অনেক তো দিন গেল বৃথাই সংশয়ে এসো এবার দ্বিধার বাধা পার হয়ে

“মারবও না, কাটবও না, আপনাদের মতো ভাষা বিকৃতও করব না। যে ভাষায় আপনারা কথা বলেন, সেই ভাষায় আমরা কথা বলি না। তাই পরিষ্কার বলি, যদি না থামেন, তবে আগামী দিনে আপনাদের থামতে কী করা দরকার, সেটা বুঝে নেবেন।” হুঁশিয়ার করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কোথাও বাঙালিদের উপর অত্যাচার হলে বাংলার পাশাপাশি সেখানে গিয়েও প্রতিবাদ হবে, সে-কথাও জানিয়ে দিয়েছেন তিনি। বাংলা ও বাঙালির এই আওয়াজ কলমে তুললেন পার্থসারথি গুহ

Must read

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘কাদম্বিনী’ ‘মরিয়া’ প্রমাণ করেছিল ‘সে মরে নাই’। অনুরূপভাবে, ডবল ইঞ্জিনশাসিত রাজ্যে- রাজ্যে বিজেপি প্রতিদিন বাঙালিদের মেরে ও তাড়িয়ে প্রমাণ করে চলেছে, তাদের বাংলা ও বাঙালি-বিদ্বেষ এতটুকু মরেনি।
রাজ্য বিজেপির নয়া সভাপতির সংবর্ধনা মঞ্চে যতই কালীঘাটের কালীর ছবি থাকুক, আর সেই সভাপতির বচন যতই রবীন্দ্র- জীবানানন্দে কিংবা সুনীল-শক্তিতে ভেজা হোক, বিজেপি আছে বিজেপিতেই।
৭ জুলাই, ২০২৫। ঝাড়সুগুড়া জেলায় ৪৪৪ জন বঙ্গভাষী পরিযায়ী শ্রমিককে আটক করল ওড়িশা পুলিশ। নদিয়া, মুর্শিদাবাদ, মালদা, পূর্ব মেদিনীপুর, বীরভূম, পূর্ব বর্ধমান ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা থেকে তাঁরা প্রতিবেশী রাজ্যে গিয়েছিলেন জীবন-জীবিকার তাগিদে। তাঁদের অপরাধ তাঁরা বাংলায় কথাবার্তা বলছিলেন। বিস্তর নথিপত্র দাখিল করে তাঁদের প্রমাণ করতে হয় বাংলায় কথা বলছেন বলেই তাঁরা বাংলাদেশি নন, ভারতীয় নাগরিক।
পরদিন, অর্থাৎ ৮ জুলাই দিল্লির বাঙালি অধ্যুষিত জয় হিন্দ কলোনির জল ও বিদ্যুৎ সংযোগ কেটে দেওয়া হল। অজুহাত হিসেবে দেখানো হল মে মাসের একটি রায়। বিদ্যুৎ চুরির অভিযোগের প্রেক্ষিতে দিল্লির একটি দেওয়ানি আদালত কলোনিটিতে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন করার পক্ষে রায় দেয়। আর সেই রায়কে ঢাল করে দিল্লির বিজেপি প্রশাসনের অমানবিক পদক্ষেপ। বিজেপি ভুলে গেল, এই বাঙালি-অধ্যুষিত জয় হিন্দ কলোনি গড়ে উঠেছিল লালকৃষ্ণ আদবানির সহায়তায়। এখন এই কলোনির বাসিন্দাদের অপরাধ হয়ে দাঁড়িয়েছে তাঁদের মাতৃভাষা ও ধর্মীয় পরিচয়। জয় হিন্দ কলোনির বাসিন্দারা বাংলা ভাষাভাষী এবং অধিকাংশই মুসলমান। সুতরাং, ন্যূনতম নাগরিক স্বাচ্ছন্দ্য কিংবা মৌলিক অধিকার তাঁদের জন্য নয়।
১১ জুলাই, ২০০৫। অসমের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত বিশ্বশর্মা ঘোষণা করে দিলেন, ২০১১-র জনগণনার সময় যাঁরা নিজেদের মাতৃভাষা বাংলা বলে জানিয়েছেন, তাঁরা প্রত্যেকে বাংলাদেশি হিসেবে চিহ্নিত হবেন।
লক্ষ্যণীয়, উল্লিখিত তিনটি রাজ্যেই ডবল ইঞ্জিন চালিত সরকার বর্তমান। এবং প্রতি ক্ষেত্রেই বিজেপি সরকার বঙ্গভাষীদের বিদেশি বলে দাগিয়ে দিতে অতি-তৎপর।
এ জিনিস নতুন কিছু নয়।
২০২০-র জানুয়ারি মাসের কথা। বিজেপি নেতা কৈলাস বিজয় বর্গীয়ের বাড়িতে কাজ করছিলেন কয়েকজন বাংলা ভাষা-ভাষী মিস্ত্রি। কৈলাস খাদ্যাভ্যাস দেখেই বুঝে যান, ওঁরা বাংলাদেশি। মিস্ত্রিরা চিঁড়ে খেত। চিঁড়ে খাওয়া আর বাংলায় কথাবার্তা বলা, এই মাপকাঠির ভিত্তিতে কৈলাস ধরে নেন ওঁরা বাংলাদেশি। বাঙালিকে এভাবে চেনাও নতুন নয়। বিজেপিশাসিত রাজ্যে একটা ফর্মুলা মেনে বাংলাদেশি শনাক্ত-প্রক্রিয়া চলছে। বাংলাভাষী হলেই বাংলাদেশি + বাংলাদেশি হলেই মুসলমান = বাঙালি মুসলমান মানেই বাংলাদেশি। অসমে বাঙালিবিদ্বেষ ঐতিহাসিক সত্যের পর্যায়ে পৌঁছেছে।

আরও পড়ুন-আজ উদ্বোধনে মুখ্যমন্ত্রী

সেখানে উত্তমকুমার ব্রিজবাসী, আরতি ঘোষ, কেউই মুসলমান নন। বাংলাভাষী হিন্দু। তাই বাংলাদেশি। নিজেদের ভারতীয় প্রমাণ করার দায় তাঁদের। ‘বঙ্গালি খেদা’ সফল করার জন্য তাঁদের রাষ্ট্রহীন নাগরিকের তকমা দিয়ে ডিটেনশন ক্যাম্পে পাঠানোর ‘কৃতিত্ব’টুকু অসম সরকারের। আসলে পুরাতন ‘বঙ্গালি খেদা’ কর্মসূচি কেন্দ্রের তরফে আইনি মদত পেয়ে ইদানীং বেপরোয়া। এনআরসি বাংলা-বিরোধী উনুনের আঁচে বাতাস দিয়েছে।
দেশভাগের সময় বহু বাঙালি উদ্বাস্তু যেমন পশ্চিমবঙ্গে ঠাঁই নিয়েছেন তেমনই অসমেও নিয়েছেন। এই অসহায় উদ্বাস্তু বাঙালিদের শরণার্থী ও অনুপ্রেবেশকারী, এই দু’ভাগে ভাগ করে দেওয়ার খেলা খেলছে বিজেপি। ‘বুড়া লুইতে’র বুকে ১৯৮৩-র সংগঠিত দাঙ্গায় হাজার হাজার বাঙালির রক্ত চুঁইয়ে পড়েছিল। আমরা ভুলিনি। যেমন ভুলিনি, নেল্লি গণহত্যার কথা। স্বাধীনতার পরে ভারতবর্ষে সংগঠিত সর্ববৃহৎ গণহত্যা ছিল সেটি। এখন সেই গণহত্যার দিনগুলোকেই বিজেপি ফিরিয়ে আনতে চাইছে এনআরসি-র আঁচল ধরে। তবে এবার ছকটা কিঞ্চিৎ আলাদা। সরাসরি রক্তপাত নয়। রক্তপাতহীন রাষ্ট্রহীনতার নিশ্চিতকরণ। জাতীয় নাগরিক পঞ্জির চূড়ান্ত তালিকা থেকে বাঙালিকে বাদ দেওয়ার আয়োজন। সেই আয়োজনের ফল ইতিমধ্যেই প্রকটিত উত্তমকুমার ব্রিজবাসী, আরতি ঘোষদের ঘটনায়।
হেমন্ত বিশ্বশর্মা সাফ বলেছেন বিজেপি শাসিত রাজ্যসমূহে এসব কথা স্পষ্টভাবে সেখানকার সাংবিধানিক প্রশাসনিক প্রধানরা বলতে পারেননি। কিন্তু প্রকল্পটা একই।
প্রথমে বাংলাভাষীদের বাংলাদেশি বলে দাগিয়ে দাও। মুসলমানদের বেশি করে বাংলাদেশি তকমা দাও। আর ব্যাপারটায় বিশ্বাসযোগ্যতা আনার জন্য বাদ দিও না হিন্দুদেরও। তারপর তাদের সব্বাইকে ‘রাষ্ট্রহীন’ করে ছেড়ে দাও। কেড়ে নাও তাদের সম্ভ্রম, অধিকার এবং আশ্রয়। নিরাশ্রয়, অনাগরিক করে তোল তাদের। কারণ, এরাই বারবার ভোটে আমাদের বাংলা থেকে তাড়িয়েছে।
কারণ, এরাই বারবার ভোটে ফিরিয়ে আনছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে।
এই সমীকরণেই এবার ছিন্নমস্তা রাজনীতির কোপে বিজেপি। যে মতুয়া সম্প্রদায়ের পীঠস্থানে পা রেখেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, সেই মতুয়াদের বিজেপিশাসিত মহারাষ্ট্র পুলিশি হেনস্থার মুখে পড়তে হচ্ছে। যদিও বাঙালির হাত ছাড়বে না বাংলার তৃণমূল কংগ্রেস। পুণেতে দুর্দশাগ্রস্ত পরিবারের পাশে বাংলার মা-মাটি-মানুষ। হঠাৎ রাজ্যে-রাজ্যে বাঙালি বিদ্বেষ কেন? নবীন পট্টনায়কের আমলে তো ওড়িশায় এই সমস্যা ছিল না।
অরবিন্দ কেজরিওয়ালের জমানায় দিল্লিতে জয় হিন্দ কলোনিতে প্রশাসনের এরকম দানবিক তৎপরতা দেখা যায়নি। এমনকী অসমে, যেখানে ‘বঙ্গাল খেদা’ কোনও নতুন স্লোগান নয়, সেখানেও হেমন্ত আসার আগে সাম্প্রতিক অতীতে বাঙালি এমন জীবন-মরণ বিতাড়নের সমস্যায় পড়েনি।
তবে এখন কেন?
এর উত্তর একটাই।
বিজেপি।
বিজেপির শাসন মানেই বাঙালি নির্যাতন।
বিজেপির শাসন মানেই বাঙালি বিতাড়ন।
বিজেপির শাসন মানেই বাংলাভাষীকে বাংলাদেশি তকমা দান। এই প্রতিবেশে হুমায়ুন আহমেদ-এর কথা ভীষণ মনে ধাক্কা দিচ্ছে। ‘আমাদের সমস্যা হচ্ছে আমাদের যখন গুছিয়ে কথা বলা দরকার তখন টেলিগ্রাফের ভাষায় কথা বলি। আর যখন সার সংক্ষেপ বলা দরকার তখন পাঁচশো পৃষ্ঠার উপন্যাস শুরু করি।’
আর কালানৌচিত্য দোষে দুষ্ট হয়ে বসে থাকলে আমাদের চলবে না।
‘এখনও যদি ঘরে বসে নিজেকে বাঁচাই, যদি বাধা না-দিই, তত্ত্ব করি কী হল কার দোষে, যদি না আটকাই, আজ না-যদি ঝাঁপিয়ে পড়তে পারি’ আমাদের সমস্ত বাঙালি অস্মিতা আজ থেকে আত্মহত্যাকারী।

Latest article