প্রেমের ভুবনে আবেগের উচ্ছ্বাস উঠে যায় হঠাৎই। ঢেউয়ের মতো আছড়েও পড়ে৷ বুকে। বন্ধ মনে। হৃদয়ের দুয়ার খুলে দিতে আকুলিবিকুলি করে। মুখে ফোটায় তৃপ্তির হাসি৷ সঙ্গে চোখে ঝরায় জল৷ কখনও বা হোঁচট খেলে বিশ্বাসে, সম্পর্কে ধরে ফাটল৷ গড়ে তোলে প্রাচীরের আড়াল৷ দুর্বোধ্যতার অতলে হারিয়ে যায় নিয়তিকে সাক্ষী মেনে৷
প্রেমের ছোঁয়া। চিরবসন্তের দখিনা বাতাসের স্পর্শ৷ মনকে করে তোলে ফুরফুরে৷ বাউলের মতো উদাসী৷ আর সেই জন্যই বোধহয় কবি দীপঙ্কর গোস্বামী তাঁর অষ্টাদশ কাব্যগ্রন্থ ‘উদাসী দিনের পাঁচালি’তে প্রেমিকের বাতুলতায় মুহুর্মুহু অবগাহন করেছেন ভরপুর প্রেম-সাগরে৷ প্রেমও সেজে উঠেছে প্রেমের চতুরাশ্রমের ঊর্মিমালায়৷ উপজীব্য বিষয়ানুযায়ী প্রেমের চতুরাশ্রমভিত্তিক কাব্যগ্রন্থকে ভাগ করেছেন ‘প্রেম’, ‘রাগ-অনুরাগ’, ‘বিরহ ও যন্ত্রণা’ ও ‘অদৃষ্ট’— এই চারটি পর্বে৷ প্রতি পর্বের শুরুতে আর্ট পেপারে ছাপা বহুবর্ণের চিত্রালংকরণ৷
আরও পড়ুন-এই আমাদের নববর্ষ বিভেদ মোছা হর্ষ সুখে
দীপঙ্কর যখন অনায়াসে বলেন— ‘শিমুলতলায় তাকে দেখেছিলাম লাল শিমুল হয়ে হাসতে৷/তুলোর মতো নরম গালে শিমুল আভা মেখে৷/আমি অমনি স্বপ্নমাখা বুড়ির-সুতো দিয়েছিলাম ছেড়ে/গোটা শিমুলতলা জুড়ে। কিংবা ফেব্রুয়ারির ১৪ সেদিন ছিল৷/তারও ১৪, আমার ১৮;/বুড়ির-সুতো ভ্যালেন্টাইনকে সাক্ষী রেখে হঠাৎ/আমার গায়ে আটকে যেতেই সেও তাকাল!’… প্রথম প্রেম বলে চিনতে অসুবিধা হয় না৷ আমাদের ঘোর না কাটিয়ে দীপঙ্কর শোনান— ‘আমি জ্বলতে জ্বলতে জ্বালিয়ে দিলে তোমায়/তুমিও জ্বলতে জ্বলতে জ্বালিয়েছিলে আমাকে৷/আমাদের আগুন-আগুন খেলার নেপথ্যে সে-ই ছিল হাতেখড়ি৷’(ঘৃতপার্বণ)৷ জীবনানন্দ ও বনলতাকে ছুঁয়ে চেরাপুঞ্জির ডায়েরি পড়তে পড়তে পাঠক ঘুরে আসেন কক্সবাজারের আকাশে৷ প্রেমের নকশি-কথায় থাকেন মগ্ন— ‘তুমি এগিয়ে এসে হাসলে,/বেহায়া চোখও হাসে;/ক্লিভেজের খোলা ভাঁজে/আটকে পড়ে ফাঁসে!’(পরি ও ফাগুন)৷ দীপঙ্কর মনে করিয়ে দেন এই অবস্থাতে কী হয়৷ ‘পাশ থেকে বন্ধুরা আওয়াজ তুলেছিল— কী হচ্ছে গুরু?/কেসটা কি নার্সারি থেকে শুরু?’(চৌত্রিশ বছর পর)৷ তনুজা, অনামিকা, শালিনী, বল্লরী এবং রিক্তাকে নিয়ে রাগবতী আখ্যান রচনা করেন কবি৷ বিরহ যন্ত্রণায় একবার বিলাপ করেন— ‘পুড়ছে দুপুর, একলা দুপুর, জ্বলে-পুড়ে ছাই৷/ঘু-ঘু-ঘু, ঘু-ঘু-ঘু, অনন্ত তার খাঁই…’ (দুপুরের ডাক)৷ আবার অরেক বার— ‘ওরে আমার হারিয়ে যাওয়া সকাল,/আমার হারিয়ে যাওয়া ভোর;/তোকে কোথায় গেলে পাব? ঠিকানাটা দে তোর৷’ (কাটিয়ে দে এ রাত)৷
শরীর জুড়ে প্রেমের আগুনের আলপনা জ্বালিয়ে কবি যেন ক্রিকেট খেলেছেন ৷
আরও পড়ুন-রাজনারায়ণ বসু স্মৃতি পাঠাগার বাংলার নবজাগরণের অন্যতম কেন্দ্র
চার অদৃষ্টের ছাইভস্ম গায়ে মেখে উপদেশ দিয়েছেন— ‘গুড লেংথে খেলুন মশাই, খেলুন সোজা ব্যাটে৷’ (ক্রিকেট খেলা)৷ দ্রৌপদীকে নিয়ে লেখা কবিতায় উচ্চারণ করেছেন— ‘আমার অশ্রুর বিন্দুতে জন্ম নেয় পদ্ম৷ ক্রোধ অগ্নি হয়ে জ্বলে চোখে৷/কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধও সেইহেতু কেবল যুদ্ধ নয়৷ এক মহাযজ্ঞ৷/আমি সেই যজ্ঞের আধার৷ আমার ক্রোধ হোমশিখা৷/পঞ্চপাণ্ডবে নিবেদিত আমার প্রাণ তার ঘৃতাহুতি৷… সৃষ্টি ধারণ করে বলেই পৃথিবী ধরিত্রীমাতা৷ গর্ভ তার মাটি বা ক্ষেত্র৷/আমি সেই ক্ষেত্রজ সন্তান পঞ্চ ইন্দ্রদিগের স্ত্রী৷ পঞ্চেন্দ্রিয় বিজেতা/পঞ্চাংশীধারিণী নারী৷ পঞ্চতত্ত্বের প্রকাশ— পাঞ্চালের পাঞ্চালী৷/আমাকে যে নামেই ডাকো, ইন্দ্রের পূজা হবে সমাপন৷/প্রাপ্ত হবে যজ্ঞলব্ধ ফল৷ মহেশ্বরের কৃপা৷’(পঞ্চরতিবতী পঞ্চ-আরতিবৎ)৷ শেষ কবিতায় দীপঙ্কর কুন্তীর কণ্ঠে বলেছেন— ‘…জন্মেই হস্তান্তরিত হয় যে শিশু,/পণ্যের ন্যায় নির্ধারিত তার ভাগ্যের ইতিহাস! সাধ্য কী, সে খণ্ডাতে পারে?/বসুধার পুত্রী আমি বহুধা বিভক্ত পৃথা৷ ভোজরাজের পালিত তনয়া কুন্তী৷’ (বসুধাপুত্রী পৃথা)৷ কবিতাগুলি পড়তে পড়তে ক্রমশ আচ্ছন্ন করে কী এক অব্যক্ত মায়া। যার উত্তর একমাত্র কবির লেখনীতেই বোধহয় আত্মগোপন করে আছে।
ম্যাপলিথো কাগজে ঝকঝকে ছাপা। হার্ড বাইন্ড ৮০ পৃষ্ঠার বইটিতে ৪৮টি কবিতার আকর্ষক প্রচ্ছদ ও অলংকরণ করেছেন প্যারিস-প্রবাসী শিল্পী উৎপল বিশ্বাস৷ আকুল মুনশিয়ানায় শিল্পী প্রচ্ছদে ব্যবহার করেছেন প্যাস্টেল।