২০১৯ সাল বাঙালি তথা সমগ্র ভারতবাসীর কাছেই গর্বের, আত্মশ্লাঘার বছর হয়ে থাকবে কারণ ২০১৯ সালে অষ্টম ভারতীয় নোবেল প্রাপক হিসাবে অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার প্রাপ্ত হন অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়, তাঁর সাথে যৌথভাবে সেই পুরস্কার প্রাপ্ত হন এস্থার ডাফলো এবং হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মাইকেল ক্রেমার। তবে লজ্জার কথা এই যে, কেন্দ্রের বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রকের মন্ত্রী পীযূষ গোয়েল তাঁর গবেষণার কাজটিকে বিন্দুমাত্র না জেনে মন্তব্য করেন “ভারতবর্ষের মানুষ অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাজকে বাতিল করে দিয়েছে” এবং আরও মন্তব্য করেন “তাঁর কাজ বামপন্থা মতাদর্শ ভিত্তিক”, এই মন্তব্যের আরও একধাপ উপরে উঠে ন্যক্কারজনক মন্তব্য করেন তৎকালীন বিজেপির সর্বভারতীয় জাতীয় সম্পাদক রাহুল সিনহা, তিনি বলেন, “যাঁদের দ্বিতীয় স্ত্রী বিদেশিনি তাঁরাই বেশিরভাগ সময় নোবেল পদকপ্রাপ্ত হচ্ছেন।” বিজেপির এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ও জাতীয় স্তরের এক নেতার এই ধরনের মন্তব্যই প্রমাণ করে দিয়েছিল সেই দলের কূপমণ্ডূকতাকে এবং অপরের মতামত, অপরের জ্ঞানচর্চার প্রতি তাদের অনীহা এবং অসহিষ্ণুতাকে। ব্যক্তি মানুষকে কালিমালিপ্ত করাই বিজেপি নামক এই রাজনৈতিক দলের প্রকৃত চরিত্র। অধ্যাপক অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় যে-কাজের জন্য নোবেল প্রাপ্ত হন সেটি হল ‘বিশ্ব দারিদ্রতা মুক্তির জন্য পরীক্ষামূলক পদ্ধতির প্রয়োগ’।
অধ্যাপক অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই পরীক্ষামূলক পদ্ধতিকে সহজে বুঝলে এবং তার অনুষঙ্গে ২০২১ সাল থেকে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের লক্ষ্মীর ভাণ্ডার প্রকল্পের কার্যকারিতাকে বোঝার প্রয়াস করলে লক্ষ্মীর ভাণ্ডার প্রকল্পের তাৎপর্যগুলো আমাদের কাছে পরিষ্কার হবে। বিজেপি, সিপিএম, কংগ্রেস-সহ বিরোধীরা যেখানে লক্ষ্মীর ভাণ্ডার প্রকল্পকে ‘পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতি’ বলে তকমা দেন সেখানে এই প্রকল্পের সুদূরপ্রসারী প্রভাব ও প্রত্যক্ষ প্রভাবগুলোকে আলোচনা করা অতি-আবশ্যক। অধ্যাপক অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, সমাজের সার্বিক পরিবর্তন, বিপ্লব এগুলো অনেক বড় শব্দ। যাঁরা দীর্ঘদিন ধরে সমাজ পরিবর্তনের আন্দোলন চালাচ্ছেন তাঁরাও বলতে পারবেন না কখন সামগ্রিক বিপ্লব পরিপূর্ণ আকার নেবে। মনে হতে পারে দারিদ্র্য দূরীকরণ, নারীর উন্নয়ন, নারীর প্রগতি কী ছোটখাটো কোনও পরিবর্তন, কোনও প্রকল্পের বাস্তবিক রূপায়ণের মধ্যে দিয়ে আসতে পারে? তার উত্তর— হ্যাঁ পারে, কারণ কোন পরিবর্তন ছোট আর কোনটা বড় তা ইতিহাস স্থির করে আর যেটাকে আজ সামান্য মনে করা হচ্ছে কোনও একদিন দেখা যেতে পারে সেটা একটা বৃহৎ পরিবর্তনের আকার নিয়েছে। উদাহরণ প্রয়োগ করে বিষয়টাকে আরও পরিষ্কারভাবে ব্যক্ত করেছেন তিনি। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল-এর হিসাব মতো ২০১০ সালে উগান্ডা ছিল দুর্নীতির সূচকে ১৭৮টা দেশের মধ্যে ১২৭। নব্বই-এর মাঝামাঝি আফ্রিকার উগান্ডাতে কাজ করতে গিয়ে ইউরোপের দুই গবেষক দেখেন সে-দেশের সরকার স্কুলগুলোর উন্নয়নের জন্য যে টাকা বরাদ্দ করছে, গড়ে তার মাত্র ২৪ শতাংশ পৌঁছচ্ছে তাদের কাছে, গরিব স্কুলগুলো পাচ্ছে আরও কম টাকা, বহু স্কুল কোনও টাকাই পাচ্ছে না। বিষয়টা জানাজানি হতে সে-দেশের সরকার একটা অন্য ধরনের উদ্যোগ নিল। কোন স্কুলের জন্য কত টাকা মঞ্জুর হয়ে গিয়েছে তা প্রতি মাসে ছেপে দিতে লাগল খবরের কাগজে। এগুলো ১৯৯৬ সালের কথা। ২০০১ সাল থেকে ফের খোঁজ করে ওই গবেষকরা দেখলেন এখন গড়ে স্কুলগুলো পাচ্ছে মঞ্জুর করা টাকার ৮০ শতাংশ, যে স্কুল খবরের কাগজের দোকানের যত কাছে সে তত বেশি টাকা পাচ্ছে। এখানে কোনও রাজনৈতিক বিপ্লব হয়নি সার্বিক বিধিব্যবস্থার বদল হয়নি। তবুও পরিবর্তন হয়েছে।
আরও পড়ুন- ‘গণতন্ত্রে মানুষ ভুল করে না’ জনগর্জন সভায় বার্তা অভিষেকের
সমভাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের লক্ষ্মীর ভাণ্ডার প্রকল্প নারী জাতির উন্নয়নে এক নতুন দিগন্ত এনেছে, নারীকে স্বনির্ভরতার লক্ষ্যে পৌঁছে দিচ্ছে। ঐতিহাসিক কাল থেকে নারী জাতি যে অবহেলিত সেই সমস্যার সমাধানের বিষয়ে সমাজতাত্ত্বিক, অর্থনীতিবিদ থেকে শুরু করে রাজনীতিবিদেরা সচেতন এবং তারা পুরুষতান্ত্রিক কাঠামোকে বদলানোর কথা বলেছেন, স্বপ্ন দেখিয়েছেন। কিন্তু পরিশেষে দেখা গেছে এই সমস্যার শিকড় এত গভীরে নিমজ্জিত এবং এত বহুমাত্রিক যে তাকে উপড়ে ফেলা কঠিন। আমাদের জন্ম থেকেই সমাজ আমাদের নির্দিষ্ট করে শিখিয়ে দেয় যে কোনটা পুরুষের ক্ষেত্র, কোনটা নারীর ক্ষেত্রে। বাবা-মা আমাদের শেখান ছেলেরা খেলা করবে বন্দুক নিয়ে, ব্যাট নিয়ে বল নিয়ে আর মেয়েরা খেলা করবে খেলনা-বাটি নিয়ে, পুতুল নিয়ে। এখান থেকেই শুরু হয়ে যায় মেয়েদের পরাধীনতার যাত্রা, তাই এই ব্যবস্থাকে সমূলে উপড়ে ফেলা কঠিন। সেখানে তাই প্রয়োজন হয় লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের মতো প্রকল্পগুলো যা মহিলাদের আত্মনির্ভর করতে, মর্যাদা বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে।
(এরপর আগামী কাল)