কুৎসা-ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে আপসহীন লড়াইয়ের নাম তৃণমূল কংগ্রেস

তৃণমূল কংগ্রেস আজ মহীরুহ। বাংলা ছাড়িয়ে জাতীয় স্তরেও আলোচনার বিষয় তৃণমুল। লোকসভা ও রাজ্যসভা মিলিয়ে দলের ৪২ জন সাংসদ।

Must read

সুব্রত বক্সি: তৃণমূল কংগ্রেস আজ মহীরুহ। বাংলা ছাড়িয়ে জাতীয় স্তরেও আলোচনার বিষয় তৃণমুল। লোকসভা ও রাজ্যসভা মিলিয়ে দলের ৪২ জন সাংসদ। এই সাফল্য একদিনে আসেনি। এর পিছনে রয়েছে লক্ষ লক্ষ তৃণমুল কর্মীদের রক্ত-ঘাম। দলের জন্য কত শত কর্মী নিজের জীবন বলিদান দিয়েছেন। আমাদের প্রাণপ্রিয় সর্বজনশ্রদ্ধেয় নেত্রী তথা বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সিপিএমের বিরুদ্ধে আপসহীন লড়াই-আন্দোলন আমাদের দলকে এই জায়গায় নিয়ে এসেছে। নেত্রী আমাদের পথ দেখিয়েছেন, আমরা সেই পথে হেঁটেছি। আজ বাংলার বুকে আমরা শাসক দল। তিনবারের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন সরকার গত ১২টা বছর ধরে বাংলার সব প্রান্তের, সর্বস্তরের মানুষের জন্য যে উন্নয়ন করেছে, একের পর এক সামাজিক প্রকল্প এনে বিপ্লব ঘটিয়েছে তার তুলনা গোটা দেশে নেই। এখন অন্যান্য রাজ্য অনুসরণ শুধু নয়, বাংলাকে অনুকরণ করে। লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, কন্যাশ্রীর মতো যুগান্তকারী সামাজিক প্রকল্পগুলি একাধিক আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে। সর্বভারতীয় স্তরে জনবিরোধী বিভিন্ন ইস্যুতে বিজেপি সরকারকে চেপে ধরছেন তৃণমূল কংগ্রেসের লোকসভা ও রাজ্যসভার সাংসদরা। ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনকে পাখির চোখ করে দেশে বিজেপি বিরোধী ২৬টি বিরোধী দলকে এক ছাতার তলায় আনতে মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন দেশনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। নেত্রীর উদ্যোগেই গড়ে ওঠা ইন্ডিয়া জোট আজ বিজেপিকে ধাক্কা দিয়ে এক ঝটকায় নিচে নামিয়ে দিয়েছে। ওদের একক দাদাগিরি আর চলছে না। একে ওকে ধরে সরকার তৈরি করতে হয়েছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এর সক্রিয় ভূমিকা গোটা দেশের রাজনৈতিক মহলে চর্চিত হচ্ছে। বিরোধী জোটের নামও নেত্রীর দেয়া। যাবতীয় কুৎসা, অপপ্রচার, মিথ্যাচার, এজেন্সী রাজনীতি, নির্বাচন কমিশনের চোখরাঙানি, কেন্দ্রীয় বাহিনীর অত্যাচার সব হার্ডল পেরিয়ে বাংলায় ২৯টি আসন পেয়েছে তৃণমুল কংগ্রেস। বাংলার মানুষ ভরসা রেখেছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপর। এবার শুধুই উন্নয়ন। তবে আমাদের অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসে গা ছাড়া দিলে চলবে না। আমাদের নিরলসভাবে মানুষের পাশে থেকে তাদের জন্য কাজ করে যেতে হবে। এই মুহূর্তে আর কোনও নির্বাচন নেই। কিন্তু দলের সংগঠনকে আরও শক্তিশালী করার লক্ষ্যে আমাদের নিরন্তর কাজ করে যেতে হবে। দলীয় শৃঙ্খলা মেনে সকলকে চলতে হবে। মনে রাখতে হবে দলের ঊর্ধ্বে কেউ নয়। দলের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।

আরও পড়ুন-রক্তের অক্ষরে লেখা একুশে জুলাই

নেত্রী আমাদের শিখিয়েছেন মানুষের সুখের সময় না থাকলেও বিপদে তাদের পাশে দাঁড়াতে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেই আদর্শ-নীতি-নির্দেশকে অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলছি আমরা। তৃণমূল কংগ্রেস একটা বৃহত্তর পরিবার। এখন দলের অনেক শাখা সংগঠন। ছাত্র-যুবরা রয়েছে। প্রতিদিন নতুন নতুন ছেলেমেয়েরা উঠে আসছে। তারা একদিকে যেমন প্রতিভাবান, আবার তাদের মধ্যে আগামীর নেতা-নেত্রী হওয়ার মশলাও রয়েছে। তাদের দেখে মন ভরে যায়। অল্প বয়সেই তাদের অনেকে দারুণ বক্তা। দারুণ সংগঠক। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে ছাত্র রাজনীতি করে উঠে এসেছেন। তিনি নিজেও এই নতুন প্রজন্মকে উৎসাহ দেন। আমাদের কয়েকটা প্রজন্মকে তিনি হাতে ধরে তৈরি করেছেন। কাউন্সিলর-বিধায়ক-সাংসদ-মন্ত্রী করেছেন। নতুনদের নিয়েও নেত্রী আশাবাদী। আজ দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় সামনে থেকে বুক চিতিয়ে নেতৃত্ব দিচ্ছে দলকে। ওকে এইটুকু থেকে বড় হতে দেখলাম। এখন ও পরিণত রাজনীতিতে। যত সময় যাচ্ছে তত পরিণত দেখাচ্ছে অভিষেককে। দলের ছাত্র-যুবরা ওর জন্য পাগল। বিরোধীরাও একযোগে অভিষেককে নিশানা করছে। ও-ও লড়ছে সামনে থেকে। এভাবেই তো এগোতে হবে আগামীর পথে।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সবসময় একটা কথা বলেন। নতুনরা যারা দলে আসছে তারা যেন তৃণমূল কংগ্রেসের ইতিহাসটা জানে। মনে রাখে। আজকের এই দিন কিন্তু শুরুতে ছিল না। নেত্রীর নির্দেশে আমি যেখানেই বক্তব্য রাখি, দু’-চার কথা বলি দলের ইতিহাস নিয়ে। কেন তৃণমূল কংগ্রেস তৈরি হল! এই যে ২১ জুলাইয়ের শহিদ সমাবেশই বা কেন? জানতে হলে পিছিয়ে যেতে হবে ১৯৯৩ সালে।

আরও পড়ুন-আমরা তো ভুলি নাই শহিদ…

তখন ঘোর বাম জমানা। বাংলার আকাশে তখন সিপিএমের কালো মেঘ। তাদের পেশিশক্তির দাপটে কাঁপছে গোটা বাংলা। তখন ভোটের নামে চলে শুধু প্রহসন। ভোটার কার্ড বলে তখনও কিছুই নেই। তৎকালীন কংগ্রেস সভানেত্রী বাংলার অগ্নিকন্যা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় লড়ছেন সিপিএমের বিরুদ্ধে। গড়ে তুলছেন প্রতিবাদ-আন্দোলন। ১৯৯৩ সালেই নেত্রী ডাক দিলেন ‘নো আইডেন্টিটি কার্ড, নো ভোট’। সচিত্র পরিচয়পত্র-সহ ভোটের দাবিতে মহাকরণ অভিযানের ডাক দিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথমে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, ১৪ জুলাই মহাকরণ অভিযান হবে। কিন্তু আচমকাই তৎকালীন রাজ্যপাল নুরুল হাসান ১২ জুলাই প্রয়াত হন। রাজনৈতিক শিষ্টাচার মেনে মহাকরণ অভিযান পিছিয়ে দেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এরপর একুশে জুলাই হয় সেই মহাকরণ অভিযান। ব্রেবোর্ন রোড, সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ, মেয়ো রোড— একাধিক দিক দিয়ে যুব কংগ্রেসের মিছিল আসতে শুরু করে। কিন্তু কোনওরকম প্ররোচনা ছাড়াই পুলিশ গুলি চালালে ১৩ জন তরতাজা যুবক শহিদ হন। আহত হন আরও অনেকে। কোনওরকমে বেঁচে যান নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কলকাতার রাজপথ তখন রক্তে লাল।
চারদিকে খবর ছড়িয়ে পড়তেই স্তব্ধ হয়ে যায় কলকাতা-সহ গোটা বাংলা। বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসে এই দিনটি রক্তে রাঙানো দিন হিসেবে থেকে যাবে চিরকাল। এরপরই তৎকালীন বাম নেতারা বলতে শুরু করেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মহাকরণ দখল করতে গিয়েছিলেন। কিন্তু তা ছিল ডাহা মিথ্যে কথা। মহাকরণ অভিযানের আসল কারণ ছিল, সে-সময় সেখানে বসতেন নির্বাচন কমিশনার। সেখান থেকে পরিচালিত হত যাবতীয় নির্বাচনী কাজকর্ম। ফলে সচিত্র পরিচয়পত্র-সহ ভোটের দাবিতে সতীর্থদের নিয়ে মহাকরণ অভিযানের ডাক দিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সিপিএমের তৎকাল নেতারা রাজনৈতিক উৎসাহ ও নিজেদের ক্ষমাহীন অপরাধ ঢাকতে মিথ্যে প্রচার শুরু করে। যদিও তা ফলপ্রসূ হয়নি। সেদিনও বাংলার মানুষ ওদের বিশ্বাস করেনি। সবাই বুঝেছিল যুব কংগ্রেসের মিছিলে সিপিএমের পুলিশ বিনা প্ররোচনায় গুলি চালিয়ে ১৩ জন তরতাজা যুবককে হত্যা করেছিল।

আরও পড়ুন-আন্দোলনের ধাত্রীভূমি, একুশের ধর্মতলা

এরপর থেকেই প্রতি বছর একুশে জুলাই শহিদদিবস পালন করি আমরা। ১৯৯৮ সালে তৃণমূল কংগ্রেস তৈরি হওয়ার পরও যা অব্যাহত থেকেছে। যুব কংগ্রেসের সভানেত্রী থাকাকালীনই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে, কংগ্রেসের মধ্যে থেকে সিপিএমের বিরুদ্ধে লড়াই করা সম্ভব নয়। একই সঙ্গে তিনি গোটা বাংলা জুড়ে সভা করতে গিয়ে আরও একটা বিষয় বুঝতে পারেন, প্রত্যেকটি জনসভায় প্রচুর মানুষের ভিড় হলেও তা ভোট বাক্সে প্রতিফলিত হচ্ছে না, কারণ সিপিএম তাদের পেশিশক্তি দিয়ে বাংলার মানুষের ভোটাধিকার দাবিয়ে রাখত। ভোট লুট হত অবাধে। অথচ তৎকালীন কংগ্রেস নেতৃত্বের তা নিয়ে কোনও হেলদোল ছিল না। তাঁরা তলায় তলায় সিপিএমের সঙ্গে সেটিং করে চলছেন। কংগ্রেস ছেড়ে বেরিয়ে এসে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তৈরি করলেন নতুন দল।

আরও পড়ুন-‘শহীদদের স্মরণে বিনম্র শ্রদ্ধা’ ২১শে জুলাইয়ের স্মৃতিচারণ মুখ্যমন্ত্রীর

১৯৯৮ সালের ১ জানুয়ারি তৈরি হল ‘তৃণমূল কংগ্রেস’। একের পর এক ইস্যু নিয়ে বাংলার মানুষকে সঙ্গে নিয়ে সিপিএমের বিরুদ্ধে চলতে থাকল আপসহীন লড়াই-সংগ্রাম-আন্দোলন। ভয় পেতে শুরু করে সিপিএম-সহ বাম সরকার। নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ওপর শুরু হয় ন্যক্কারজনক আক্রমণ। গোটা বাংলা জুড়ে খুন হতে থাকেন একের পর এক তৃণমূল কংগ্রেসের নেতা-কর্মীরা। কিন্তু তাতেও দমিয়ে রাখা যায়নি আপসহীন সংগ্রামের নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। চলতে থাকে লড়াই-সংগ্রাম।
এরপর সিপিএমের বিরুদ্ধে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের ঐতিহাসিক আন্দোলন পর্ব পেরিয়ে এসে ২০১১ সালে বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসে ঘটে গেল এক উলটপুরাণ। হল পরিবর্তন। বাংলার মানুষ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থীদের দু’হাত তুলে আশীর্বাদ করলেন। সবুজ-ঝড়ে উড়ে গেল ৩৪ বছরের জগদ্দল পাথর হয়ে বসে থাকা সিপিএম ও বামেরা। ওরা ধুয়ে-মুছে সাফ হয়ে গেল বাংলার মাটি থেকে। বাংলার আকাশ থেকে সরে গেল সিপিএমের কালো ছায়া। সেই পর্ব পেরিয়ে এসে ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনে উগ্র সাম্প্রদায়িকতা ও প্রবল আর্থিক চাপের মধ্যেও মাথা উঁচু করে হেলায় হারিয়ে দিয়ে আজ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে উন্নয়নের পথে এগিয়ে চলেছে।
এত বছর ধরে ধর্মতলায় একুশে জুলাই শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে হয় সমাবেশ। বাংলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সর্বস্তরের মানুষ এসে হাজির হন কলকাতার রাজপথে। এবারও তার ব্যতিক্রম হবে না। এবারও জমায়েতের রেকর্ড করবে তৃণমুল। ধর্মতলার একুশে মঞ্চ থেকে নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আমাদের আগামীর পথ চলার দিশা দেখাবেন। দিকনির্দেশ দেবেন জাতীয় স্তরে ও বাংলায় কোন পথে কীভাবে চলবে দল। দেবেন আগামীর কর্মসূচিও। তার নির্দেশকে পাঠিয়ে করেই আমাদের চলতে হবে আগামী একটা বছর।
তৎকালীন সভানেত্রী কংগ্রেস ছাড়লেও একুশে জুলাই শহিদ সমাবেশকে তৃণমূল কংগ্রেসে এসেও পালন করে চলেছেন। কংগ্রেসের দোরগোড়ায় ছেড়ে আসেননি। এবারের শহিদ তর্পণ দিনটি আমরা উৎসর্গ করছি লোকসভা নির্বাচন ও উপনির্বাচনের বিপুল জয় হিসেবে। সেই সঙ্গে শ্রদ্ধা থাকবে শহিদ পরিবারের সদস্যদের প্রতিও। তাঁদের প্রিয়জনের আত্মত্যাগ তৃণমূল কংগ্রেস পরিবার ভোলেনি কোনওদিন ভুলবে না। এটা আমাদের অঙ্গীকার।

Latest article