স্বপন সেন
কীভাবে শুরু হয়েছিল মিউজিক্যাল জার্নি?
বাড়িতে ছিল গানবাজনার চল। ছোটবেলায় ঘরে একটি গিটার দেখেছিলাম। সেটা ছিল আমার বাবার। তিনি বাজাতেন। তবে অন্য পেশার সঙ্গে যুক্ত থাকার কারণে বাবা গিটারে খুব বেশি সময় দিতে পারেননি। সেই হাওয়াইন গিটারটি দেখে আমার গিটার বাজানোর ইচ্ছা হয়। খেলার ছলেই শুরু। তখন আমার ছয় বছর বয়স। একটু বড় হওয়ার পর শিখতে শুরু করি। প্রথমে কাজী অনিরুদ্ধর কাছে, পরে অনাথবন্ধু মৌলিকের কাছে। ১৬-১৭ বছর বয়সে দেখি, হাওয়াইন গিটারের গুরুত্ব কমতে শুরু করেছে। চাহিদা বাড়ছে স্প্যানিশ গিটারের। সেই ১৭ বছর বয়সে আমি শুরু করি স্প্যানিশ গিটার বাজানো। আজও বাজিয়ে চলেছি।
গানবাজনা কখন থেকে পেশা হল?
১৭ বছর বয়স থেকেই। একটি অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রসংগীতের সুর বাজাতে গিয়েছিলাম মহাজাতি সদনে। শুনেছিলাম, সেই অনুষ্ঠানে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় আসবেন। আমি বাজাতে বাজাতে দেখি, তিনি এলেন। শুনলেন আমার বাজানো দুটি গান। পরে আমাকে ডেকে বললেন, তুমি সামনের সপ্তাহে আমার রেকর্ডিংয়ে বাজাবে। এইভাবে আমার পেশাদার সংগীত জীবন শুরু হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের হাত ধরেই।
সেই রেকর্ডিংয়ে কোন কোন গানের সঙ্গে বাজিয়েছিলেন?
দুটি রবীন্দ্রসংগীত। ‘পুরানো সেই দিনের কথা’ এবং ‘আগুনের পরশমণি’। পেয়েছিলাম ৪০ টাকা। তারপর আমাকে আর থেমে থাকতে হয়নি। শিল্পীমহলে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে নাম। ডাক আসতে থাকে অনেকের কাছ থেকেই। বহু শিল্পীর সঙ্গেই বাজিয়েছি। তবে মান্না দে-র সঙ্গে বেশি। কলকাতার পাশাপাশি একটা সময় ডাক এল মুম্বই থেকেও। তখন ছিল বম্বে। ওখানকার শিল্পীদের সঙ্গেও কাজ করে আনন্দ পেয়েছি। দেশ-বিদেশে বিভিন্ন মঞ্চের পাশাপাশি বহু অনুষ্ঠান করেছি রেডিও-টেলিভিশনে।
কোন কোন বিখ্যাত শিল্পীর সঙ্গে কাজ করেছেন?
ভারতবর্ষের প্রায় সমস্ত বিখ্যাত শিল্পী। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দে ছাড়াও কিশোরকুমার, মহম্মদ রফি, লতা মঙ্গেশকর, আশা ভোঁসলে, ভূপেন হাজারিকা, আরতি মুখোপাধ্যায়, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, সলিল চৌধুরি, রাহুল দেব বর্মন প্রমুখ কিংবদন্তির সঙ্গে কাজ করেছি। তাঁদের সঙ্গে বাজিয়েছি রেকর্ডিং এবং অনুষ্ঠানে। সান্নিধ্য পেয়েছি গুলাম আলি, সত্যজিৎ রায় এবং উত্তমকুমারের। উত্তমকুমার অভিনীত কয়েকটি ছবিতে আমি গিটার বাদকের চরিত্রে অভিনয়ও করেছি।
বেশকিছু গানে সুর করেছেন, তাই না?
হ্যাঁ। রাঘব চট্টোপাধ্যায় এবং সুস্মিতা গোস্বামীর গাওয়া কিছু গানে আমি সুর করেছি। গানগুলো জনপ্রিয় হয়েছে। আগে আমি নিজে বাজানোর পাশাপাশি সংগীত আয়োজন করতাম। সহকারী সংগীত পরিচালক হিসেবে কাজ করেছি। স্বাধীনভাবে সুর করছি গত পাঁচ বছর। সংগীত জীবনে আমার মূল প্রেরণা রাহুল দেব বর্মন। আমি তাঁর সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি।
কীভাবে আলাপ?
একদিন মান্না দে-র সঙ্গে একটি অনুষ্ঠানে বাজাতে গেছি বসুশ্রী হলে। সেই অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে এসেছিলেন রাহুল দেব বর্মন। সেই অনুষ্ঠানে তিনি আমার বাজনা প্রথম শোনেন। পরে আমাকে কাছে ডেকে পরের দিন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে বলেন। সেইমতো আমি যাই কলকাতার একটি পাঁচতারা হোটেলে। সঙ্গে ছিল গিটার। গিয়ে দেখি, সেখানে আছেন আশা ভোঁসলেও। রাহুল দেব বর্মন আমাকে দেখে খুশি। বললেন, বাজাও দেখি। রাহুল দেব বর্মনের সামনে বসে বাজালাম তাঁর বেশ কয়েকটি গান। পরে উনি আমাকে সুযোগ দিয়েছিলেন ওঁর বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠানে। লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে যোগাযোগ সলিল চৌধুরির মাধ্যমে। সলিল চৌধুরি আমাকে ডেকেছিলেন একটি রিহার্সালে। গিয়ে দেখি, ভেতরে বসে আছেন লতা মঙ্গেশকর। নেতাজি ইনডোর স্টেডিয়ামে একটি বাংলা গানের অনুষ্ঠান হয়েছিল। সেই অনুষ্ঠানে আমি বাজিয়েছিলাম লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে। তারপর আরও পাঁচ-ছ’টি অনুষ্ঠানে। সলিল চৌধুরির বহু রেকর্ডিংয়ে আমি বাজিয়েছি। কাজ করেছি নচিকেতা ঘোষ, সুধীন দাশগুপ্ত প্রমুখের সঙ্গেও।
পুরস্কার?
দেশ-বিদেশ থেকে বহু পুরস্কারও পেয়েছি। তারমধ্যে সেরা পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগ আয়োজিত বাংলা সংগীতমেলায় সংগীত সম্মান প্রাপ্তি। ২০১৭ সালে কলকাতার উত্তীর্ণ মঞ্চে আমাকে পুরস্কৃত করেছিলেন মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মঞ্চে ছিলেন মন্ত্রী ইন্দ্রনীল সেনও। মুখ্যমন্ত্রীর কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ। উনি যেভাবে আমাদের মতো যন্ত্রসংগীত শিল্পীদের সম্মান জানাচ্ছেন, তার জন্য কোনও প্রশংসাই যথেষ্ট নয়।
আরও পড়ুন-ভারতপথিক কার্ল এরিখ হামেরগ্রেন
নতুন প্রজন্মের যন্ত্রসংগীত শিল্পীদের কাজ কেমন লাগছে?
খুব ভাল। অনেকেই দারুণ কাজ করছে। নতুন টেকনোলজি এসেছে। সব মিলিয়ে সংগীতের ভবিষ্যৎ যথেষ্ট উজ্জ্বল।
শুদ্ধশীল চট্টোপাধ্যায়
পরিবারের কেউ সংগীতের সঙ্গে যুক্ত?
আমার রক্তে গান। মামার বাড়িতে সংগীত চর্চা ছিল। মায়ের বাবা অর্থাৎ আমার দাদু প্রণবানন্দ মুখোপাধ্যায় একটা সময় গোপেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়, জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদ গোস্বামীর সঙ্গে গান-বাজনা করতেন। গানের চর্চা করতেন আমার মা-মাসিরাও। তাঁদের দেখেই আমার গানের প্রতি আকর্ষণ জন্মায়। তবে পড়াশোনার জন্য খুব কম বয়সে আমার গান শেখা হয়ে ওঠেনি। গান শিখেছি একটু বেশি বয়সে।
শেখা শুরু কীভাবে?
আমি গান-বাজনা ভালবাসি আমার বন্ধুরা জানত। মূলত তাদের উৎসাহেই আমার শেখা শুরু। সেটা কণ্ঠসংগীত। হাতেখড়ি মা মিনতি চট্টোপাধ্যায়ের কাছে। রবীন্দ্রসংগীত। পরে কালিদাস পাল মহাশয়ের কাছে শাস্ত্রীয় সংগীত। তারপরে গান শিখেছি পণ্ডিত রবিশঙ্করের শিষ্য পণ্ডিত সমরেশ চৌধুরীর কাছে। টানা ১৩ বছর। পাশাপাশি চলেছে পড়াশোনা। একটা সময়ে চাকরি নিই। তখন কণ্ঠসংগীতের চর্চা চালিয়ে যেতে অসুবিধা হচ্ছিল বলে বন্ধু সৌমিত্রজিতের পরামর্শে সন্তুর শেখা শুরু করি। ১৯৯৪ সাল থেকে। প্রথমে কম সময়ের জন্য পণ্ডিত তরুণ ভট্টাচার্যর কাছে। তারপর হাওড়ার তাপস ঘোষের কাছে। পাশাপাশি তালিম নিচ্ছিলাম পণ্ডিত তেজেন্দ্রনারায়ণ মজুমদারের কাছেও। পরে পণ্ডিত শিবকুমার শর্মার কাছে শেখার সুযোগ পাই। তখন আমি কলকাতা থেকে মুম্বই চলে যাই। তাঁর কাছে প্রায় পাঁচ-ছয় বছর শিখেছি। বর্তমানে তালিম নিচ্ছি পণ্ডিত ধনঞ্জয় দৈথঙ্করের কাছে।
কোন কোন গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছেন?
জীবনে বহু অনুষ্ঠান করেছি। দেশে ও বিদেশে। গায়ক এবং সন্তুর-বাদক হিসেবে। উল্ল্যেখযোগ্য পশ্চিমবঙ্গ সরকারের শাস্ত্রীয় সংগীত সম্মেলন, শান্তিপুর সংগীত সম্মেলন, বিষ্ণুপুর উৎসব, মুম্বই কালাগোড়া আর্ট ফেস্টিভ্যাল প্রভৃতি অনুষ্ঠান। পদ্মবিভূষণ গাঙ্গুবাই হাঙ্গেলজির জন্মদিনের অনুষ্ঠানেও আমি সন্তুর বাজিয়েছি। অনুষ্ঠানের পাশাপাশি আমি নিজে এখনও শিখছি। শেখাচ্ছি দেশ-বিদেশের নতুনদের।
কোন কোন দেশে পারফর্ম করেছেন?
বিদেশে ইতালি, ফ্রান্স, জার্মানি, হল্যান্ড, বেলজিয়াম প্রভৃতি দেশে পারফর্ম করেছি। শাস্ত্রীয় সংগীত ভাষা নির্ভর নয়। সুর এবং লয় নির্ভর। সেই কারণে বিদেশি শ্রোতাদের শুনতে অসুবিধা হয় না। যদিও আমি বিদেশের তুলনায় দেশের শ্রোতাদের সামনে বাজিয়ে বেশি আনন্দ পেয়েছি।
কেন?
কারণ দেশের শ্রোতাদের কাছে ভাল ফিডব্যাক পাওয়া যায়। যদিও আমাদের এখানে মিশ্র শ্রোতা। বিদেশে শাস্ত্রীয় সংগীত আসরে বিশুদ্ধ শ্রোতাদের উপস্থিতি দেখা যায়। আমি সন্তুরের মধ্যে দিয়ে যেমন বিশুদ্ধ শ্রোতাদের মন জয় করার চেষ্টা করেছি, তেমন চেষ্টা করেছি সাধারণ শ্রোতার মন জিততে। পণ্ডিত শিবকুমার শর্মা, গাঙ্গুবাই হাঙ্গেলজির মতো গুণিজনদের সামনে বাজিয়ে যেমন প্রশংসা পেয়েছি, তেমন একবার বিষ্ণুপুর মেলায় বাজিয়ে কয়েকজন রিকশাচালকের প্রশংসা পেয়েছি। দুটোই আমার কাছে সমান গুরুত্বপূর্ণ। জীবনে অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছি। তবে এইসব প্রাপ্তির তুলনা হয় না।