প্রতিবেদন : দলীয় প্রার্থীদের হয়ে প্রচারে গোটা রাজ্য চষে ফেলছেন তিনি। কখনও উত্তরে, কখনও দক্ষিণে। প্রতিটি সভাতেই পেড়ে ফেলছেন বিজেপিকে। তুঙ্গ আত্মবিশ্বাসে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিচ্ছেন মঞ্চে দাঁড়িয়ে। এবার নিউজ-১৮ বাংলা চ্যানেলের একান্ত সাক্ষাৎকারেও ধরা পড়ল তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের (Abhishek Banerjee) সেই আত্মবিশ্বাস। শুক্রবার তিনি বলে দিলেন, ২০১৯-এর থেকেও ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনে ভাল ফল করবে তৃণমূল কংগ্রেস। বাড়বে আসন ও ভোট দুই-ই। বুঝিয়ে দিলেন বাংলা এখনও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তৃণমূল কংগ্রেসকেই চায়। আর দলের সৈনিক হিসেবে তিনি কাজ করে যাবেন।
ডায়মন্ড চ্যালেঞ্জ : অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় বলেছিলেন ডায়মন্ড হারবারে অভিষেকের ঘনিষ্ঠ দু’জনকে গ্রেফতার করলে হেরে যাবেন তিনি। এদিন পাল্টা চ্যালেঞ্জে অভিষেক বলে দিলেন, ১ জুন ডায়মন্ড হারবারে ভোট। ওই দিন পর্যন্ত আমাকে গ্রেফতার বা গৃহবন্দি করে রাখুন। ডায়মন্ড হারবারে পা দেব না। আপনি আমার বিরুদ্ধে প্রার্থী হোন। মানুষের দরবারে বিচার হবে কে জিতবে।
ভাবমূর্তি : ২০২১-এ নির্বাচনে হারার পর বিজেপি ইডি-সিবিআই ও মিডিয়ার একাংশকে দিয়ে ভাবমূর্তি নষ্ট করতে চাইছে তৃণমূলের। এটা আসলে যত না ভাবমূর্তি নষ্ট করা তার থেকেও বেশি মনোবল ভাঙার খেলা। যে কারণে আমাকে ইডি ১২ বার ডেকেছে। তৃণমূল নেতাদের ক্রমাগত হেনস্থা করে যাচ্ছে। কিন্তু যত ওরা এভাবে ডাকবে, আমার তত মনোবল বাড়বে। অনেকেই বশ্যতা স্বীকার করে নিয়েছে। আমি করব না। মাথা উঁচু করে লড়াই করব। বিজেপির সঙ্গে সেটিং থাকলে আমাকে নিশ্চয়ই ১২ বার ডাকত না। শুধু আমাকে কেন? আমার স্ত্রী, বাবা-মা কাউকে ছাড়েনি। আমার বাচ্চা দুটো নেহাত ছোট, না হলে ওদেরও ডাকত।
সন্দেশখালি : সন্দেশখালি নিয়ে রাজনীতি হয়েছে। মনে রাখতে হবে শেখ শাহজাহানকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুলিশ গ্রেফতার করেছে। এফআইআর করেছিল ইডি। হাইকোর্ট যদি হাত-পা বেঁধে রাখে পুলিশের, তারা কী করবে? শিবপ্রসাদ হাজরা ও উত্তম সর্দারের বিরুদ্ধে নারী নির্যাতনের অভিযোগ ছিল। পুলিশ গ্রেফতার করেছে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত সিবিআই তাদের হেফাজতে নেয়নি কেন? এই যে বললাম এবার হয়তো নেবে! আমরা কাউকে রেয়াত করিনি। সে যেই হোক। পার্থ চট্টোপাধ্যায়, জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক-সহ প্রত্যেকের বিরুদ্ধে দল ব্যবস্থা নিয়েছে। কিন্তু বিজেপি কী করেছে? কূলদীপ সিং সেঙ্গার, ব্রিজভূষণ, বিএস ইয়েদুরাপ্পা-সহ আরও যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ বিজেপি তাদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নিয়েছে। ৭০ হাজার কোটির দুর্নীতির মু্খ্য অভিযুক্ত এখন মহারাষ্ট্রের বিজেপি সরকারের উপ-মুখ্যমন্ত্রী। এরাজ্যে ক্যামেরার সামনে কাগজে মুড়ে যে টাকা নিয়েছে সে বিজেপিতে যোগ দিয়ে বিরোধী দলনেতা। প্রধানমন্ত্রী এদের পাশে নিয়ে বসেন।
বাংলার বঞ্চনা : ২০২১-এ হারার পর থেকে টাকা বন্ধ করেছে কেন্দ্র। আমি তো চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলেছি, গত তিনটি অর্থবর্ষে ১০০ দিনের কাজের টাকা ও আবাসের বাড়ির জন্য ১০ পয়সাও যদি কেন্দ্র দিয়েছে প্রমাণ করতে পারে, রাজনীতি ছেড়ে দেব। আজ একটা নতুন চ্যালেঞ্জ দিচ্ছি। উত্তরপ্রদেশে ৫২ লক্ষ ভুয়ো কার্ড পাওয়া গিয়েছে। বাংলায় সংখ্যাটা ২২ লক্ষ। বিজেপি বাংলার টাকাটা বন্ধ করেছে। উত্তরপ্রদেশে বন্ধ করেনি। মধ্যপ্রদেশে আবাস দুর্নীতি হয়েছে। আবেদন পর্যন্ত করেনি এরকম লোকজন টাকা পেয়েছে। চারচাকা গাড়ি রয়েছে, বাড়ি রয়েছে সেরকম লোকজনও রয়েছে। সেখানে কেন্দ্র টাকা বন্ধ করেনি। কিন্তু বাংলায় বন্ধ করেছে।
নিয়োগ : মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার চাকরি দিতে চায়। সুপার নিউমেরিকে সংখ্যা বাড়ানো-সহ একাধিক পদ্ধতি অবলম্বন করে কোর্টের কাছে আবেদন করা হয়েছিল, আপনারা বলে দিন কোন পথে যাব। সেদিন যিনি বিচারপতি ছিলেন এখন বিজেপিতে গিয়েছেন তিনি সিবিআই দিয়ে দিলেন। এমনকি কী আবেদন কেন করেছে তার জন্যও সিবিআই দিয়েছেন। এরা বিজেপির কথা মতো রায় দিয়েছে। বিচারব্যবস্থার একাংশ এভাবেই কাজ করছে। আসলে ইস্যুটা জিইয়ে রাখতে চায়। লাইমলাইটে থাকতে চায়। এরা চায় না চাকরি হোক।
সিএএ-এনআরসি : এটা আসলে রাজনৈতিক গিমিক। ৫ বছর লাগল রুলফ্রেম করতে। পড়ে দেখবেন ওতে কিছু খালি ফর্ম ফিলাপ করতে বলা ছাড়া। তৃণমূল কংগ্রেস মনে করে সকলেই ভারতের নাগরিক। নতুন করে আবার নাগরিকত্ব কীসের? যারা আছেন তাদের ভোটেই প্রধানমন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রী, বিধায়ক, সাংসদ নির্বাচিত হয়েছে। এই গিমিকের বলি হল কলকাতার একটি তরতাজা প্রাণ। টালিগঞ্জের ৩৩ বছরের যুবক আত্মহত্যা করল।
আরও পড়ুন- বিধিলঙ্ঘন বোসের অভিযোগ কমিশনে
ইলেকশন বন্ড : তৃণমূল কংগ্রেস ইলেকশন বন্ডের বিরোধী। এটা তো বিজেপি এনেছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম থেকে বলে এসেছেন স্টেট স্পনসর ইলেকশন ফান্ডের কথা।
জোট ও কংগ্রেস : কংগ্রেসের আরও বাস্তবচিত ভূমিকা পালন করা উচিত ছিল। আরও আগে থেকে প্রস্তুতি নিতে হতো। ওরা কর্নাটক জেতার পর ইন্ডিয়ার বৈঠকে আমদের সিদ্ধান্ত হল সব কিছু একপাশে সরিয়ে রেখে সকলে মিলে কাজ করব। এরপর দিল্লিতে কংগ্রেসের সঙ্গে বৈঠক হল। বললাম জুলাই-অগাস্টের মধ্যে আসনরফা সেরে ফেলা উচিত। ওরা কথা দিয়েও সেটা করল না। আসলে পাঁচ রাজ্যের নির্বাচনের জন্য অপেক্ষা করছিল। ভেবেছিল এর মধ্যে তিনটে জিতবে তারপর দর কষাকষি বাড়াবে। ধরে নেওয়া যাক, দিল্লি, পাঞ্জাব, বাংলা ও তেলেঙ্গা এই সবক’টা রাজ্য মিলিয়ে যদি ১৫০ আসনও হয় সেটা পরে আলোচনা করা যেত। বাকি ৪৮০ আসন নিয়ে আলোচনা করল না কেন? এরপরে ৩১ ডিসেম্বর ডেড লাইন দিলেন নেত্রী। সেটাও মানল না। এদিকে বাংলায় অধীর চৌধুরী বিজেপি বা প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে কিছু না বলে ক্রমাগত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে আক্রমণ করে যাচ্ছে। দিল্লি মজা দেখছে। দুটো তো একসঙ্গে চলতে পারে না।
এজেন্সির ভূমিকা : এক সপ্তাহ আগে চিৎপুরে একটি সম্প্রদায়ের ১০ জনকে গ্রেফতার করেছে এনআইএ গত বছর রামনবমীর ঘটনার জন্য। এরপর নিজের মোবাইলে একটি ছবি দেখিয়ে অভিষেক বলেন, রিভলভার হাতে যে ছেলেটিকে দেখছেন সুবীর সাউ, তাকে কিন্তু গ্রেফতার করেনি। ওই দিন বিজেপির হয়ে ও রিভলভার নিয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছিল। আমাদের রাজ্যে পরপর ডিজি বদলে দিচ্ছেন। তাহলে এনআইএ-র ডিজি বদল হবে না কেন? মিডিয়া কিন্তু এগুলো দেখায়নি, দোখাবেও না।
এরপর অভিষেক বলেন, বিজেপি রামমন্দির বানিয়ে তাকে সামনে রেখে ভোট বাজারে নেমেছে। যারা ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করে তারা রাজনৈতিকভাবে দেউলিয়া। রাজনীতি হওয়া উচিত রোটি-কাপড়া-মকানের। আসল বিষয় থেকে নজর ঘোরাতেই বিজেপির এসব কায়দা-কানুন। তবে বাংলায় এসবে কাজ হবে না। তৃণমূল কংগ্রেসের সংগঠন ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতিনি মানুষের আস্থা-ভরসা আছে। যারা আমার নাম মুখে আনতে চান না, তাদের প্রতি আমার কিছু বলার নেই। আমার থেকে বয়সে অনেক বড়। গুরুজন। তারা যাই বলুন না কেন সেটা আমার কাছে আশীর্বাদ। এভাবেই নাম না করে কটাক্ষ করলেন প্রক্তন বিচারপতি ও বিজেপি নেতা অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়কে।
বিশ্ব মজুমদারকে দেওয়া নিউজ-১৮ বাংলার সাক্ষাৎকারে ডায়মন্ড হারবারের সাংসদ (Abhishek Banerjee) বেশ কিছু ভাল-মন্দ, পছন্দ-অপছন্দের কথাও বলেছেন। তিনি মনে করেন যেকোনও পেশাতেই একটি নির্দিষ্ট বয়সের পর অবসর নেওয়া উচিত। রাজনীতিতেও। তবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়রা ব্যতিক্রমী। আবার গদ্দার অধিকারীকে ভাষাসন্ত্রাসী ও অমার্জিত বলেছেন, তেমনি বিজেপিতে যোগ দেওয়া প্রাক্তন বিচারপতিকে অবিচারপতি বলতেও ছাড়েননি। আর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে তিনি আপোসহীন সংগ্রামের জননেত্রী বলে ব্যাখ্যা করেন।