তৃণমূল ২৮, উচ্ছ্বাসের মাঝে বাংলা জুড়ে আজ প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন

১৯৯৮-এ নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত ধরে শুরু হয়েছিল তৃণমূল কংগ্রেসের পথচলা। সেই তৃণমূল কংগ্রেস আজ মহীরুহে পরিণত হয়েছে।

Must read

প্রতিবেদন : ২৭ পেরিয়ে ২৮-এ পদার্পণ তৃণমূল কংগ্রেসের। আজ আরও একটি শপথের দিন। আরও একটি অঙ্গীকারের দিন। নতুন বছরের নতুন সূর্যের আলোয় সোমবার ১ জানুয়ারি তৃণমূল কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা দিবস উদযাপনকে কেন্দ্র করে কর্মী-সমর্থক থেকে শুরু করে নেতা-নেত্রীদের উন্মাদনা তুঙ্গে। আরও একবার বাংলার মানুষের আশীর্বাদ-ভালবাসা-দোয়া পাথেয় করে আগামীর পথচলা সুগম করবে তৃণমূল। সেই লক্ষ্যে জেলায় জেলায়, ব্লকে ব্লকে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা দিবসে আয়োজন করা হয়েছে নানা কর্মসূচি। রক্তদান শিবির থেকে শুরু করে নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে প্রতিষ্ঠা দিবস পালনের জোর তোড়জোড় চলছে।

আরও পড়ুন-চমকে দিল কলকাতা পুলিশ

১৯৯৮-এ নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত ধরে শুরু হয়েছিল তৃণমূল কংগ্রেসের পথচলা। সেই তৃণমূল কংগ্রেস আজ মহীরুহে পরিণত হয়েছে। বাংলার মানুষের আশীর্বাদ নিয়ে পরপর তিনবার ক্ষমতায় এসেছে তৃণমূল। টানা তিনবার মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বাংলার সর্বস্তরের মানুষের কাছে তিনিই একমাত্র ভরসার স্থল। তাঁর উপরই মানুষ ভরসা রেখেছে। সেই দলের প্রতিষ্ঠা দিবসে গোটা বাংলা জুড়ে জেলায়-ব্লকে দিনটি পালিত হবে প্রবল উন্মাদনার সঙ্গে। কলকাতায় তৃণমূল ভবনে সোমবার সকাল ১০টায় দলের পতাকা উত্তোলন করবেন রাজ্য সভাপতি সুব্রত বক্সি। সেই সঙ্গে আরও একবার মনে করিয়ে দেবেন তৃণমূল কংগ্রেসের ইতিহাস। নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কঠিন লড়াই-সংগ্রামের কাহিনি। নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশ অনুযায়ী সারা বাংলা জুড়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজনের প্রস্তুতি চলছে। দলের সাংসদ-বিধায়ক-মন্ত্রী-সাংগঠনিক স্তরের সকলেই শামিল হবেন এই প্রতিষ্ঠা দিবসের অনুষ্ঠানে।

ছাব্বিশের শপথ
সুব্রত বক্সি
আজ আরও একটা প্রতিষ্ঠা দিবস। ২৭ পেরিয়ে ২৮–এ পা তৃণমূল কংগ্রেসের৷ আজ আরও একটা শপথের দিন––স্মরণের দিন। তৃণমূল কংগ্রেসের পতাকা কাঁধে নিয়ে যারা ১৯৯৮ সাল থেকে রক্ত-ঘাম-জীবন দিয়ে দলের জন্য প্রাণপাত করেছে আজ তাদের ভুললে চলবে না। দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে সর্বজনশ্রদ্ধেয় নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দেখানো পথে হেঁটেই তৃণমূল কংগ্রেস আজ বাংলার মসনদে। তিনবারের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলার মানুষের জন্য দিনরাত পরিশ্রম করছেন। আর এক বছর বাদে বিধানসভা নির্বাচন৷ লড়াই সহজ হবে না। যেভাবে বিজেপি সাম্প্রদায়িকতার বীজ বপন করে বিভাজনের রাজনীতির মধ্যে দিয়ে বাংলায় ক্ষমতা দখল করতে চাইছে, বাংলার মানুষকে সঙ্গে নিয়ে তা রুখে দিতে হবে। যেভাবে এতদিন রুখেছি৷ বাংলায় উন্নয়নের কর্মযজ্ঞ চালাচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ঘরে ঘরে আজ লক্ষ্মীর ভাণ্ডার-কন্যাশ্রী। মানুষ দু’হাত তুলে আশীর্বাদ করেছেন। তিনি আবারও মানুষের ভোটে নির্বাচিত হয়ে দলকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন। তিনিও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবি ও তাঁর আশীর্বাদ নিয়েই লড়বেন। বিপুল ভোটে জিতবেনও। এবার তৃণমূলের বিধায়ক সংখ্যা আরও বাড়বে। শত চেষ্টা করেও বিজেপি দাঁত ফোটাতে পারবে না। তবে তৃণমূলের সর্বস্তরের নেতা–কর্মী–জনপ্রতিনিধিদের সবসময় মানুষের পাশে থাকতে হবে৷ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যেসব সরকারি প্রকল্প, পরিষেবা বাংলার মানুষের জন্য তৈরি করেছেন তা যেন প্রত্যেকটি মানুষ পায় তা সুনিশ্চিত করতে হবে৷ এ ছাড়াও নিত্যদিনের নাগরিক পরিষেবাতেও যেন কোনও খামতি না থাকে৷ সদাসর্বদা সেদিকে নজর রাখতে হবে৷ সেই সঙ্গে একটা কথা বলব, ঐক্যবদ্ধভাবে তৃণমূলের সৈনিকদের পথ চলতে হবে৷ বিরোধী রাজনৈতিক দল ও একাংশের মিডিয়ার যাবতীয় কুৎসা, অপপ্রচারকে রুখে দিয়ে বাংলাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে৷ দলের প্রতিষ্ঠা দিবসের দিনে এই শপথ আমাদের নিতে হবে৷
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন কংগ্রেসের পতাকা কাঁধে নিয়ে। ছাত্রজীবন থেকে শুরু করে পরবর্তী পর্যায়ে ধাপে-ধাপে আটের দশক, নয়ের দশককে উত্তাল করে দিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর রাজনৈতিক জীবন শুরু করেছিলেন কংগ্রেসের অনুমতি নিয়ে ছাত্র অবস্থায় ছাত্র রাজনীতির মধ্য দিয়ে। তারপর ধাপে ধাপে এগিয়ে চলা। এই সময় তিনি বহু আন্দোলন সংগঠিত করেছেন। তার মধ্যে একটা বড় আন্দোলন ছিল সচিত্র পরিচয়পত্র দিয়ে ভোট গ্রহণ।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যুব সংগঠনের সভানেত্রী হওয়ার পর বাংলার মাটিতে সারা বাংলা পরিক্রমা করে উপলব্ধি করলেন যে ক্ষমতায় থাকা মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টি তার পেশি এবং প্রশাসনকে ব্যবহার করে মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রতিফলন ঘটাতে দেয় না।
১৯৯৮ সালের ১ জানুয়ারি জন্ম নিল তৃণমূল কংগ্রেস। এরপর অনেক উত্থান-পতনের মধ্যে দিয়ে ২০১১ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে তৃণমূল কংগ্রেসের সরকার ক্ষমতায় এল বাংলায়। শুরু হল উন্নয়নের কর্মযজ্ঞ। এরপর তিনটি নির্বাচন পেরিয়ে বাংলার মানুষ আজও ভরসা রেখেছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ওপরেই। ২০২৪–এর কঠিন লোকসভা নির্বাচনের বাংলার মানুষ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গেই থেকেছেন৷ তারা বুঝেছেন, বিভেদকামী শক্তিকে রুখে দিতে পারেন একমাত্র মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই৷ তাদের সুখ–দুঃখের সাথী বাংলার মুখ্যমন্ত্রী৷ কেন্দ্রীয় বঞ্চনা সত্ত্বেও উন্নয়নের কর্মযজ্ঞ চলছে বাংলাজুড়ে৷ কেন্দ্র দেয়নি একটাকাও দেয়নি৷ কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কথা দিয়ে কথা রেখেছেন৷ ১০০ দিনের কাজের টাকা রাজ্য সরকার মিটিয়েছে৷ বাংলার বাড়ি প্রথম কিস্তির টাকা প্রাপকদের অ্যাকাউন্টে পৌঁছে গিয়েছে৷ বাকিটাও পৌঁছে যাবে৷ সামনে ২০২৬–এ বিধানসভা নির্বাচনেও বিপুল ভোটে জয়লাভ করতে তৃণমূল কংগ্রেস৷ বাংলার মানুষের প্রতি এই বিশ্বাস, ভরসা আমাদের আছে৷

লড়াই–সংগ্রামের আর এক নাম তৃণমূল কংগ্রেস
শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়
১ জানুয়ারি ২০২৫ সর্বভারতীয় তৃণমূল কংগ্রেসের ২৮তম প্রতিষ্ঠা দিবস অর্থাৎ ২৭ বছর অতিক্রম করে ২৮তম বর্ষে পদার্পণ করল।
আজকের প্রজন্ম সম্ভবত ভাবতেই পারবে না কী প্রবল সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আমাদের সকলের নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজের জীবন বিপন্ন করে পশ্চিমবাংলাকে মার্কসবাদী কমিউনিস্টদের সন্ত্রাস থেকে রক্ষা করেছেন।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে ৮০-র দশক থেকে যে তীব্র লড়াই হয়েছিল তার সার্বিক বিবরণ আছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা ‘উপলব্ধি’ বইতে।
যেহেতু সেই সময় কংগ্রেস দল দিল্লিতে ক্ষমতায় থাকার জন্য মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে চলত, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই বিষয়ে বহুবার তাঁর প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। কিন্তু কোনও ফল না হওয়ায় নতুন দল গঠনের সিদ্ধান্ত নেন।
মানুষ এই অরাজক অবস্থার অবসান চায় কিন্তু দীর্ঘদিন বিরোধী দল তার প্রতি মর্যাদা দেখিয়ে সংগঠিত গণআন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি। ১৯৯৮ সালের ১ জানুয়ারি তৈরি হল তৃণমূল কংগ্রেস। নেতৃত্বে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। নো আইডেন্টিটি কার্ড নো ভোট। নির্ভুল ভোটার তালিকায় ভোট করতে হবে, এই দাবিতে সোচ্চার হয়ে আন্দোলনে নামলেন। আজ বোঝা যাচ্ছে সেদিন নির্ভুল ছিল তাঁর দাবি তাই নির্বাচন কমিশনও বলছে যে প্রতিটি ভোটারের ছবি-সহ ভোটার তালিকা এবং আই কার্ড থাকতেই হবে। তারপর টাডা আইনের বিরুদ্ধে, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির বিরুদ্ধে, শিক্ষা ব্যবস্থাকে সংকীর্ণ রাজনীতি-মুক্ত করার জন্য, বন্ধ কারখানা খোলার দাবিতে, সালিশি বিল প্রত্যাহারের দাবিতে এবং প্রাথমিক স্তর থেকে ইংরেজি পড়ানোর দাবিতে লড়াই করেছেন। লড়াই করেছেন সংখ্যালঘু ও তফসিলি জাতি ও উপজাতিদের অধিকার রক্ষার জন্য। ১৯৯৮ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ লড়াই আস্তে আস্তে মানুষের মনে বিশ্বাস তৈরি করেছেন। ফলে সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম, পুরুষোত্তমপুর-সহ বিভিন্ন জায়গায় কৃষক আন্দোলন এক নতুন যুগের সূচনা করেছে। আন্দোলন এতটাই সঠিক ও তীব্রতা অর্জন করেছিল যে সমগ্র পৃথিবীর মানুষ কৌতূহলী হয়ে পড়েছিল। বাংলার বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, সাহিত্যিক-সহ সমগ্র ভারতের বুদ্ধিজীবীরা এর প্রতি সমর্থন জানান। অবশেষে কেন্দ্রীয় সরকার জমি অধিগ্রহণ আইন পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হল, ২০০৯-১০ এর বাজেটে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দাবি মেনে পশ্চিম বাংলা সরকার অকৃষি ও কর্ম উৎপাদন করে এমন জমি কিনে ল্যান্ড ব্যাঙ্ক করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই আন্দোলনের মধ্যেই লেখা হয়েছে নতুন ইতিহাস। ছাব্বিশ দিনের অনশন, সুশীল সমাজের লক্ষাধিক মানুষের মিছিল রাজ্যের মানুষকে এই রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, অপদার্থতা, স্বজনপোষণ ও রাজনৈতিক দ্বিচারিতার বিরুদ্ধে লড়াই করার সাহস ও প্রেরণা জুগিয়েছে। ১৯৯৭ সালের ২২ ডিসেম্বর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর বাড়িতে সাংবাদিক সম্মেলনের ডাক দেন। সেই সম্মেলনেই তিনি ঘোষণা করেন, নতুন দল গঠন করবেন। সন্ধ্যায় তৎকালীন প্রদেশ কংগ্রেসের সভাপতি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দল থেকে চিরকালের জন্য বহিষ্কার করেন এবং সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় ও আমাকে ৬ বছরের জন্য বহিষ্কার করেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুক্তমনে ১৯৯৮ সালের ১ জানুয়ারি নতুন দল সর্বভারতীয় তৃণমূল কংগ্রেসের কথা ঘোষণা করেন দিল্লি থেকে। নির্বাচন কমিশনে করা আবেদনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (সাংসদ), অজিত পাঁজা (সাংসদ) এবং কৃষ্ণা বসু (সাংসদ)-র স্বাক্ষর ছিল। এরপর যাত্রাপথ আরও কঠিন হল। নতুন দল গঠনের পর মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টি রাজ্য জুড়ে ব্যাপক অত্যাচার শুরু করে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পশ্চিমবাংলার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ছুটে গিয়েছেন যখনই সন্ত্রাস-খুন-অগ্নিসংযোগ হয়েছে।
দীর্ঘ ৩৫ বছর ধরে অনুন্নয়ন ও অত্যাচার সহ্য করেছে পশ্চিমবাংলার মানুষ কিন্তু পরিবর্তন করে কার প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস জানাবে তার সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। ২০১১ সালে পশ্চিমবাংলার মানুষ সিদ্ধান্ত নিল যে একমাত্র মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই পারবেন পশ্চিমবাংলার হৃত গৌরব ফিরিয়ে আনতে। ২০১১ সালে পশ্চিমবাংলায় তৃণমূল কংগ্রেস বামফ্রন্টকে পরাজিত করে শাসন ক্ষমতায় আসে। সহযোগী দল ছিল জাতীয় কংগ্রেস। নতুন যাত্রা শুরু করেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর জনমুখী প্রকল্প ও পশ্চিমবাংলার সর্বস্তরের মানুষের জন্য উন্নয়নের কাজ করার ফলস্বরূপ ২০১৬ এবং ২০২১ সালেও পশ্চিমবাংলার মানুষ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতি আস্থা জ্ঞাপন করে। ২০১১ সাল থেকে পশ্চিমবাংলাকে ভারতের শ্রেষ্ঠ রাজ্যরূপে প্রতিষ্ঠিত করার যজ্ঞে নিজেকে নিয়োজিত করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

নেত্রী ও শহিদের আত্মত্যাগকে সম্মান করুন শ্রদ্ধা জানান
ফিরহাদ হাকিম
জননেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের চার দশকের লড়াই ও আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে তৃণমূল কংগ্রেস আজ এখানে পৌঁছেছে। আমরা যখন মমতাদির নেতৃত্বে প্রথমে কংগ্রেস এবং পরে তৃণমূল কংগ্রেস করতে শুরু করি, তখন ভাবতেই পারিনি রাজ্যে সিপিএমের অপশাসনের অবসান হবে। আমরা বিধায়ক-মন্ত্রী-সাংসদ হব, এটা স্বপ্নে ছিল না। তখন দিন-রাত এক করে দিদির নেতৃত্বে সিপিএমের অত্যাচার এবং অপশাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করে গিয়েছি। দল করতে গিয়ে সেই সময় বহু সহকর্মীর প্রাণ গিয়েছে। মূলত তৃণমূল কংগ্রেস আজ যেখানে পৌঁছেছে, তার নেপথ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের লড়াই-সংগ্রাম এবং প্রবল আত্মত্যাগের পাশাপাশি অজস্র দলীয় কর্মীর আত্মত্যাগ এবং রক্তক্ষয়ী পরিশ্রমের অবদান রয়েছে। সিঙ্গুরের অনিচ্ছুক চাষিদের জন্য টানা ২৬ দিনের অনশন নেত্রী তথা তৃণমূলকে গোটা বিশ্বে জমি বাঁচানোর লড়াইয়ে নতুন মাত্রায় পৌঁছে দিয়েছে। আজ দল ২৭ বছর পেরিয়ে এল, কিন্তু এর পিছনে দিদির সঙ্গে অজস্র শহিদের আত্মত্যাগই মূল শক্তি হয়ে আছে।
সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম থেকে শুরু করে নেতাই তথা জঙ্গলমহল ঘিরে তৃণমূল নেত্রীর যে লড়াই তা ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে ঠিকই কিন্তু আমরা চোখের সামনে দেখেছি, সিপিএম কীভাবে দিদিকে খুন করে দিতে চেয়েছে। বারেবারে তাঁর উপর প্রাণঘাতী হামলা হয়েছে। হাজরা মোড়ে লালু আলম থেকে শুরু করে সিঙ্গুরে বিডিও অফিসে রাতের অন্ধকারে পুলিশ বন্দুকের বাঁট দিয়ে গুঁতিয়ে তৃণমূল নেত্রীকে প্রাণে মেরে ফেলতে চেয়েছিল। সেদিন ঈশ্বর সহায় ছিলেন বলে বেঁচে ফিরেছেন তিনি। মাথা থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত দিদির শরীরের এমন কোনও অংশ নেই, যেখানে সিপিএমের অত্যাচার-আঘাত লাগেনি। এই সেদিনও ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটে নন্দীগ্রামে দিদির পায়ে আঘাত করে চেষ্টা হয়েছিল আরও একবার তাঁকে দমিয়ে দেওয়ার। কিন্তু তৃণমূল বিরোধী অপশক্তি পারেনি বাংলার অগ্নিকন্যা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে একবিন্দু থামিয়ে দিতে। উল্টে তিনি আরও জেদ নিয়ে পায়ে প্লাস্টার অবস্থায় বাংলার মানুষের জন্য কেন্দ্রের বঞ্চনার বিরুদ্ধে লড়াই করে গিয়েছেন। মানুষ তাই আগের চেয়েও ২০২১ সালে অনেক বেশি ভোটের ব্যবধানে জননেত্রীকে রাজ্যে তৃতীয়বারের জন্য ক্ষমতায় বসিয়েছে। এখানেই শেষ নয়, মাস চারেক আগে আরজি কর-কাণ্ডের মতো একটা জঘন্যতম ঘটনা নিয়ে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী প্রথম ঘণ্টা থেকেই নিন্দার পাশাপাশি ফাঁসির দাবিতে সরব হয়েছিলেন। অথচ বাম ও অতিবাম গেরুয়া শক্তিকে সঙ্গে নিয়ে তৃণমূল কংগ্রেস তথা জননেত্রীকে ব্যক্তি কুৎসায় আক্রমণ করেছে। বাইরে থেকে অপশক্তি গভীর চক্রান্ত করে বারেবারে চেষ্টা করেছে মা-মাটি-মানুষ সরকারের অন্যতম সেরা পরিকাঠামো এবং পরিষেবা স্বাস্থ্যক্ষেত্রকে ধ্বংস করে দিতে কিন্তু রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল নেত্রী একক নেতৃত্বে লক্ষ লক্ষ কর্মীকে সঙ্গে নিয়ে সেই চক্রান্ত ভেস্তে দিয়েছেন। জয় হয়েছে মা-মাটি-মানুষের। আর তাই লোকসভা নির্বাচনে ২৯টি আসনের পর আরজি কর-কাণ্ডকে ইস্যু করে উপনির্বাচনে ৬টি আসনেই বিপুল ভোটের ব্যবধানে জিতেছেন তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থীরা। ডাক্তারদের আন্দোলনকে যে মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ধৈর্য সহকারে পরিস্থিতি সামাল দিয়েছেন এবং ন্যায্য দাবি মেনে নিয়ে হাজার হাজার অসহায় গরিব রোগীর পাশে দাঁড়িয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী, তা গোটা ভারতে বিরল। এটা শুধুমাত্র তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পক্ষেই সম্ভব বলে স্বীকার করেছে রাজনৈতিক মহল।
দলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে আজ বহু দলীয় কর্মী এবং নেতা নানা কর্মসূচি পালন করছেন কিন্তু কেউ কি গত তিন দশকে যে সমস্ত কর্মীর আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে তৃণমূল ক্ষমতায় এসেছে তাঁদের কথা মনে রাখছেন? সমস্ত তৃণমূল কর্মীর কাছে আমার একটাই অনুরোধ, দল ক্ষমতায় আছে বলে আমরা অনেকেই আজ নিজেদের জাহির করছি। কিন্তু ভুললে চলবে না, বহু কর্মীর প্রাণ এবং রক্তের বিনিময়ের পাশাপাশি নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে মা-মাটি-মানুষ সরকার আজ এখানে পৌঁছেছে। নেত্রীর ঘোষিত ৯২টি সামাজিক প্রকল্প আজ গোটা দেশের বিভিন্ন রাজ্য সরকার অনুকরণ করছে। দলের নির্দেশ মেনে আপনারাও বাড়ি বাড়ি সকলে পৌঁছন, মুখ্যমন্ত্রীর সামাজিক প্রকল্প এবং সরকারের সাফল্যের কথা তুলে ধরুন। পাশাপাশি একবারের জন্য হলেও ১৯৯৮ সালের ১ জানুয়ারি দল প্রতিষ্ঠার পর যেসব কর্মীর সংগ্রাম-লড়াই এবং আত্মত্যাগের জন্য দল এখানে পৌঁছেছে তাঁদের শ্রদ্ধা জানান, সম্মান করুন।

দিদির নির্দেশে কর্পোরেশনে লড়াই
মালা রায়
১ জানুয়ারি দিনটা এলেই মন কেমন করে ওঠে৷ ফিরে যাই ২৭ বছর আগের কতশত ঘটনাবহুল স্মৃতিতে৷ আজ আমি সাংসদ, কলকাতা কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান—সবই মমতাদির জন্য৷ কিন্তু একটা সময় শুধুই কাউন্সিলর ছিলাম৷ কলকাতা কর্পোরেশনের ৮৮ নং ওয়ার্ড থেকে সেই ১৯৯৫ সালে কাউন্সিলর হিসেবে যাত্রা শুরু৷ ১৯৯৮ সালে ১ জানুয়ারি নতুন দল হিসেবে রেজিস্ট্রেশন পায় তৃণমূল কংগ্রেস৷ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ভরসা করে তাঁর উপর আস্থা বিশ্বাস রেখে কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূল কংগ্রেসে পথচলা শুরু করি৷ তার আগে ১৯৯৭ সালের মার্চে ঘটে গিয়েছে বিখ্যাত সেই ইনডোর-আউটডোর মিটিং৷ তিতিবিরক্ত হয়ে ১৯৯৭-এর মার্চে কংগ্রেস ছাড়লেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷ ওই বছর ৮ মার্চ নেতাজি ইনডোরে সীতারাম কেশরী কনফারেন্স করছেন৷ আর ওইদিন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে মেয়ো রোডে আউটডোর মিটিং করলাম আমরা৷ আমার এখনও মনে পড়ে, মমতাদির নির্দেশে আমার কাউন্সিলরের প্যাডে জিওসি ইস্টার্ন কম্যান্ড (ফোর্ট উইলিয়ম)–কে চিঠি লিখেছিলাম মিটিংয়ের অনুমতির জন্য৷ চিঠি পাঠিয়েছিলাম তৎকালীন পুলিশ কমিশনারকেও৷ মমতাদি বলেছিলেন, শুধু আমার নামটা লিখে পাঠাও, ওরা অনুমতি দিয়ে দেবে৷ বাস্তবে তাই হল৷ দু’জায়গা থেকে অনুমতি পেয়ে গেলাম৷ বিশাল মিটিং হল মেয়ো রোডে৷ সেদিন অজিত পাঁজা ইনডোর কনফারেন্স ছেড়ে হেঁটে এসে মেয়ো রোডে মমতাদির আউটডোর মিটিংয়ে যোগ দিলেন৷ এর কিছুদিন পরে সুব্রত বক্সিকে সভাপতি, সঞ্জয় বক্সি যুব সভাপতি এবং আমাকে তৃণমূল মহিলা কংগ্রেসের সভানেত্রী করে কমিটি করে দিলেন মমতাদি৷ ১৯৯৮-এর ১ জানুয়ারি রেজিস্ট্রেশন পেয়ে গেল তৃণমূল কংগ্রেস৷ বাংলার বুকে আত্মপ্রকাশ করল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নতুন দল৷ গোটা বাংলাজুড়ে সে কী উন্মাদনা! এখনও চোখের সামনে ভাসে সেসব দিন৷ এরপর শুরু হল অন্য লড়াই৷ সেসময় আমাদের সঙ্গে ছিল ১৬ জন কাউন্সিলর৷ কিন্তু এই সংখ্যা থাকলে দলত্যাগ আইনের গেরোয় পড়ে যাব৷ সে এক কঠিন সময়৷ নিয়মানুযায়ী অন্তত ২৩ জন কাউন্সিলর লাগবেই৷ শুরু হল খোঁজ৷ সেসময় কেউই প্রায় আনকোরা তৃণমূলের সঙ্গে আসতে রাজি হচ্ছিল না৷ অনেকেই বলেছিলেন প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি, প্রণব মুখোপাধ্যায়ের মতো বড় বড় নেতারা দল ভেঙে বেরিয়ে গিয়ে কিছু করতে পারেননি৷ নতুন দল করে দাঁড় করাতে পারেননি৷ ব্যর্থ হয়েছেন৷ তৃণমূল কংগ্রেসও পারবে না টিকতে৷ কিন্তু মমতাদির একরোখা মনোভাব, সাহস, জেদ আর সিপিএমের বিরুদ্ধে অদম্য লড়াইয়ের শক্তি নিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে আমরা লড়ে গেলাম৷ আমাদের লড়াই শুরু হল৷ টালা থেকে টালিগঞ্জ ঘুরে ২৩ জন কাউন্সিলর পেয়ে গেলাম৷ সেসময় আমাদের সঙ্গে ছিলেন রুবি দত্ত, দিলীপ মজুমদাররা৷ কলকাতা কর্পোরেশনে তাঁদের সই করা চিঠি জমা পড়ল৷ কিন্তু তৎকালীন বিরোধী দলনেতা প্রদীপ ঘোষ চেয়ারম্যান পূর্ণেন্দু সেনগুপ্তকে বললেন, এগুলো জাল সই৷ এরা কেউ যোগ দেয়নি তৃণমূলে৷ এদের প্রমাণ করতে বলুন সশরীরে৷ এরপর মমতাদির নির্দেশে নিজাম প্যালেসে জড়ো হয়ে সেখান থেকে কর্পোরেশনে এসে সশরীরে সই করা হল৷ দলত্যাগ বিরোধী আইনের কবল থেকে আমরা বেঁচে গেলাম৷
১৯৯৯ সালে তৃণমূলে এলেন সুব্রত মুখোপাধ্যায়৷ এবার লড়াই শুরু হল কর্পোরেশনে বিরোধী দলনেতার পদ নিয়ে৷ অন্তত ৩৭ জন কাউন্সিলর না থাকলে এই পদ পাওয়া যাবে না৷ শুরু হল নতুন লড়াই৷ পরে আড়াই মাস ধরে ঘুরে সবমিলিয়ে জোগাড় হল ৩৭ জন৷ এবারও তাদের সই করা চিঠি জমা পড়ল৷ একইভাবে অস্বীকার করা হল জাল সইয়ের তকমা দিয়ে৷ কর্পোরেশনে সশরীরে হাজিরার নির্দেশ দিলেন পূর্ণেন্দু সেনগুপ্ত৷ তখন মেয়র ছিলেন সিপিএমের প্রশান্ত চট্টোপাধ্যায়৷ ফের নিজাম প্যালেস, সেখান থেকে মিনিবাসে ৩৭ জন গেলাম কলকাতা কর্পোরেশনের৷ হাসিল করলাম বিরোধী দলনেতার পদ৷ মমতাদি বিরোধী দলনেতা করলেন ৮৬ নং ওয়ার্ড থেকে জিতে আসা দুর্গা মুখোপাধ্যায়কে৷ আর আমাকে করলেন চিফ হুইপ৷ এরপর ২০০০ সালের কলকাতা কর্পোরেশনের নির্বাচন চলে এল৷ হইহই করে আমরা জিতলাম৷ মেয়র হলেন সুব্রত মুখোপাধ্যায়৷ আমিও মেয়র পারিষদের দায়িত্ব পেলাম৷ একাধিক গুরুত্বপূর্ণ দফতর সামলেছি৷ যে চেয়ারম্যান আমাদের সশরীরে হাজির হওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন, এখন তাঁর সেই ঘরে আমি বসি৷ কারণ, মমতাদি আমাকে কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান করেছেন৷
আজও মনে পড়লে গায়ে কাঁটা দেয়৷ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে সিপিএমের অত্যাচারের বিরুদ্ধে চোখে চোখ রেখে লড়াই করে আমরা জয় ছিনিয়ে এনেছি৷ কলকাতা পুরসভার মতো কঠিন জায়গা থেকে বামেদের হঠাতে পেরেছি৷ এখনও মমতাদির নেতৃত্বে আমাদের লড়াই চলছে৷ দেশ থেকে সাম্প্রদায়িক শক্তিকে সম্পূর্ণ নির্মূল না করা পর্যন্ত এই লড়াই চলবে৷

মমতাদির উপর ভরসা রেখেই অজানা সমুদ্রে ঝাঁপ দিলাম
পার্থ ভৌমিক
১ জানুয়ারি আমাদের তৃণমূল কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা দিবস, এই দিনটা আমাদের কাছে আবেগের, সম্মানের। প্রথম দিন থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বেই পথ চলেছি। মমতাদি তখন যুব কংগ্রেসের সভানেত্রী। আর আমি নৈহাটির যুব সভাপতি। সিপিএমের বিরুদ্ধে এককাট্টা লড়াই চলছে। আমাদের কর্মীরা মার খাচ্ছে, খুন হচ্ছে। তবুও সিপিএমের চোখে চোখ রেখে আমরা লড়াই করছি। কিন্তু মমতাদি বুঝতে পেরেছিলেন, কংগ্রেসে থেকে সিপিএমের বিরুদ্ধে বেশিদিন লড়াই করা যাবে না। তাই দল ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি। সেটা ১৯৯৭-এর মার্চ মাস। বহুচর্চিত ইনডোর-আউটডোর মিটিংয়ের পর্ব পেরিয়ে এসে ১৯৯৮ সালের পয়লা জানুয়ারি জন্ম নিল তৃণমূল কংগ্রেস। এক নতুন লড়াই শুরু হল। যে লড়াইটা এতদিন পর্যন্ত কংগ্রেসে থেকে করতে পারছিলাম না, এবার খোলা মনে সিপিএমের বিরুদ্ধে আরও জোরদার ভাবে মাঠে নামলাম আমরা। সামনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ১৯৯৮ সালের লোকসভা নির্বাচনে আমরা বারাকপুরে হারলেও বাকি অনেকগুলো জায়গায় জিতেছিলাম। এরপর একের পর এক প্রতিকূলতা পেরিয়ে এসেছি। একটার পর একটা ইস্যু নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে আন্দোলন আছড়ে পড়ল বাংলার বুকে। কোচবিহার থেকে কাকদ্বীপ, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দাপটে ভয় পেতে লাগল বামেরা। আরও তীব্র হল মার। খুন-জখম বেড়ে গেল। ১৯৯৮ সালে তৃণমূল কংগ্রেসের জন্ম হওয়ার পরেই সিপিএম বুঝে গিয়েছিল এবার ওদের কপালে দুঃখ আছে। কারণ, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নাছোড়বান্দা। তিনি সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন সিপিএমের বিরুদ্ধে। তাঁকেও আঘাত করা হয়েছে একাধিকবার। এমনকী মেরে ফেলার চক্রান্ত করা হয়েছে। প্রতিবারই কোনও না কোনওভাবে বেঁচে গিয়েছেন তিনি। এরপর একটার পর একটা নির্বাচন এসেছে। আমরা লড়াই করে গিয়েছি। কখনও হেরেছি, কখনও জিতেছে। একটা সময় বিরোধী দলের তকমা পেলাম। তখন বারাকপুর নৈহাটি অঞ্চলে সিপিএমের সে কী দাপট। তড়িৎ তোপদার ও তার গুন্ডাবাহিনী অত্যাচার করে বেড়াত বারাকপুর জুড়ে। আমরাও লড়াই দিতাম। আমরা আমাদের অনেক সহকর্মীকে হারিয়েছি। ১৯৯৩ সালের ২১ জুলাইয়ের গুলি চালানোর ঘটনার পর থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে প্রতিবছর ধর্মতলায় ওইদিন শহিদ দিবস পালন করা শুরু হয়। যা এখনও আমরা পালন করে চলেছি। কলকাতা অবরুদ্ধ হয়ে যেত মমতাদির ডাকে। এই বিশাল জনসভা থেকে তিনি আমাদের উদ্বুদ্ধ করতেন। আমরা নতুন লড়াইয়ের শক্তি পেতাম। সেই সময় বাংলার যেখানেই কোনও ঘটনা ঘটছে, অত্যাচার হচ্ছে, সেখানেই ছুটে যাচ্ছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আমাদের অঞ্চলে কতবার যে তিনি এসেছেন তার ইয়ত্তা নেই। তাঁর এই অদম্য জেদ, অসম সাহস, সিপিএমের বিরুদ্ধে একরোখা লড়াই আজ তৃণমূল কংগ্রেসকে এই জায়গায় নিয়ে এসেছে। আমরা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে সংগঠন করতে করতে পথ চলেছি। যখন যে দায়িত্ব তিনি দিয়েছেন মাথা নিচু করে পালন করেছি। কারণ যেদিন তাঁকে ভরসা করে অজানা সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়েছিলাম, সেদিনও যে আস্থা ছিল আজও সেই আস্থা-ভরসা অটুট রয়েছে। যতদিন বাঁচব ততদিন তাই থাকবে। আজ আমার যেটুকু তা সবটাই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্য। তিনি কয়েকটা প্রজন্মকে তৈরি করে দিয়েছেন। সিপিএমের মতো বৃদ্ধতন্ত্রে বিশ্বাসী নন তিনি। তিনি তৃণমূলের রিজার্ভ বেঞ্চ তৈরি করে দিয়েছেন। হাতে ধরে নেতা-মন্ত্রী তৈরি করেছেন। কাজ শিখিয়েছেন। সাংগঠনিক এবং প্রশাসনিক দুই-ই। আমি বিধায়ক থেকে সাংসদ হয়েছি তাঁর আশীর্বাদে। বাংলাকে বদলে দিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আমাদের মতো প্রান্তিক ছেলেমেয়েদের সামনের সারিতে তুলে এনেছেন তিনি। কারণ, তিনি নিজে ছাত্র রাজনীতি করতে করতে উঠে এসেছেন। মাটির সঙ্গে তাঁর বরাবরের যোগ। বাংলার মানুষের পালস তিনি চোখ বন্ধ করে বুঝতে পারেন। আর পশ্চিমবঙ্গবাসীও তাঁর উপর আস্থা-ভরসা রাখে। কোনও বিভেদকামী শক্তি বাংলায় বিভাজন তৈরি করতে পারবে না। সম্প্রীতির বাংলায়, ঐক্যের বাংলায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে এগিয়ে চলেছি আমরা। পাহাড় থেকে জঙ্গলমহল, গঙ্গাসাগর থেকে সুন্দরবন, বাংলার প্রতিটি ব্লকে অঞ্চলে আজ উন্নয়নের ছোঁয়া। লক্ষ্মীর ভাণ্ডার থেকে সবুজসাথী সাইকেল, বার্ধক্যভাতা—এরকম প্রায় ৭৯টি প্রকল্প বাংলার মানুষকে দিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কেন্দ্রীয় সরকারের বঞ্চনা সত্ত্বেও একটি প্রকল্পও বন্ধ হতে দেননি তিনি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলার মানুষের পাহারাদার। গোটা জীবনটাই তিনি উৎসর্গ করেছেন মানুষের সেবায়।

মুখ্যমন্ত্রীর হাত ধরে বদলে গিয়েছে জঙ্গলমহল
বীরবাহা হাঁসদা
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত ধরে বদলে গিয়েছে জঙ্গলমহল। শুধু জঙ্গলমহল কেন, বদলে গিয়েছে বাংলা। আজ দলের প্রতিষ্ঠা দিবসে বাংলার পাহারাদার নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে কুর্নিশ জানাই। কারণ ১৯৯৮ সালে ১ জানুয়ারি তৃণমূল কংগ্রেস তৈরি না হলে আজও অন্ধকারে ডুবে থাকত বাংলা। তিনি যথার্থই বুঝেছিলেন কংগ্রেসে থেকে সিপিএমের বিরুদ্ধে লড়াই করা যাবে না। তাই তৈরি করেছিলেন তৃণমূল কংগ্রেস। আমরা জঙ্গলমহলের মানুষরা আজ প্রাণ খুলে হাসতে পারি। আজকে সবার ঘরে অন্নের সংস্থান রয়েছে। উন্নয়নের ছোঁয়ায় বদলে গিয়েছে জঙ্গলমহল। একটা সময় শুধুই লাশ আর রক্ত দেখেছে এই জঙ্গলমহল। উন্নয়নের ছিটেফোঁটাও ছিল না। ২০১১ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়েই প্রথম পাহাড়ের সঙ্গে জঙ্গলমহলের উন্নয়নের জন্য আলাদা আর্থিক বরাদ্দ দিয়েছিলেন। সেই শুরু। তারপর থেকে রাস্তা, জল, লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, আদিবাসী জনজাতিদের পাট্টা, জঙ্গলের অধিকার, বাংলার বাড়ি, ১০০ দিনের কাজের টাকা, বার্ধক্য ভাতা, বিধবা ভাতা, সবুজসাথীর সাইকেল, কন্যাশ্রী, রূপশ্রী উজাড় করে দিয়েছেন জঙ্গলমহলের মানুষকে। এখন পর্যটনের নয়া ডেস্টিনেশন জঙ্গলমহল। একাধিক হোম-স্টে তৈরি হয়েছে রাজ্য সরকারের উৎসাহে। ঝাঁ চকচকে রাস্তা। একটা সময় যে রাস্তায় পড়ে থাকত তৃণমূল নেতা-কর্মীদের গুলিবিদ্ধ লাশ, আজ সেই রাস্তা ধরে দেশ-বিদেশের পর্যটকরা অনায়াসে চলে পারেন ঝাড়গ্রাম, বাঁকুড়া, পুরুলিয়ার প্রত্যন্ত এলাকায়।
১৯৯৮ সালের ১ জানুয়ারি বাংলার অগ্নিকন্যা আমাদের সকলের প্রিয় দিদি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে মা-মাটি-মানুষের কণ্ঠস্বর রূপে প্রতিষ্ঠিত হয় সর্বভারতীয় তৃণমূল কংগ্রেস। বাম জমানায় বাংলার মানুষ যেভাবে অত্যাচারিত, শোষিত হত বামেদের হাতে সেই অত্যাচারের প্রতিবাদ, প্রতিরোধ গড়ে তোলার অঙ্গীকার নিয়ে পথ চলছে বাংলা, অগ্নিকন্যার নেতৃত্বে তৃণমূল কংগ্রেসের আত্মপ্রকাশের পর থেকেই। বাংলার মানুষের প্রতি বঞ্চনার বিরুদ্ধে লড়াই শুরু হয়। সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম থেকে নেতাই গণহত্যা ঘটনার প্রতিবাদ-প্রতিরোধ গড়ে তোলে তৎকালীন বিরোধী নেত্রী তথা তৃণমূল কংগ্রেসের সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে। তাঁর সুদক্ষ নেতৃত্বে বাংলা আজ সোনার বাংলায় রূপান্তরিত হয়েছে। তৃণমূল কংগ্রেস শুধু একটি রাজনৈতিক দল নয়, বাংলার মানুষের অধিকারের কণ্ঠস্বর যা ১৯৯৮ সালে ১ জানুয়ারি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ২০১১ সালের পর ২০১৬ সাল ও ২০২১ সালে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তথা তৃণমূল সুপ্রিমোকে যে যতবার আক্রমণ করেছে ততবারই তৃণমূল কংগ্রেস তার আসন সংখ্যা বৃদ্ধি করেছে। এতেই প্রমাণিত হয় বাংলার মানুষ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে অন্তর থেকে ভালবাসে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্ব অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেনাপতিত্বে তৃণমূল কংগ্রেস আজ উন্নততর তৃণমূল কংগ্রেসে রূপান্তরিত হয়েছে।
জঙ্গলমহলের জন্য আলাদা জলপ্রকল্প করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। বাম সরকার একটা সময় বছরের পর বছর জঙ্গলমহল থেকে গায়ের জোরে ভোট নিলেও এই প্রান্তিক মানুষগুলোর দিকে কোনওদিন ফিরেও তাকায়নি, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উন্নয়নের ছোঁয়ায় আজ সেই জঙ্গলমহল এগোচ্ছে। এখানকার ছেলে-মেয়েরা রাজ্যস্তরে, জাতীয়স্তরে একাধিক জায়গায় সুনামের সঙ্গে কাজ করছে। খেলাধুলোতেও জঙ্গলমহলের ছেলে-মেয়েরা মাতিয়ে দিচ্ছে। এ-সবই সম্ভব হয়েছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কল্যাণে। তাই তিনি তৃণমূল কংগ্রেস নামক দলটি তৈরি না করলে বাংলার আজ এই নতুন চেহারা আমরা পেতাম না। মমতাময়ীর স্পর্শে আজ জঙ্গলমহলের মানুষেরা মাথা উঁচু করে বাঁচি। এটা আমাদের গর্ব। বিশেষ করে, বাংলার মহিলাদের সামনের সারিতে তুলে আনার জন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে কাজ করেছেন তা ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। তাই বলি, তৃণমূল কংগ্রেস আমার গর্ব, আমার আবেগ। দলের প্রতিষ্ঠা দিবসে তাই আবারও শপথ করি, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে বাংলাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার এই কর্মযজ্ঞে আমরা সকলেই পদাতিক সৈনিক ছিলাম আছি, থাকব। জয় জোহার। জয় বাংলা।

Latest article