প্রতিবেদন : ‘জয়পুর’ নামটা শুনলে এখনও একশো শতাংশ মানুষের মনেই রাজস্থানের ‘পিঙ্ক সিটি’র ছবিই ভেসে ওঠে। কিন্তু অন্য অনেক ক্ষেত্রের মতোই আমাদের বাংলা যে পিছিয়ে থাকতে রাজি নয় পর্যটন মানচিত্রে গত কয়েক বছরে একের পর এক নতুন জায়গার দখল নেওয়া দেখেই তা আরও একবার বোঝা যায়। বাঁকুড়া জেলায় বিষ্ণুপুরের কাছে ‘জয়পুর ফরেস্ট’ এদের অন্যতম। পিঙ্ক নয় সম্পূর্ণ সবুজ এ জয়পুর! রিজার্ভড ফরেস্ট নয় বলে কড়াকড়িও কম। বিষ্ণুপুর স্টেশন থেকে গাড়িতে মাত্র আধঘণ্টায় পৌঁছনো যায় জয়পুর। মেরেকেটে কুড়ি কিলোমিটার রাস্তা। তা হলেই দেখা মিলবে লালমাটির বিস্তার শেষে ঘন সবুজ জঙ্গল। যদিও লাল মোরামের রাস্তায় প্রবেশের আগেই হাইওয়ের দু’পাশ জুড়ে বড় বড় শাল, সেগুন টিকের সারি আপনার মন ফুরফুরে করে দেবে নিশ্চিত। এরপর হাইওয়ে ছেড়ে যত ভেতরে এগোবেন জঙ্গল তত ঘন।
আরও পড়ুন : তেজস্বিনীর নতুন নাম হল উইনার্স
গাড়ি কোনও জায়গায় পার্ক করে পায়ে হেঁটেও দিব্যি ঘোরা যায় বেশ অনেকটাই। আশপাশে আছে বেশ কিছু আদিবাসী গ্রাম। কিন্তু কোলাহল নেই কোথাও। ইচ্ছেমতো ঘোরাফেরা, বসে আড্ডা দেওয়া কিংবা প্রকৃতির সঙ্গ উপভোগ— সবটাই সম্ভব নিজের মতো করে। তবে গভীর জঙ্গলে ঢোকার আগে স্থানীয় মানুষের ও জঙ্গলের গার্ডদের পরামর্শ নেওয়া বাঞ্ছনীয়। কারণ আপাতনিরীহ মনে হলেও জঙ্গলের কিছু কিছু এলাকা হাতিদের নিজস্ব। অকারণ উৎসাহ তাই বিপদের কারণ হতেই পারে। আর জয়পুর জঙ্গল কিন্তু আদপেই ছোটখাটো নয়। কিছু জায়গায় জঙ্গল এতটাই ঘন যে সূর্যের আলো মাটি ছোঁয় না। তাই গাড়ি নিয়েই হোক বা হেঁটে গভীর জঙ্গলে না যাওয়াই ভাল। তার চেয়ে স্থানীয় গ্রামবাসীদের থেকে জেনে নানা ছোট ছোট পয়েন্টে ঘুরে নেওয়া যেতে পারে। নিত্যকার অভ্যস্ত চোখে তাঁদের কাছে সে-সব স্থান খানিকটা ‘গেঁয়ো যোগী ভিখ পায় না’ গোছের হলেও আমাদের শহুরে চোখে তাঁদের বড় সন্ন্যাসীই মনে হতে পারে! সবচেয়ে বড় কথা প্রকৃতি এখানে অকপট।
একটা সময় কিন্তু এইসব অঞ্চল বেশ ত্রাসের ছিল। ঘন জঙ্গলে ছিল ডাকাতদের অবস্থান। যদিও তা আটের দশকের আগের কথা। প্রায় আট কিলোমিটার জঙ্গলের রাস্তার মাধ্যমেই বাঁকুড়া ও বিষ্ণুপুর কলকাতার সঙ্গে যুক্ত ছিল, তাই কুখ্যাত ডাকাতরা যাত্রীদের টার্গেট করত। তাই সে-সময় সারিবদ্ধভাবে গাড়ি জঙ্গলের রাস্তা পার হত। এখন অবশ্য সে-সবের চিহ্ন নেই। অস্তিত্বও নেই। বরং বন দফতরের তরফে তৈরি করা হয়েছে পাঁচতলার ওয়াচ টাওয়ার। সেখান থেকেই দেখা যায় বাঁকুড়া জেলার দ্বিতীয় বৃহত্তম জলাশয় সমুদ্র বাঁধ। দিনভর সেখানে চক্কর কাটে প্রচুর পাখ-পাখালি। বাঁধে অনেক সময় দাঁতালরা জলকেলিও করতে আসে।
আরও পড়ুন : ঘূর্ণিঝড়ে যোগাযোগ বাঁচাতে নতুন প্রযুক্তি কলকাতা বন্দরে
দিনের দিন ঘুরে আসাও যায় তবে জঙ্গল সার্বিকভাবে উপভোগ করতে হলে অবশ্যই থাকা দরকার। প্রথমদিকে ছিল দুটি লজ, একটি জয়পুর পঞ্চায়েত সমিতির ‘বনবিতান’ লজ আর অন্যটি ‘বনলতা রিসর্ট’। তবে পর্যটকের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ায় এখন আরও কয়েকটি রিসর্ট তৈরি হয়েছে। সব ক’টিই জঙ্গলের মধ্যে। তাই ব্যালকনি হোক বা জানলা যেখানেই দাঁড়ান আর যেদিকেই তাকান চারদিকে শুধু সবুজের নানা শেড। শাল, মহুল, পিয়াশাল, সেগুন, পলাশ, বহেড়া, আমলকী, হরীতকী থেকে শুরু করে অজস্র অচেনা বুনো বৃক্ষেরা আপনার চোখের আরাম। দূরে দোখে পড়বে পাঞ্চেত ডিভিশনের ১২০ স্কোয়্যার কিলোমিটার জয়পুর রেঞ্জ। ভোর ভোর উঠে জঙ্গলে হাঁটতে বেশ ভাল লাগবে। রাঙামাটির রাস্তা ধরে খানিক এগোলে পাবেন ছোট রেললাইন ও ছবির মতো এক স্টেশন, গোকুলনগর-জয়পুর। আরও খানিক এগোলে দেখতে পাবেন গোকুলনগরের বিখ্যাত গোকুলচাঁদ মন্দির। জঙ্গলে চিতলহরিণ, হায়না, খেঁকশিয়াল, বনশুয়োরের সংখ্যাও প্রচুর। কপাল ভাল থাকলে দেখা মিলতেও পারে তাদের। জঙ্গলের এক দিকে দুর্দান্ত এক সোঁতা আছে। তার স্বচ্ছ জল আশপাশের গাছ-গাছালির ছায়ায় আশ্চর্য সবুজ, যা সত্যিই চোখের আরাম। অনায়াসে এর পাড়ে বসে সময় কাটানো যায় খানিক। সব মিলিয়ে ছোট ছুটি, ছোট বাজেটে বেশ বড় করে একটা জঙ্গল-ভ্রমণ সেরে আসার জন্য জয়পুর ফরেস্ট আদর্শ। বর্তমানে প্রশাসনের তরফে আরও কিছু পরিকল্পনা ও উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে জয়পুরকে যথার্থ একটি পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত করার জন্য।
কীভাবে যাবেন?
জয়পুর যাওয়ার জন্য সবচেয়ে ভাল উপায় গাড়িতে হাইওয়ে ধরে চলে যাওয়া। নাহলে আরণ্যক বা রূপসী বাংলা এক্সপ্রেস ধরে চলে যান বিষ্ণুপুর, সেখান থেকে ট্রেকার, গাড়ি বা বাসে পৌঁছে যাবেন জয়পুর। আর বাসে যেতে চাইলে কলকাতার ধর্মতলা থেকে পেয়ে যাবেন বিষ্ণুপুরের বাস।
কোথায় থাকবেন?
জয়পুর ফরেস্ট রিসর্ট বুকিং করে নিতে পারেন ওয়েব সাইটে গিয়ে। অথবা আছে বনলতা রিসর্ট, একেবারে জঙ্গলের মাঝেই। ব্যবস্থাপনা সুন্দর ও সব রকম রেঞ্জের জন্যই উপযুক্ত।