দুই দলের অনবদ্য দুই নাটক

সম্প্রতি মঞ্চস্থ হয়েছে দুটি নাটক। পৌলমী চট্টোপাধ্যায় পরিচালিত মুখোমুখি-র 'অন্ধযুগ' এবং হেমন্ত মিত্র পরিচালিত শ্রীমঞ্চ-র 'কালো মানুষের কবি'। উচ্চ প্রশংসিত দুটি নাটকের উপর আলোকপাত করলেন অংশুমান চক্রবর্তী

Must read

কালো মানুষের কবি
প্রেমাংশু বসু ছিলেন বঙ্গ থিয়েটার ও চলচ্চিত্রের বিশিষ্ট অভিনেতা। ১৯৪৭-এর ৩ নভেম্বর, তাঁর হাত ধরে সৃষ্টি হয়েছিল শ্রীমঞ্চ-র। সেই সময় থেকে বাংলা থিয়েটারের যাবতীয় ঐতিহ্যকে সম্মান জানিয়ে নিরলস ভাবে কাজ করে চলেছে ঐতিহ্যবাহী এই নাট্য দল। এসেছে বহু বাধা, প্রতিকূলতা। সমস্ত কিছু কাটিয়ে এগিয়ে চলেছে দলটি। মঞ্চস্থ করে চলেছে একের পর এক উল্লেখযোগ্য এবং সফল প্রযোজনা।
সম্প্রতি কলকাতার তপন থিয়েটারে শ্রীমঞ্চ-র ৭৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত হয় বিশেষ অনুষ্ঠান। উপস্থিত ছিলেন নাট্যব্যক্তিত্ব মেঘনাদ ভট্টাচার্য, বিলু দত্ত, রাজন্যা মিত্র, অরূপ রায়, স্বপন সেনগুপ্ত, অনুপ গুপ্ত প্রমুখ।

আরও পড়ুন-লেয়নডস্কিদের বিমানের পাশে থাকল এফ১৬

মঞ্চস্থ হয় দলের সাম্প্রতিকতম প্রযোজনা ‘কালো মানুষের কবি’। বেঞ্জামিন মোলাইজের জীবনের মর্মস্পর্শী কাহিনিই এই নাটকের মূলভিত্তি।
শুধুমাত্র লেখনীর মাধ্যমে তামাম আফ্রিকা তথা অত্যাচারী বোথা সরকারকে নাড়িয়ে দিয়েছিলেন তিনি। নৃশংস, নির্মম অত্যাচারও তাঁকে দমাতে পারেনি। রুদ্ধ করতে পারেনি কণ্ঠস্বর।
আফ্রিকার নৃশংস বোথা সরকার বেঞ্জামিনকে গ্রেফতার করেছিল ১৯৮৩ সালে। ১৯৮৫-র ১৮ অক্টোবর তাঁর ফাঁসি হয়। আসলে এক মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হয়েছিল তাঁকে। অভিযোগ ছিল, তিনি নাকি কর্তব্যরত একজন পুলিশকে হত্যা করেছেন। বেঞ্জামিনের সমর্থনে উত্তাল হয়ে উঠেছিল আফ্রিকার তামাম কৃষ্ণাঙ্গরা। তবু রদ করা যায়নি মৃত্যুদণ্ড। ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়েও দৃপ্ত কণ্ঠে ‘কোসি সিকেলে আফ্রিকা’ গর্জনে উদ্বেলিত করে তুলেছিলেন আফ্রিকার লাঞ্ছিত কৃষ্ণাঙ্গদের।

আরও পড়ুন-মহানগরীতে এবার শীত এল বলে

তাঁর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময় তুলে ধরা হয়েছে নাটকে। ‘কালো মানুষের কবি’ রচনা সুদীপ বিশ্বাসের। পরিচালনা করেছেন হেমন্ত মিত্র।
প্রত্যেক শিল্পীই নিজের নিজের অভিনয় শৈলী দিয়ে নাটকটিকে অত্যন্ত মনগ্রাহী করে তুলেছেন। বেঞ্জামিনের ভূমিকার ঋষি গুপ্ত এককথায় অসাধারণ। বোঝাই যায়, চরিত্রটি নিয়ে তিনি যথেষ্ট ভাবনাচিন্তা করেছেন। করেছেন গভীর অধ্যয়ন। বেঞ্জামিনের দুঃখ, কষ্ট, যন্ত্রণা, ক্ষোভ সমস্তকিছু তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন দক্ষতার সঙ্গে। দর্শকদের তিনি পেরেছেন একাত্ম করতে। টুকরো টুকরো প্রতিক্রিয়া তার প্রমাণ।
প্রশংসা করতে হয় সহ অভিনেতা-অভিনেত্রীদেরও। প্রহরীর ভূমিকায় সুমন চক্রবর্তী এবং অফিসারের ভূমিকায় অপূর্ব শংকর ঘোষ যথেষ্ট মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। দু’জনেই যে জাত অভিনেতা, মুহূর্তে মুহূর্তে বুঝিয়ে দিয়েছেন।
অজিত রায়ের মঞ্চ, শশাঙ্ক মণ্ডলের আবহ, শেখ ইস্রাফিলের মেক আপ, অহনা রায়ের আবহ প্রত্যেকের মনে ছাপ রেখে যায়।
এটাই ছিল প্রথম মঞ্চায়ন। পেয়েছে দর্শকদের প্রশংসা। আশা করি আগামী দিনে এই নাটক আরও অনেক মানুষের কাছে পৌঁছে যাবে।

আরও পড়ুন-মেরামতির জন্য সাঁতরাগাছি সেতুতে যান নিয়ন্ত্রণ শুরু

অন্ধযুগ
দীর্ঘদিন ধরেই বাংলা নাট্য অঙ্গনকে সমৃদ্ধ করে চলেছে মুখোমুখি। বেশকিছু উল্লেখযোগ্য নাটক মঞ্চস্থের মধ্যে দিয়ে। তারমধ্যে অন্যতম সাম্প্রতিক প্রযোজনা ‘অন্ধযুগ’। পাঁচের দশকে এই নাটক রচনা করেছিলেন ধরমবীর ভারতী। বিভিন্ন দলের উদ্যোগে সারা ভারতবর্ষে বহুবার অভিনীত হয়েছে। প্রণতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুবাদে মুখোমুখি নাট্য দল প্রথমবার এই নাটক মঞ্চস্থ করে ২০২০ সালে। তবে লকডাউনের কারণে মাঝে দুই বছর শো বন্ধ ছিল। সম্প্রতি আবার শুরু হয়েছে। ১৩ নভেম্বর কলকাতার গিরিশ মঞ্চে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় স্মরণে পূর্ণ প্রেক্ষাগৃহে নাটকটি মঞ্চস্থ হয়। উচ্ছ্বসিত প্রশংসায় ভরিয়ে দিয়েছেন দর্শকরা।
মহাভারতের একটা বিশেষ অংশ তুলে ধরা হয়েছে। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের ১৮তম দিন থেকে শ্রীকৃষ্ণের প্রয়াণ পর্যন্ত এই নাটকের সময়কাল।
নাটকটি আজ বড় বেশি প্রাসঙ্গিক। দেশের বর্তমান সামাজিক অবস্থার প্রতিচ্ছবি ধরা পড়েছে দৃশ্যে দৃশ্যে। কারণে-অকারণে আত্মহননের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন যন্ত্রণাবিদ্ধ বহু মানুষ। নিজেদের শেষ করে দিতে চাইছেন। পচন ধরেছে বহু মানুষের শরীরে, মনে। এই পচন আসলে তো সমাজের। সেই কথাই বলা হয়েছে নাটকে।

আরও পড়ুন-হাইকোর্টের নির্দেশে নিয়োগ শুরু প্রাথমিকে

তিনটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র অশ্বত্থমা, যুযুৎসু এবং সঞ্জয়। তাঁদের সংলাপের মধ্যে দিয়ে প্রকাশিত হয়েছে তীব্র যন্ত্রণার কথা। কীভাবে এই পচন রুখে দেওয়া সম্ভব? নাটকের শেষদিকে শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, পচন রুখে দেওয়া যাবে মর্যাদাপূর্ণ ব্যবহারে, সৃষ্টিশীল কর্মে, শ্রমে।
অশ্বত্থামার চরিত্রে অসাধারণ অভিনয় করেছেন দেবশঙ্কর হালদার। গান্ধারীর চরিত্রে পৌলমী চট্টোপাধ্যায় অনবদ্য। পাশাপাশি সঞ্জয়ের চরিত্রে মানস মুখোপাধ্যায়, যুযুৎসু চরিত্রে দেবনাথ চট্টোপাধ্যায়, বিদূর চরিত্রে সপ্তর্ষি ভৌমিক, ধৃতরাষ্ট্র চরিত্রে বিশ্বজিৎ সরকার, কৃপাচার্য চরিত্রে ইন্দ্রজিৎ মিদ্দে, কৃতবর্মা চরিত্রে দেবব্রত মাইতি নিজেদের উজাড় করে দিয়েছেন।

আরও পড়ুন-হাইকোর্টের নির্দেশে নিয়োগ শুরু প্রাথমিকে

কৃষ্ণ চরিত্রটি আছে ভয়েস ওভারে। কণ্ঠ দিয়েছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। নাটকের পরিচালক পৌলমী চট্টোপাধ্যায় জানালেন, ‘‘বাবা কোনওদিন আমার কোনও কাজে হস্তক্ষেপ করতেন না। এই নাটকের ক্ষেত্রেও করেননি। ওঁর কাছে যখন কৃষ্ণ চরিত্রের ভয়েস ওভারের কথা বলা হয়, উনি খুব খুশি হন এবং সঙ্গে সঙ্গেই কাজটা করে দেন। শুধু তাই নয়, নাটকটি দেখে উনি অভিভূত হয়েছিলেন এবং লোকজনকে বলেছিলেন দেখার জন্য। আসলে উনি ভাবতে পারেননি নাটকটা এতটা ভাল হবে। এটা আমাদের বিরাট প্রাপ্তি।”

আরও পড়ুন-চলন্ত ট্রেন থেকে জওয়ানকে ধাক্কা টিকিট পরীক্ষকের

মঞ্চসজ্জা, মেক আপ, আলোর পাশাপাশি এই নাটকে কোরিওগ্রাফির একটা বড় ভূমিকা রয়েছে। যুদ্ধ, ধ্বংস ইত্যাদি বিষয়কে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে সম্মেলন নৃত্যের মধ্য দিয়ে। নানারকম ভাবে ব্যবহার করা হয়েছে বেশকিছু লাইফ সাইজের পুতুল। বিশেষত মৃতের স্তূপে। সংলাপ তো অনবদ্য। সবমিলিয়ে দর্শকদের পছন্দ হয়েছে ‘অন্ধযুগ’। আগামিদিনে আরও অনেক শো আছে। প্রায় প্রতি মাসেই। চাইলে আগ্রহীরা এই নাটকের মাধ্যমে মুখোমুখি-র মুখোমুখি হতে পারেন।

Latest article