রামনবমী (Ramnavami) আমরা বাল্যকাল থেকে দেখে আসছি। একদিনের উৎসব। অবশ্য নবরাত্রি পালিত হত তার আট দিন আগে থেকে। আমরা শিল্পাঞ্চলের বাসিন্দা। অর্থাৎ মিশ্র এলাকা। ভিন্ন ভিন্ন ভাষা-ধর্মের মানুষের বসবাস। দুর্গাপুজো, ইদ, কালীপুজো— সবই হয় সাড়ম্বরে। নবরাত্রির দিনযাপন শেষে রামনবমীও পালিত হয় সে-ভাবেই।
কয়েক বছর আগে পর্যন্ত কোনও সমস্যা ছিল না। সব উৎসবই হত শান্তি এবং সম্প্রীতির সঙ্গে। আমাদের বাড়ির কাছেই করাতিপাড়া। মুসলমান সম্প্রদায়ের আবাস ওই পাড়ায়। তাদের ইদ উৎসবে হিন্দুরা যেমন অংশ নেয়, তেমনি সংখ্যালঘু মানুষজনও দুর্গাপুজো-কালীপুজো দেখতে আসেন। আনন্দ ভাগ করে নেয় সকলেই। কোনও বিভাজন নেই।
কিন্তু ইদানীং রামনবমীর (Ramnavami) মতো কিছু কিছু উৎসবে উগ্র, ধর্মান্ধ, কিছু মানুষের উন্মাদনায় সামাজিক পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। একটা আতঙ্কের বাতাবরণ তৈরি হচ্ছে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি হল বাংলার ঐতিহ্য, সেই পরম্পরার মূলে আঘাত আসছে।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরোধীরা এই পরিস্থিতির কী ব্যাখ্যা দিচ্ছে? তারা বলছে তৃণমূল কংগ্রেস নিজেদের নানা দোষ-ত্রুটি আড়াল করতেই অশান্ত করতে চাইছে রাজ্যকে। তাই নাকি উত্তেজনা সৃষ্টিতে উসকানি দিচ্ছে সরকার। কী অদ্ভুত যুক্তি! যারা ১২ বছরের ওপর বাংলায় মাথা উঁচু করে রাজ করছে, তারা কেন চাইবে আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ঘটাতে? সেটা হলে সব দায় তো সরকারকেই, মায় প্রশাসনকেই সমলাতে হবে— তাই না?
পাল্টা যুক্তিও আছে। আর সেই যুক্তি খণ্ডন করার ক্ষমতা বিরোধীদের, বিশেষ করে বিজেপির নেই। ১০০ দিনের কাজ আর আবাস যোজনার গৃহনির্মাণ প্রকল্প মাঝপথে থেমে গিয়েছে। গ্রামবাংলা ফুঁসছে। বিজেপির সাংসদ-বিধায়কদের ঘেরাও করে গ্রামবাসীরা জানতে চাইছেন, কেন এখন এইসব প্রকল্পের টাকা দিল্লির সরকার আটকে রেখেছে? জুতসই জবাব দিতে পারছেন না পদ্মশিবিরের কর্তারা।
সামনে পঞ্চায়েত নির্বাচন। ত্রিস্তর পঞ্চায়েতে প্রায় ৭০ হাজার আসন। তৃণমূল কংগ্রেস তো আজই ঘোষণা করে দিতে পারে প্রার্থী-তালিকা। আর বিরোধীরা? তারা নানা সমস্যায় ছিন্নভিন্ন। কোনও দলেরই সব আসনে প্রার্থী দেওয়া, বুথে এজেন্ট বসানোর মুরোদ নেই। কেন্দ্র-বিরোধী আমজনতার সর্বাত্মক জেহাদে বিজেপি-সহ বিরোধীরা বেসামাল।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতায় ড. আম্বেদকরের মূর্তির পাদদেশে ধর্নায় বসেছিলেন। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর সুরেই তিনি ডাক দিয়েছেন— ‘দিল্লি চলো’। বাংলার প্রতি যে বেনজির অবিচার এবং বঞ্চনা চলছে তার বিরুদ্ধেই মুখ্যমন্ত্রীর এই জেহাদ। বাংলার মানুষকে তিনি সজাগ এবং সক্রিয় করতে চাইছেন কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে। ধর্না ওঠার একদিনের মধ্যেই বোঝা গেল, নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহের সরকার ভয় পেয়েছে। মিড-ডে মিল এবং সর্বশিক্ষা মিশনের প্রকল্পে বকেয়ায় ১২০০ কোটি টাকা কেন্দ্র মঞ্জুর করেছে। জনতা জনার্দনের জয়। সেটাই তো হবে। পঞ্চায়েত নির্বাচনে রাজ্যবাসী যে কেন্দ্রের প্রতিহিংসার রাজনীতির জবাব দেবে, সেটা টের পাচ্ছে গেরুয়া শিবিরের দিল্লির কর্তারাও।
আরও পড়ুন-শিলিগুড়িতে সৌরভের বাড়ি গেলেন গৌতম
রামনবমীকে ঘিরে অশান্তির আসল উদ্দেশ্য, কেন্দ্রের বিমাতৃসুলভ আচরণের বিরুদ্ধে বাংলার মানুষের ক্ষোভকে অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেওয়া। আগে কখনও দেখিনি, ভগবান রামচন্দ্রের জন্মদিনে মাথায় গেরুয়া ফেট্টি বাঁধা কিছু সশস্ত্র মানুষ রাস্তায় মিছিলের নামে চরম উত্তেজনা ছড়াচ্ছে। হাতে তরোয়াল শুধু নয়, কারও কারও কোমরে পিস্তল ঝোলানো। মাইক-সহ যন্ত্রদানব ডিজেকে মিছিলে শামিল করা হয়েছে। হাওড়া থেকে বিষড়া— একই ছবি। মিছিলকে নিয়ে যেতে হবে সংখ্যালঘু-অধ্যুষিত অঞ্চলে। ধর্মান্ধ মুষ্টিমেয় কিছু লোকের এইরকম আচরণ আমরা কি ৫-৬ বছর আগেও কল্পনা করতে পারতাম?
বলছি না— তাদের সঙ্গে যারা সংঘর্ষে জড়িয়েছে, তারা সকলে নিরাপরাধ। এই ধরনের কাজ যারা করে, তারা কোনও ধর্মের মানুষ নয়। তাদের ধর্ম হল সমাজবিরোধী কাজ করে অঞ্চলকে অশান্ত করা। তাই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কড়া মনোভাব দেখিয়েছেন। বরাবরই এই ধরনের ঘটনায় তিনি কঠোর। প্রশাসনকে মুখ্যমন্ত্রী পরিষ্কার নির্দেশ দিয়েছেন, ‘অপরাধীদের রং যেন দেখা না হয়। তাদের কোনও ভাবেই রেয়াত করা যাবে না।’