোদা বললেন, রাধার শরীরে রং মাখিয়ে দাও। তা হলে তাঁর দেহবর্ণ আর বোঝা যাবে না। জ্ঞানদাসের ২৭৬ সংখ্যক পদে দেখতে পাই সেই রং খেলার আনন্দময় রূপ, “মধুবনে মাধব দোলত রঙ্গে/ ব্রজবনিতা ফাগু দেই শ্যামঅঙ্গে/ কানু ফাগু দেয়ল সুন্দরি-অঙ্গে”।
আরও পড়ুন-দিনের কবিতা
দোলের ঠিক আগের দিন হোলিকাদহনের রীতি আছে। পুরাণ অনুয়ায়ী, হিরণ্যকশিপুর পুত্র প্রহ্লাদ ছিলেন পিতার শত্রু বিষ্ণুর ভক্ত। হোলিকা, হিরণ্যকশিপুর বোন। হোলিকার একটি জাদুবস্ত্র ছিল, যা পরলে অগ্নিও তাঁকে স্পর্শ করতে পারত না। হিরণ্যকশিপুর আদেশে প্রহ্লাদকে নিজের কোলে বসিয়ে অগ্নিকুণ্ডে ঢোকেন হোলিকা। অগ্নিকুণ্ডে প্রহ্লাদ বিষ্ণুনাম জপ করতে থাকেন। জাদুবস্ত্র হোলিকার শরীর থেকে খুলে গিয়ে প্রহ্লাদকে রক্ষা করে, এবং হোলিকা আগুনে ছাই হয়ে যান। ‘হোলিকাদহন’-এর মাধ্যমে সমস্ত অশুভ শক্তিকে নাশ করে তার পর আসে দোলের দিন।
সন্ত্রাস, স্বৈরাচার, অন্ধভাব, এই সমস্তই তো অশুভ শক্তির পরিচায়ক-রূপ। সেই অশুভ শক্তির হোলিকাদহন একমাত্র আমাদের মনের ভিতরেই সম্ভব। ভাষাচার্য সুকুমার সেন লিখেছেন, “বসন্ত-উৎসবের একটা অঙ্গ ছিল- এখনও বোধকরি কোথাও কোথাও আছে- খড়কুটো দিয়ে ঘরের বা মন্দিরের মতো করে পুড়িয়ে দেওয়া। হয়তো এই সূত্র ধরেই অর্বাচীন কোনো কোনে স্মৃতিকার ‘হোলি’ শব্দের মূলে এক রাক্ষসী হোলিকার কল্পনা করেছেন।’’ এতে অবশ্য সুকুমার সেন আপত্তিকর কিছু দেখতে পাননি। কারণ, তাঁর মনে হয়েছে, ভারতবর্ষের চিন্তারীতির শৈলীটাই এরকম। এদেশের স্টাইলটাই হল, ভাবকে কল্পনায় নিয়ে এসো। তারপর সেই কল্পনার ভিত্তিতে দেব-দানব, ভাল-মন্দের ছাপ মেরে একটা কাহিনি রচনা করে। ‘এখানে তেমনই ঘটে থাকতে পারে’ ধারণা সুকুমার সেনের। তবে সেই দৃষ্টিকোণ থেকে চিন্তা করলে আজকের ভারতে এই সময়ে দাঁড়িয়ে দোলের অঙ্গ হিসেবে চাঁচর বা হোলিকা দহনের মতো লৌকিক আচারের গুরুত্ব সমধিক।
আরও পড়ুন-দোলযাত্রার আগে শেষ রবিবাসরীয় প্রচার, রঙের ছোঁয়া রাজনীতির আঙিনায়
প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, শ্রীচৈতন্যদেবের আবির্ভাবের আগে শ্রীকৃষ্ণের দোলযাত্রা বলে কোনও ধর্মীয় উৎসব বাংলায় চালু ছিল না। মহাপ্রভুর যেদিন জন্ম হয়, সেই দিনটা তিথির বিচারে ছিল ফাল্গুনী পূর্ণিমা। ‘ফাল্গুন পূর্ণিমা তিথি নক্ষত্র ফাল্গুনি। / শুভক্ষণে জন্মিলা গোরা দ্বিজমণি।।’ যেক্ষণে মহাপ্রভু জন্মগ্রহণ করেন, সেই ক্ষণে চন্দ্রে গ্রহণ লেগেছিল। তাই নবদ্বীপের বাসিন্দারা হরিনাম করতে করতে শাঁখ ঘণ্টা বাজাচ্ছিলেন। চারিদিকে উৎসবে মাতোয়ারা একটা আবহ বিরাজ করছিল। লোকে দলে দলে গঙ্গাস্নান করতে গিয়েছিল। ইতিহাস বলছে, শ্রীচৈতন্যের তিরোভাবের পর রূপ-সনাতন-গোপাল ভট্টের মতো বৈষ্ণব গোস্বামীরা যখন বৈষ্ণবের আচরণীয় বিধিগুলো সংস্কৃতে লেখা বইতে ঢুকিয়ে নিলেন তখনই পশ্চিম ভারতের যে লোক উৎসবের সঙ্গে গান আর ছড়ার সূত্র ধরে কৃষ্ণের প্রেমকথার যে যোগাযোগ ছিল, সেটাকে আঁকড়ে ধরে বাংলায় দোলযাত্রার ব্যবস্থা হল। কিন্তু ভারতের অন্যান্য জায়গায় হোলি স্বতন্ত্র উৎসব হিসেবে রয়ে গেল।
শেষে একটা কথা না বললেই নয়। সেটা এই রচনার শিরোনাম সম্পর্কিত। ‘দোলযাত্রা’, ভাষাবিদরা বলছেন, আসলে ‘দোলা-যাত্রা’। মানে, পালকিতে চেপে ফুর্তি করতে করতে শোভাযাত্রা। ‘যাত্রা’ কথাটার মানে ‘অনায়াস গমন’। সেই হিসেবে, যে উৎসবে দেব-বিগ্রহ কিংবা দেব পুজারিরা আনুষ্ঠানিকভাবে এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় গমন করেন, সেটাই ‘যাত্রা’। যেমন রথযাত্রা, স্নানযাত্রা ইত্যাদি। অশোক তাঁর অনুশাসনে ফলাও করে ‘বিহারযাত্রা’র কথা লিখে গিয়েছেন। সাড়ম্বরে তিনি বৌদ্ধবিহারে যেতেন। কোনও কোনও ইতিহাসবিদ মনে করেন, ওই ‘বিহারযাত্রা’ দোলা-লীলার মতোই বসন্ত-বিহার। জঙ্গম দোলা স্থাবরে পরিণত হয়ে আমাদের দোলযাত্রার রূপ নিয়েছে। এমনটাই অভিমত সুকুমার সেনের।
আরও পড়ুন-রিঙ্কুকে বিশেষ উপহার শাহরুখের
যে রং মানুষকে মিলিয়ে দেয়, তাদের সম্মিলিত করে, সেখানে পাপ কীসের, এমন প্রশ্ন তুলেছেন আর কেউ নন, ইসলাম ধর্মের সাধক কবিরা। নিজামুদ্দিন আউলিয়া, বুল্লে শাহ, আমির খসরু— অনেকের লেখাতেই ছড়িয়ে গিয়েছে হোরিখেলার রং। আর কেবল সুফি সাধকেরা নন, এই উৎসব থেকে সরে থাকেননি বিজাতীয় শাসকেরাও। নতুন দেশে এসে সেই দেশের মানুষকে চিনতে চিনতে, তাদের সংস্কৃতিকেও আপন করে নিয়েছিলেন অনেক মুসলমান নবাব। রুক্ষ দেশ থেকে এদেশে এসে হোলির সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন প্রথম মুঘল সম্রাট বাবর। আর আকবরের আমল থেকে মুঘল রাজপরিবারও অংশ নিতে শুরু করল এই উৎসবে। পরবর্তী সম্রাট জাহাঙ্গিরের জীবনী ‘তুজুক-ই-জাহাঙ্গিরি’-তেও মেলে জাহাঙ্গির আর নূরজাহানের রঙের খেলায় মেতে ওঠার বর্ণনা। আর শাহজাহানের আমলে তো হোলির নতুন নাম হল, ‘ঈদ-ই-গুলাবি’ আর ‘জশন-ই-আব-পাশি’। জাতের বেড়া ঠেলে মিলনের উৎসব হয়ে উঠল হোরিখেলা। এমনক পরবর্তী কালে উর্দু কবিতায় তৈরি হয় ‘হোরি’ নামের একটি নতুন ধারা। রাধাকৃষ্ণের অনুষঙ্গ থেকে চৈতন্যদেব মিশে আছেন যে উৎসবে, সেই উৎসবই আবার হয়ে উঠেছে নবাব অর্থাৎ মুসলমান শাসকদেরও। হোলি তাই নেহাতই রং মাখার উৎসব নয়। বরং বিভাজনের রং মুছে ফেলে সম্প্রীতির আবিরে রেঙে ওঠারই লগ্ন।
যে কিশোর বা কিশোরী আজকের দিনে সকালবেলায় রং খেলবে বলে বেরোল— সেও যেন কোনও নির্দিষ্ট রংকে মুঠোয় তুলে নিতে ভয় না পায়, যেন দ্বিধা না করে। এটা আমাদের সবাইকে নিশ্চিত করতে হবে।