টস

ঝন্টুর আফসোসের শেষ নেই। ‘ধুস কোনও মানে হয়! আমি এত কোপ মারি রোজ! কিন্তু ভাগ্য ফিরল কই? অথচ মাছ বাজারের ছকু এক কোপেই রাজা!

Must read

চন্দন চক্রবর্তী
ঝন্টুর আফসোসের শেষ নেই। ‘ধুস কোনও মানে হয়! আমি এত কোপ মারি রোজ! কিন্তু ভাগ্য ফিরল কই? অথচ মাছ বাজারের ছকু এক কোপেই রাজা!
আজ আবার রোববারের বাজার। বাজারের সামনেই নটুর মুরগির দোকান। সেখানেই ঝন্টু দীর্ঘদিন কাজ করছে। রোগাটে গড়ন। কালো হাফ প্যান্ট, হাতকাটা ফুটোফাটা গেঞ্জি। তাতে ছিটছিটে রক্তের দাগ।
কোপ মেরেই চলে। মুন্ডুকাটা মুরগিকে ডান পায়ে চেপে ধরে। খানিক ছটছট ডানা ঝাপটা মারে। থির থির কাঁপে। তারপরে ছাল ছাড়াতে শুরু করে ঝন্টু। খদ্দেরের চাহিদা অনুযায়ী পিস করে কালো প্লাস্টিকের প্যাকেটে ভরে দেয়।
আরও পড়ুন-মঞ্জরী
একই কাজ করে বাজারের ছকু। রকমারি মাছ আনে। আঁশ ছাড়ায়। বিশাল বঁটিতে ঘ্যাঁচ ঘ্যাঁচ পিস করে। ওর গায়ের গেঞ্জিতে ফুটো নেই। কিন্তু ছিট ছিট রক্তের দাগ জমে রোজ। তবে ছকু দেখতে সুন্দর। ফর্সা রঙ সাহেবের মতো। গলায় সোনার চেন। মাছ বাজারে সবচেয়ে বড় এবং বড়লোক মাছদোকানি। শ্বশুরের পয়সায় ব্যবসা। বড় বড় মাছের অর্ডার থাকে। হোটেল ক্যান্টিনে সাপ্লাই করে। ও মালিকও বটে। তবে ঝন্টুর মতো কোপ মারার কাজই তো করে!
মাচা মতো করা উঁচুতে বসে নটু। বলে— সবই কপাল রে! বাজারের লটারি দোকান থেকে আমিও টিকিট কিনি! কিন্তু…
ঝন্টু কালো ন্যাকড়ায় হাত মোছে। গাল চুলকাতে চুলকাতে বলে, আমিও তো কিনি… অথচ দেওয়ালি বাম্পারটা ও শালা মেরে দিল! পাঁচ কোটি বলে কথা!
ছুটির দিনে বাজার গরম। বাঙালি সবচেয়ে বেশি আনন্দ পায় এই বাজারে। বিশেষ করে মাছবাজারে। কত পরিচিত মুখের দেখা মেলে। আমাদের আবাসনের কাছেই বাজার। সারা সপ্তাহের গাড়ির কাচ ঢাকা মুখগুলো এইদিন হাসি মুখ খোলে— দাদা, কেমন আছেন? ছেলের খবর কী? —ভাল। ইলিশের দাম শুনেছেন?
—আপনার চিন্তা কী! ছেলে তো ডলার পাঠায়! দুটো হা হা হাসি ধাক্কা খায়।
আজ যেন বাজারে চনমনে ভাবটা বেশি। আফজলের ফল দোকানের দিকে এগোলাম। গিন্নির ড্রাই ফ্রুটস শেষ। চায়ে চুমুক দিতে গিয়েও থমকে যায়। চায়ের দোকানের বাচ্চাকে চিৎকার করে আফজল বলে
—আর এক কাপ দে।
বললাম,  চিনি ছাড়া লিকার।
হাফ প্যান্ট পরা ছেলেটি কিছুক্ষণের মধ্যে কাগজের কাপে চা নিয়ে এল। চোখে মুখে খুশির ঝিলিক, ‘চাচা, শুনছ, মাছ বাজারে পাঁচ কোটি টাকার লটারি লাগছে।’
চায়ে চুমুক মেরে আমার দিকে তাকাল।
—সবই কপাল দাদা।
ট্যাঁক থেকে এক গোছা টিকিট বার করে দেখায়, —সবই ভোগে।
হঠাৎই মনে পড়ল। ডালহৌসির সেই লটারি টিকিট বিক্রেতার কথা। সামনে দিয়ে গেলেই টিকিট গছাত। তখনকার দিনে পঞ্চাশ একশো টাকার বেশি ওঠেনি।
ছেলেটি হাঁ।
—এমনিতে ছকুদা কত বড়লোক! আরও কত বড়লোক হয়ে যাবে। আচ্ছা, চাচা পাঁচ কোটি মানে কত টাকা?
—সে অনেক রে পাগলা। গুনতে মেশিন লাগবে।
ওর অবাক কিশোর চোখে যেন বিশাল এক একতেল ঘুড়ি। লাট খাচ্ছে।
—বাবাঃ, টাকা গুনতেও মেশিন!
কাজু আখরোট নিয়ে হাঁটা লাগালাম। ভাবনা লাট খায়। ফাটকা খেলা বরাবরই ছিল। এখন যেন বেড়ে গেছে। সেই শকুনিকে দিয়ে পাশা  খেলাও তো এক ধরনের ফাটকা খেলা ছিল।
ছেলেটির নাম বাবলা। বয়স্কা মা আর ব্যাটার সবজি দোকান। ছিটেবেড়ার অস্থায়ী, মাথায় প্লাস্টিকের ছাউনি। অভাব যেমন বাগ মানে না। সুযোগ পেলেই সংসার-শরীরে ঢুকে পড়ে। তেমনি ফুটোফাটা ছাউনি বেয়ে অক্লেশে রোদ-জল ঢুকে পড়ে। অথচ ছেলেটি লেখাপড়ায় ভাল ছিল। হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করে কলেজে পড়ার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু এখানেও এক কোপে সব চুলোয় গেল। রিকশা চালক বাবা। হঠাৎই সাত দিনের জ্বরে মরে গেল। তা-ও ওর মা চেষ্টা করেছিল। একা দোকান চালাচ্ছিল। কিন্তু শরীর সাথ দিল না। হাত কাঁপে। চোখে জল কাটে। হিসেব ঠিক করে করতেও পারে না। বাধ্য হয়ে লেখাপড়ার স্বপ্ন জলাঞ্জলি দিয়ে এই দোকান চালায়। ব্যবসা বেড়েছে। পাকা দোকানঘর হলে ব্যবসা বাড়বে।
মায়ের গালে হাত।
—কবে যে পাকা ঘর পাব কে জানে?
—এবারে হবে মা। ছকুদা লটারি জিতছে।
—তাতে তোর কী? ওসবের নেশা ভাল নয় রে।
—ধুস সেকথা না। ছকুদা মান্যগণ্য লোক হবে। নিশ্চয়ই বাজারের দিকে নজর দিবে। বাজার কমিটির সেক্রেটারি। তাই পার্টির লোকজনের সাথে কথা-টথা বলবে। এখন তারা শুনবে।
—বললাম তবে তো ভালই হল।
—ছকুদা লোক ভাল। এমনিতেই লোকের বিপদে পাশে দাঁড়ায়। বাবা মরে যাবার পর টাকা দিয়ে পাশে দাঁড়িয়েছিল। টাকা ফেরত নেয়নি। বলে কিনা ধুস লাগবে না! পারলে পরে দিবি তার কী!
বাজার ফেরত আজকের ছকুর চেহারা দেখার ইচ্ছে হল। মাছ বাজারে ছকুর দোকানের সামনে যেন আরও ভিড়। হঠাৎই ছকু হিরো। বেশিরভাগ আমাদের আবাসনের লোক। ছকু বেশ খুশি খুশি। খুশি এমনই বস্তু তা বাইরে প্রকাশ পেয়ে যায়। কারও কম বা বেশি। ডুমের আলোতে মাছগুলোর সাথে গলার সোনার চেনটা চকচক করে ঝিলিক মারে। ফর্সা রং যেন আরও খোলতাই হয়েছে। শোনা যাচ্ছে ওর লটারি বৃত্তান্ত। লেখক মানুষ। গল্পের গন্ধে একটু এগোলাম। আবাসনের ব্যানার্জিবাবুর গলাতেও সোনার চেন। তবে জেল্লাতে কিছুটা আজ পিছিয়ে। হাসতে হাসতে বলল, ‘এবারে রাজনীতিতে নেমে পড়ো।’
|| ২ ||
মোটামুটি এই ছিল মাছ বাজারে লটারি বৃত্তান্ত। তোলপাড়-করা নদীর বান চলে গেলে যেমন নদী শান্ত হয়ে যায়। বাজারও তেমন থিতিয়ে গেল। কিন্তু থিতিয়ে গেল কোথায়? লটারি পাওয়া অনেকটা মাছের টোপের মতো। জলের ভাঙাল কমে গেলে আবার টোপের লোভে চলে আসে। তা সামলাবে কী করে?
বাজারের উন্নতি করতে হলে এই টোপ ছাড়া উপায় নেই। বাবলার ওপর দায়িত্ব ছকুকে বোঝানো। সে সহজে বোঝে না।
—ধোস! ওসব হ্যাপাতে নেই।
—আরে হ্যাপার কী আছে। আমরা সব বাজারের লোক তোমার পিছনে আছি।
—ধুস ব্যাটা ওসব করতে গেলে পেটে বিদ্যা লাগে। শালা, আমি আগরপাড়া লিখতে গিয়ে বাপের ‘ইয়ে’ লিখে ফেলি। বললেই হবে!
—হবে হবে। একবার নেতা হয়ে গেলে ওসব কেউ দেখে না।
শুধু বাবলা নয়। বাজারের দূরে থাকা লোকগুলো পানা পুকুরের পানার মতো এগিয়ে এল।
—গুরু কপ্পোরেশনের ভোটে দাঁড়াতে হবে। তাইলে বাজারের উবগার হবে।
|| তিন ||
সত্যি সব্বাইকে চমকে দিয়ে ছকু মাছওয়ালা হাজির। তখন রোদে সোনালি রং ধরেছে। ঝুলন্ত আমে রং ধরার মতো। বোঝা গেল বেশ তালিম নিয়েছে। একটা অটো নিয়ে ছকু প্রচারে। অটোর গায়ে জমিদার গিন্নির মতো ভত্তি গয়না যেন। ব্যানার আর প্লাস্টিকের ফুল দিয়ে সাজানো। ‘আসন্ন পৌর নির্বাচনে ছকু সাঁপুইকে নির্দল প্রার্থী হিসেবে ভোট দিন’! মাঝে ছকুর খুড়োর কলের মতো হাসি ঝুলছে। হাত জোড় করে ঝাক্কাস ছবি। ব্যাটারি চালিত মাইকের চোঙ। ছকুর ছোট্ট ভাষণ… ‘‘দাদা, আমি অতি পরিচিত ছকু। সারা বচ্ছর মাছ খাওয়াই। তা আমি কপ্পোরেশনের ভোটে নিদ্দল হয়ে দাঁড়িয়েছি। আমার চিহ্ন ‘মোম্বাতি’! মনে রাখবেন, শীত,গীষ্ম বরষা/ ছকুই ভরসা।” চেলারা একটা মোটা মোমবাতি তুলে দেখায়।
সকালে এই অভিনব এবং নতুন ভূমিকায় ছকুকে দেখে আবাসিকরা হতচকিত! কেউ বলে শেষে কিনা মাছওয়ালা! কেউ টিপ্পনী কাটে, তাতে কী ঘরের ছেলে! চাওয়ালা পিএম হলে, মাছওয়ালা কী দোষ করল মশাই! যাই হোক, কেউ হতবাক, কেউ অবাক, কেউ খুশি, কেউ ভুরু কোঁচকায়। ছকুর চ্যালাদের উৎসাহ বেড়ে যায়। তাদের হাততালির শব্দে আবাসনের পায়রা উড়তে লাগল। আবাসন ছেড়ে বাইরে বিশাল মিছিল চলল। জি ব্লকের আবাসিকেরা বারান্দা থেকে দেখে মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে।
বলাবাহুল্য সব পক্ষকে হারিয়ে ছকু জিতে গেল। শুধু তা-ই না, ডিসাইডিং ফ্যাক্টর এখন ছকু। দু-দলই সমান সিট পেল। শুরু হল দড়ি-টানাটানি। ছকুর ছক্কার ওপর সব নির্ভর করছে। এদিকে টাকার থলির হাতছানি। কিন্তু ছকু ওসবে নেই। কোনও দলে নেই। ইতিমধ্যে ছকু রাজনীতিতে হাত পাকিয়ে ফেলেছে। প্রচুর মৌমাছি যেন ছকুর চাকের পেছনে।
বাবলা ছাড়াও অনেকে বুদ্ধি দিল… ডেপুটি মেয়রের পদ চাই। ছকু কিছুতে রাজি নয়। আবাসনের ব্যানার্জিও একই বুদ্ধি দিল। ছকু এই মওকা।
অবশেষে টস।
ব্যানার্জিবাবু টস করলেন। সবাই ঊর্ধ্বমুখী। দুর্ভাগ্য বা সৌভাগ্যের ব্যাপার। কয়েনটা ঘুরতেই থাকল— নিচে আর নামল না!
 ছকুর মুখে হাসি ফুটে উঠল।
অঙ্কন : শংকর বসাক

Latest article