মণীশ কীর্তনীয়া : দেশে বিজেপিকে রুখতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই ভরসা। উপলব্ধি বাম শরিকদের। কেউ স্বীকার করছেন, কেউ করছেন না।
বড় শরিকের ভয় আগেও ছিল এখনও আছে। তাই ফ্রন্টলাইন নিয়ে সোজা ব্যাটে আজও খেলতে পারেন না বামফ্রন্টের শরিক দলের নেতারা। কে প্রধান শত্রু, বিজেপি নাকি তৃণমূল কংগ্রেস— বড় শরিক সিপিএমের মতো ফরোয়ার্ড ব্লক, আরএসপি, সিপিআই-এর মতো তথাকথিত ছোট শরিকদলের নেতাদেরও গুলিয়ে যায়। এই মুহূর্তে যেমন কেরলের কান্নুরে ২৩তম পার্টি কংগ্রেসের আলোচনাতেও গুলিয়ে দিচ্ছেন বঙ্গ সিপিএমের মাতব্বররা। ফ্রন্টের শরিক নেতারা ঠারেঠোরে স্বীকার করছেন বিজেপিকে ঠেকাতে অদূর ভবিষ্যতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত ধরতেও হতে পারে।
কেরল সিপিএম যেমন স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছে সেখানে কংগ্রেসের সঙ্গে কোনওরকম জোটে তাঁরা যাবেন না। কিন্তু বঙ্গ সিপিএমের ম্যানেজাররা তা জোর দিয়ে বলতে পারছেন না। তাঁদের তো নিজেদের স্বার্থে এখানে কংগ্রেসকেও চাই আবার আইএসএফকেও চাই। সিপিআইএমএল (লিবারেশন)-এর নেতা দীপঙ্কর ভট্টাচার্যের মতো বুকের পাটা ও সৎসাহস কোনওটাই বামফ্রন্টের নেতাদের নেই৷ বিহার নির্বাচনের ফলাফল দেখে দীপঙ্কর বলেছিলেন, দেশে এখন প্রধান শত্রু বিজেপি। তৃণমূল কংগ্রেস বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াই করছে। পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতা রয়েছে। তাই বিজেপিকে রুখতে প্রয়োজনে তৃণমূল কংগ্রেসের হাত ধরুক সব দল। দেশের ও বাংলার বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনুযায়ী এরাই এখন সবচেয়ে জরুরি ও সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত। কিন্তু মনে প্রাণে একথা বাম দলগুলি বিশ্বাস করলেও মুখে স্বীকার করতে প্রবল অনীহা। তা বড় শরিক সিপিএমের ভয়ে না ভক্তিতে তা তাঁরাই জানেন।
ফরওয়ার্ড ব্লক নেতা হাফিজ আলম সৈরানি তবুও স্বীকার করলেন, এখনই বাংলায় না হলেও জাতীয় স্তরে বিজেপিকে ঠেকাতে তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে বোঝাপড়া হতেই পারে। তিনি মনে করেন, দেশে একমাত্র তৃণমূল কংগ্রেসই বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াই করছে সংসদের বাইরে ও ভিতরে। তবে অদূর ভবিষ্যতে পরিস্থিতি অনুযায়ী বাংলাতেও তৃণমূল কংগ্রেসের হাত যে ধরা হবে না তা এখনই স্বীকার না করলেও অস্বীকারও করছেন না সৈরানি। অপর দুই শরিক তথা আরএসপি ও সিপিআই-এর দুই বর্ষীয়ান নেতা মনোজ ভট্টাচার্য ও স্বপন বন্দোপাধ্যায়ের বক্তব্য, কোনও অবস্থাতেই তৃণমূল কংগ্রেসের (Trinamool Congress) হাত ধরা যাবে না। প্রশ্ন ছিল, বিজেপিকে ঠেকাতেও নয়? দু’জনেরই উত্তর, না। এরা বিজেপিকে প্রধান শত্রু বলে মনে করলেও লিবারেশন নেতা দীপঙ্কর ভট্টাচার্যর সঙ্গে একমত নন। কিন্তু অদ্ভুতভাবে ফ্রন্ট নেতারা বেমালুম ভুলে গিয়েছেন ৮০-র দশকে সিপিএম বিজেপির হাত ধরেছিল। প্রয়াত জ্যোতি বসুর সঙ্গে কলকাতার শহিদমিনার ময়দানে বিজেপির তৎকালীন শীর্ষনেতা অটলবিহারী বাজপেয়ীর সঙ্গে দু’হাত তোলা ছবি বঙ্গরাজনীতির চর্চাকারীরা আজও ভোলেননি। তখন বোধহয় বিজেপি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাবাজের দল ছিল না? ফ্রন্টের শরিক দলের নেতারাও জ্যোতি বসুকে নিয়ে গদগদ ছিলেন।
বঙ্গ রাজনীতিতে বামেরা আজ শূন্য। দেশে একমাত্র কেরল ও খানিকটা তামিলনাড়ু ছাড়া সিপিএমের কোথাও কোনও অস্তিত্ব নেই৷ কান্নুরে সিপিএমের পার্টি কংগ্রেসে প্রকাশ কারাট সে কথা বলেওছেন। কিন্তু সিপিএম নেতাদের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কে অ্যালার্জি আজও যায়নি। আসলে তাঁর কাছে হেরে সিপিএমটা প্রায় উঠতে বসেছে, এটা হজম করতে অসুবিধে হয় সিপিএমের। তাই আর যাই হোক, তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে নয়। কিন্তু সবকিছুই দেরিতে উপলব্ধি করা সিপিএম কি বুঝতে পারছে না বিজেপির মতো ধ্বংসাত্মক ও জনবিরোধী দলকে রুখতে গেলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দরকার, তৃণমূল কংগ্রেসকে দরকার। বুঝছেন ঠিকই, স্বীকার করছেন না। তাঁদের শরিকদের অবস্থাও একইরকম। অতএব তৃণমূল কংগ্রেসের (Trinamool Congress) অন্ধ বিরোধিতা চলুক। তাতে বিজেপি বাড়লে বাড়বে। আর ক্ষমতায় থাকা প্রবল বাম জমানার মতো যাই ঘটুক না কেন, যন্ত্রের মতো বলে যেতে হবে বড় শরিক সিপিএমের থেকে আমরা আশা করি তাঁরা বামফ্রন্টকে আরও সংগ্রামী ও মজবুত করবেন। বামঐক্য আরও আরও শক্তিশালী হোক।
এর বেশি আর কীই-বা বলার আছে বামদলগুলির। ক্ষমতায় না থাকার কারণে রক্তাল্পতায় ভুগছে বামেরা। সংগঠন তলানিতে। এরপরেও পার্টির অন্দরে চলছে ক্ষমতার জন্য লবির লড়াই। পার্টিকে শূন্যে নামানো মহম্মদ সেলিমের মতো নেতারা আজ সামনের সারিতে। ফল যা হবার তাই হচ্ছে। হবে। তবে মুখে স্বীকার না করলেও সিপিএম-সহ ফ্রন্টের শরিক দলের নেতারাও জানেন বিজেপিকে রুখে দিয়ে দেশ ও বাংলা বাঁচাতে পারেন একমাত্র মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই।