আধ্যাত্মিক মানবতাবাদী একজন মহামানব। কেবল হিন্দু ধর্মমতভিত্তিক সাধনাতেই নিজেকে আবদ্ধ রাখেননি, তিনি ইসলাম ও খ্রিস্টধর্মের আরাধনা পদ্ধতিকেও জানার চেষ্টা করেছেন। সমুদয় ধর্মসাধনার মাধ্যমে ঈশ্বরকে উপলব্ধির সেই প্রয়াসের পেছনে ছিল একটাই বিশ্বাস। সকল ধর্মই সত্য, যত মত তত পথ। সবমিলিয়ে শ্রীরামকৃষ্ণ (Ramakrishna Paramahansa) ছিলেন লোকগুরু। ধর্মের কঠিন তত্ত্বকে সহজ করে বোঝাতেন তিনি। বলতেন, ঈশ্বর রয়েছেন সকল জীবের মধ্যে, তাই জীবসেবাই ঈশ্বরসেবা। ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দের ১৬ আগস্ট কলকাতায়, শ্রাবণের শেষ দিনে কাশীপুরে তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন।
কথামৃতর রচয়িতা মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত লিখেছেন, ঠাকুর দশ মাস ধরে ভুগেছিলেন, গলায় ঘা হয়েছিল, ভক্তেরা সেবা করে পরিশ্রান্ত, ‘‘ডাক্তারের হাত ধরে কাঁদতেন, ভাল করে দাও বলে’’ এবং শেষকালে বলতেন, ‘‘মা আমার শরীর রাখবেন না।’’ ব্যাস! ওইটুকুই। কথামৃত-য় শেষ বিবরণ ২৪ এপ্রিল ১৮৮৬। লীলাপ্রসঙ্গ-রচয়িতা স্বামী সারদানন্দও কাশীপুরের শেষ অসুখের দিনগুলির বিবরণ লেখেননি। অথচ শ্রীম ও স্বামী সারদানন্দ যে ঠাকুরের দেহাবসানের পরে কাশীপুরে উপস্থিত ছিলেন, তার প্রমাণ বেঙ্গল ফটোগ্রাফার্স-এর ১৬ অগাস্ট ১৮৮৬ তারিখের তোলা ছবিতে রয়েছে।
দক্ষিণেশ্বরে অনেক দিন শ্রীরামকৃষ্ণের শরীর-স্বাস্থ্য বেশ ভালই ছিল। সুস্থ অবস্থায় তিনি আধসের থেকে দশ ছটাক চালের ভাত খেতেন। ব্যাধি বলতে আমাশয়। আর ছিল বায়ুবৃদ্ধি রোগ। কবিরাজদের পরামর্শ মতো ছিলিমের ভেতর ধানের চাল ও মৌরি দিয়ে তামাক খেতেন। তাঁর গলা থেকে প্রথম রক্তক্ষরণ অগাস্ট ১৮৮৫। ডাক্তারি ভাষায় এর নাম ‘ক্লার্জিম্যানস থ্রোট’। প্রখ্যাত ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার তাঁকে দেখেন ২ সেপ্টেম্বর ১৮৮৫ এবং পরের মাসে (১২ অক্টোবর) নিয়মিত চিকিৎসা শুরু করেন। তাঁরই সিদ্ধান্ত, রোগটা ক্যানসার, কবিরাজি ভাষায় রোহিণী রোগ।
২৫ মার্চ ১৮৮৬ মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ ডাঃ জে এম কোটস এসেছিলেন তাঁকে দেখতে।
বিখ্যাত ডাক্তার রাজেন্দ্রনাথ দত্ত এলেন ৬ এপ্রিল ১৮৮৬। এঁকে ঠাকুর জানিয়েছিলেন, ছোটবেলায় তাঁর পিলের চিকিৎসা হয়েছিল। কাশীপুরে মাঝে মাঝে রাঁধুনির অনুপস্থিতিতে রাঁধতেন ভক্ত তারক (পরবর্তী কালের স্বামী শিবানন্দ)। এক দিন খাবারের গন্ধ পেয়ে ঠাকুর বললেন, ‘‘আমার জন্য একটু চচ্চড়ি নিয়ে আয়।’’
আসন্ন দেহত্যাগের আশঙ্কা বুঝতে পেরে ঠাকুর তাঁর সহধর্মিণীকে বলেছিলেন, ‘‘তুমি কামারপুকুরে থাকবে, শাক বুনবে। শাকভাত খাবে আর হরিনাম করবে।… কারও কাছে একটি পয়সার জন্য চিতহাত কোরো না, তোমার মোটা ভাতকাপড়ের অভাব হবে না।’’
আরও পড়ুন-মেয়র-সিপিকে আমন্ত্রণ না জানানোয় ক্ষুব্ধ মুখ্যমন্ত্রী
রবিবার ১৫ অগাস্ট ১৮৮৬, কাশীপুরে শ্রাবণের শেষ দিনে ঠাকুর শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ (Ramakrishna Paramahansa) ‘বেশ ভাল’। বাগবাজারের রাখাল মুখার্জি এসেছেন কাশীপুরে উদ্যান বাড়িতে। সাহেবি ধরনের মানুষ, শ্রীরামকৃষ্ণের জীর্ণ শরীর দেখে তিনি ডাক্তারের পরামর্শ নিয়েছেন এবং জেনেছেন, মুরগির জুস খেলে ঠাকুরের শরীরে বল হবে। তিনি ঠাকুরকে মুরগির জুস খাওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করতে লাগলে ঠাকুর বললেন, ‘খেতে আপত্তি নেই, তবে লোকাচার। আচ্ছা, কাল দেখা যাবে।’
ওদিকে সারদামণিকে বললেন, ‘এসেছো? দ্যাখো আমি যেন কোথায় যাচ্ছি। জলের ভিতর দিয়ে অ-নে-ক দূরে।’ সারদামণিকে কাঁদতে দেখে বললেন, ‘তোমার ভাবনা কি? যেমন ছিলে তেমন থাকবে। আর এরা আমায় যেমন করছে, তোমায় তেমন করবে।’
বৈকুণ্ঠনাথ সান্যাল লিখেছেন, ‘‘আজ ভাতের পায়স খাব’’ শুনে সকলে আশ্বস্ত। কিন্তু ওই দিনেই ঠাকুরের সেই বিখ্যাত উক্তি— ‘‘ভিতরে এত ক্ষিধে যে হাঁড়ি হাঁড়ি খিচুড়ি খাই, কিন্তু মহামায়া কিছুই খেতে দিচ্ছেন না।’’ শেষের সেই দিনে সেবকদের জন্য শ্রীমা যে খিচুড়ি রাঁধছিলেন, তার নিচের অংশ ধরে গেল।
বিকেলের দিকে পরিস্থিতির পরিবর্তন হওয়ায় ভক্ত শশী (পরবর্তী কালে স্বামী রামকৃষ্ণানন্দ) কয়েক মাইল দৌড়ে গিয়ে ডা. নবীন পালকে ধরে নিয়ে এলেন। ঠাকুর বললেন, ‘‘আজ আমার বেশ কষ্ট হচ্ছে।’ ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘সারবে?’’ ডাক্তার নিরুত্তর।
তখন প্রায় রাত ন’টা। হঠাৎ ঠাকুরের সমাধি। নরেন সবাইকে ‘হরি ওঁ তৎসৎ’ কীর্তন করতে বললেন। সমাধি ভঙ্গ হল রাত প্রায় এগারোটায়। সেবক শশীর ইংরেজিতে রাখা নোট অনুযায়ী, ‘পুরো এক গ্লাস পায়েস পান করেন।’ তার পর ঠাকুর নাকি বলেন, ‘আঃ শান্তি হল। এখন আর কোনও রোগ নেই।’
স্বামী অভেদানন্দ এবং স্বামী রামকৃষ্ণানন্দ ঠাকুরের শেষ মুহূর্তের বিস্তারিত বিবরণ রেখে গিয়েছেন— ‘‘একটা বাজিলে অকস্মাৎ তিনি একপাশে গড়াইয়া পড়েন। তাঁহার গলায় ঘড়ঘড় শব্দ হইতে থাকে। নরেন তাড়াতাড়ি তাঁহার পা লেপে ঢাকিয়া ছুটিয়া সিঁড়ি বাহিয়া নীচে নামিয়া যান। এ দৃশ্য তিনি সহিতে পারিতেছিলেন না। নাড়ি বন্ধ হয়ে গিয়েছে, আমরা সকলে ভাবিলাম, উহা সমাধি।’’
১৬ অগাস্ট ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকারের দিনলিপি, ‘‘খাওয়াদাওয়ার পর প্রথমে ডাফ স্ট্রিটে যাই এক রোগিণীকে দেখতে, তারপর পরমহংসের কাছে। তিনি মৃত। গত রাত্রে একটার সময় তাঁর দেহাবসান হয়েছে, He was lying on the left side legs drawn up, eyes open, mouth partly open,…।’’
অন্তিম শয়ানে রামকৃষ্ণের ছবি। বিদেশি সন্ন্যাসী গবেষক স্বামী বিদ্যাত্মানন্দের টীকা— ‘শ্রীরামকৃষ্ণের (Ramakrishna Paramahansa) পার্থিব শরীর একটি সুসজ্জিত খাটের উপর শয়ান। কিঞ্চিৎ বাম দিকে কাত হয়ে। মুখমণ্ডল অতীব শীর্ণ। চক্ষুদ্বয় অর্ধনিমীলিত এবং বাহুদ্বয় দেহের উপর স্থাপিত। দক্ষিণপদ বামপদের উপর ন্যস্ত। ললাটের উপর চন্দনের প্রলেপ এবং কণ্ঠে মাল্যরাজি। খাটটি ফুল ও মালা দিয়ে ঢাকা, খাটের চারকোণে মশারি টাঙানোর চারটি ছতরি। পশ্চাতে কাশীপুর উদ্যানটির কিয়দংশ দৃশ্যমান। বাঁ দিকে বিছানার একটা স্তূপ দেখা যাচ্ছে। সম্ভবত ঠাকুরের ব্যবহৃত, রৌদ্রে দেওয়া হয়েছে। প্রায় পঞ্চাশের বেশি ভক্ত ও সুহৃদ খাটের পিছনে দাঁড়িয়ে আছেন।’