যাত্রাশিল্পের অন্তরাত্মাতে লুকোনো জন সংযোগের বীজমন্ত্র।
মাটির বড় কাছাকাছি। সত্যি বলতে, যাত্রার বিকাশ থিয়েটার বা নাটকের অনেক অনেক আগে। অন্তত বাংলার মাটিতে। বৈষ্ণব ধর্মের আগল খোলা সর্ব ধর্ম সমন্বয়ের ডাকটি শ্রীচৈতন্য (১৪৮৬-১৫৩৩) উচ্চারণ করেই বুঝেছিলেন, আপামর জনতার মর্মে জায়গা করে নেওয়ার জন্য চাই অভিনয়ের কৃতকৌশল। বড়ুচণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের আখর হয়ে উঠল তাঁর অবলম্বন। নিজে সংস্কৃত সাহিত্যে পণ্ডিত হয়েও বেছে নিলেন, নৃত্য-গীত-কথার সহজ চলন। ব্রজলীলা, রাবণবধের মতো পালায় উঠে এল, জীবনের আকুতি। ঈশ্বর ভক্তির নিবিষ্ট নিবিড়তা সংলাপের অভিঘাতে জায়গা করে নিল, সাধারণ জন-জীবনে। যদিও বাংলার যাত্রাপালার প্রকৃত বিকাশ আঠারো শতকের মাঝামাঝি সময়ে। এই শতকের শেষ দিকে ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরের (১৭১২-১৭৬০) অন্নদামঙ্গল কাব্যের কাহিনি নিয়ে রচিত বিদ্যাসুন্দরের জনপ্রিয়তা ছিল তুঙ্গে। সেই ধারাপথ বেয়ে সেকালে দুর্গাপুজোর সপ্তমীর দিন থেকে চৈত্রের বাসন্তী পুজো পর্যন্ত বিস্তারিত ছিল বাংলার এক আশ্চর্য বিনোদন, যাত্রা।
আরও পড়ুন-বাঘাযতীন-কাণ্ডে লিফটিং সংস্থার কর্ণধার গ্রেফতার
গ্রামজীবন তখনও শহুরে ইংরেজি শাসিত ঘেরাটোপ থেকে দূরে। মেঠো আধো অন্ধকারে, জমিদারবাড়ির কাছারি উঠোনে হ্যাজাকের আলোতে অভিনীত হত পালা। খুব চেনা উদাহরণ খুঁজলে বিভূতিভূষণের পথের পাঁচালীর ফ্যান্টাসি মনে করুন। রূপালী পোশাকের তবক খুলে তলোয়ার ঝলসানো যুদ্ধ। আর কোনও কোনও ক্লাইম্যাক্সে দর্শক আসন থেকে রব, ‘‘ঝাড় সামলে, ঝাড় সামলে”!
এ তো একযুগ। বলা ভাল এক অধ্যায়। শ্রাবণ মাস থেকে সাজো-সাজো রব। নতুন পালা নির্বাচন, শিল্পী চুক্তি। ভাদ্র মাস পড়লেই, নতুন পালার মহড়া। তারপর, বায়না পেয়েই নদীমাতৃক বাংলাদেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে যেত দল। সেসময় নৌকাই ছিল, যাত্রাশিল্পীর ঘরবাড়ি। পুরুষ মানুষ নারী সেজে অভিনয় করেছে। যদিও, পরবর্তীতে ১৯৪৭ সালের পরে মেয়েরাও এসে পড়েছে যাত্রাশিল্পে। থিয়েটারি বুনোট থেকে শত যোজন দূরে উদাত্ত আবেগের টানটি বাংলার জনজীবনের আঁতের কথা বলে বলেই দীর্ঘ এক যুগ, জনতার একমাত্র বিনোদনের মানদণ্ডটি হয়ে থেকে গেছে যাত্রাশিল্প।
আরও পড়ুন-কুম্ভ-আলোচনায় ভয়, সংসদে খারিজ প্রস্তাব
ব্রিটিশ-শাসিত বাংলায় তো বটেই, ১৯৪৭-এর পর স্বাধীন ভূমেও হৈ হৈ করে ছিল এর অনিবার্যতা। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রণীত সীতার বনবাস থেকে শুরু করে ১৯০৫-এর বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে মুকুল দাসের আনুষ্ঠানিক যাত্রাদল গঠন নিঃসন্দেহে ঐতিহাসিক মাইলফলক। প্রায় আশির দশকের শেষ পর্যন্ত, এ ধারার কোনও পরিবর্তন হয়নি। বড়িশালের স্বদেশ বান্ধব সমিতির সভাপতি অশ্বিনীকুমার দত্তের আহ্বানে উদ্বুদ্ধ হয়ে মুকুন্দ দাস ১৯০৫ সালেই ‘‘মাতৃপূজা” নামে অভিনব এক যাত্রাপালা রচনা করেন। ক্রমে তাঁর দলের নাম হয়ে যায়, ‘‘স্বদেশী যাত্রা পার্টি”। ভিত নড়ে যায় ব্রিটিশ সরকারের। শুরু হয় দমন পীড়ন। তাঁর পালাগুলিও নিষিদ্ধ হয়, খুব দ্রুত। জনমত গঠনে যাত্রাপালার এই সহজতম উপস্থিতি ব্রিটিশ সরকারকে ভয় ধরিয়েছিল। শীতভাঙা আলো আাঁধারির জনমন ঐতিহাসিক পালা, সামাজিক পালা, পৌরাণিক পালার সর্বগ্রাসী আবেগকে কখনও অস্বীকার করেনি বলেই দীর্ঘদিন ধরে সংস্কৃতির ধারাপথে নিজের নিয়মে রাজ করেছে বাংলায় যাত্রাশিল্প।
কিন্তু অস্বীকারের কোনও জায়গা নেই, প্রযুক্তির দাপট এবং আধুনিক দ্বন্দ্বময় অভ্যাসের চাকচিক্য সময়ের নিয়মে নিয়ন্ত্রণ শুরু করলে, যাত্রাশিল্পের চাহিদায় যেন কিছুটা হলেও ভাটা আসে। অর্থনৈতিক চাওয়াপাওয়া এবং সেই সঙ্গে মানুষের সামনে বিনোদনের নিখাদ সংজ্ঞা বদলে যাওয়ায়, আদি অকৃত্রিম যাত্রার অভিমুখটিও যেন একটু বদলে যায়। তবে, আাঁতের টান কথা বলেই। কণ্ঠ অভিনয় ও গান যে শিল্পের মূলমন্ত্র, যেখানে জীবন্ত অভিনেতা যাবতীয় লাস্যে স্বপ্ন দেখায় দর্শকের সামনে তিনদিক খোলা মঞ্চে, তাকে দূরে রাখতে পারা প্রযুক্তি-শাসিত সময়ের পক্ষেও অসাধ্য। আর তার প্রমাণ, অধুনা, সরকারি বদান্যতায় আয়োজিত যাত্রা উত্সব।
মানুষের একান্ত চাওয়া-পাওয়ার খতিয়ান, নতুন প্রযুক্তির মোড়কে অন্য স্বাদে এখানে উপস্থিত। যাত্রাশিল্প এখনও গ্রামবাংলার মাঠভাঙা ভিড়ের সম্পদ। তবু সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার এই আলোবৃত্তটুকু শিল্প ও শিল্পীর বাড়তি মনোবল। কানায় কানায় ভর্তি দর্শক, তাঁদের উপস্থিতির উষ্ণতা সে-কথাই আরও জোর দিয়ে প্রমাণ করে।