এর আগেও একাধিকবার সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছিল তাঁর মৃত্যুসংবাদ। সোমবার আর কোনও রটনা নয়। চিরবিদায় নিলেন ‘পথের পাঁচালী’র দুর্গা।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অমর সৃষ্টি পথের পাঁচালীর কিশোরী দুর্গাকে পর্দায় জীবন্ত করে তুলেছিলেন উমা দাশগুপ্ত (Uma dashgupta)। ওই একটির পর আর সেভাবে কোনও সিনেমায় অভিনয় করেননি তিনি। ফলে চিরকাল বাঙালির মননে থাকলেও লাইমলাইট থেকে বরাবর দূরেই ছিলেন এই অভিনেত্রী। সোমবার শেষ হল তাঁর জীবনের পথ চলা, মারণ রোগের কাছে হেরে গিয়ে।
সন্ধানটা প্রথম দেন আশীষ বর্মন। ৩১এ লেক অ্যাভিনিউ-এর বাড়িতে তখন থাকেন সত্যজিৎ। আশীষ উমাকে নিয়ে গেলেন তাঁর কাছে। সত্যজিৎ রায় উমাকে দেখামাত্র ঠিক করে ফেললেন যে, ছবিটা তোলা আদৌ যদি সম্ভব হয় তো দুর্গার ভূমিকায় উমাকেই নামাবেন। সেকথা তিনি লিখেও গেছেন ‘অপুর পাঁচালী’তে।
স্ক্রিন টেস্ট হল, তবে সবার যেরকম সচরাচর হয়, সেভাবে নয়। ছাদে নিয়ে গিয়ে উমার বেশ কয়েকটি ছবি তুলেছিলেন সত্যজিৎ তাঁর লাইকা ক্যামেরায়। তার পর সত্যজিতের নিজস্ব অভিজ্ঞতা, তাঁর নিজের জবানিতে। সত্যজিৎ বলছেন, ‘মেয়েটি একটু লাজুক প্রকৃতির। অথচ দুর্গা তো ওই যাকে বলে দস্যি-মেয়ে। উমাকে তাই ভেংচি কাটতে বলি। তা মুখবিকৃতি করতে মেয়েটির কোনও সংকোচ দেখা গেল না।’
পরবর্তী কালে সন্দীপ রায় বলেছেন, বাবা যে লাল খেরোর খাতা ব্যবহার করতেন, ‘বাঁ দিকে ছোট-ছোট স্কেচ আর ডান দিকে চিত্রনাট্যের সংলাপ, অপরাজিত-র সময় থেকে শুরু সেটা, একেবারেই নিজের জন্যে। পথের পাঁচালীর বিভিন্ন সিকোয়েন্সের স্কেচগুলো কিন্তু অন্যদের, মূলত প্রযোজকদের বোঝানোর জন্য এঁকেছিলেন, কিন্তু তাঁরা গোটা প্রক্রিয়াটা বুঝতেই পারেননি।’ শেষ পর্যন্ত জর্জ সাদুলের অনুরোধে প্যারিসের সিনেমাথেক-এ স্কেচবুকটা দিয়ে গিয়েছিলেন সত্যজিৎ। সেখানেই থেকে গিয়েছিল উমা দাশগুপ্তের ছবি। তখন অবশ্য তিনি দাশগুপ্ত নন, সেন, উমা সেন।
আরও পড়ুন- হঠাৎ মুখ্যমন্ত্রীর কনভয়ের সামনে যুবক, গ্রেফতার
ছোট থেকেই থিয়েটার করতেন উমা দাশগুপ্ত (Uma dashgupta)। যে স্কুলে পড়তেন, সেখানকার প্রধানশিক্ষকের সঙ্গে সত্যজিৎ রায়ের পরিচয় ছিল। আর সেই শিক্ষক আশীষ বর্মনের সুবাদেই মানিকবাবু আবিষ্কার করেছিলেন ‘পথের পাঁচালী’র দুর্গা উমা দাশগুপ্তকে। যদিও তাঁর বাবা চাননি মেয়ে সিনেদুনিয়ায় আসুক। তবে শেষমেশ উমার পরিবারকে রাজি করিয়ে নেন পরিচালক। সিনেপর্দায় দুর্গার মৃত্যু শুধু অপুর মনে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করেছিল তাই নয়, দুর্গার মৃত্যু কাঁদিয়েছিল দর্শককুলকেও। আর এবার ‘অপু’ সুবীর বন্দ্যোপাধ্যায়কে একা করে দিয়ে চলে গেলেন ‘দুর্গা’ উমা দাশগুপ্ত। দিদি-ভাই জুটি ভেঙে গেল।
চলচ্চিত্র সাংবাদিক সংস্থা থেকে ‘পথের পাঁচালী’র সুবর্ণজয়ন্তী বছরে অপু-দুর্গা অর্থাৎ সুবীর বন্দ্যোপাধ্যায় ও উমা দাশগুপ্তকে সংবর্ধনা জানানো হয়েছিল। এসেছিলেন দুজনেই। উমা বলতেন, একটু বিষণ্ণতার সঙ্গেই বলতেন, ‘‘করেছি তো মাত্র একখানা ছবি! তাতেই এখনও লোকেরা মনে রেখেছেন, সেটাই জীবনের সেরা পাওনা। আর কিছু চাই না।”
কয়েকদিন আগে এক সাংবাদিক দেখা করতে গিয়েছিলেন তাঁর সঙ্গে। সাদার্ন অ্যাভিনিউয়ের এক মাল্টিস্টোরিড বাড়ির একেবারে উঁচুতলার ঘরে। ক্লান্ত শরীর মুখ ফিরিয়ে শুয়েছিলেন। চেহারা অনেক ভেঙে গিয়েছে, মনে হয়েছিল সেই সাংবাদিকের। “একবার এদিকে ঘুরতে বল না!” অনুরোধ করেছিলেন সঙ্গের মহিলাকে। শুনে উমা মুখ একটু ঘুরিয়ে শুধু বলেছিলেন, ‘‘শরীর ভাল নেই। কিছু বলতে ইচ্ছে করছে না! প্লিজ মাফ করে দাও!”
নির্মল ধর, বিশিষ্ট সাংবাদিক, লিখেছিলেন, “এটাতো অস্বীকার করা যায় না, ‘বাইসাইকেল থিফ’-এর কিশোর ব্রুনো চরিত্রে এনজোর মতো ‘পথের পাঁচালী’র দুই শিল্পী সুবীর আর উমা অমর হয়ে আছেন বিশ্বসিনেমার ইতিহাসে মাত্র একটি ছবিতে অভিনয় করেই।” কথাটা আজ ভীষণভাবে মনে পড়ছে। ‘‘পথের পাঁচালীর সংসার ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। আকাশের পথে হারিয়ে গিয়েছেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, সত্যজিৎ রায়, কানু বন্দ্যোপাধ্যায় (হরিহর), করুণা বন্দ্যোপাধ্যায় (সর্বজয়া)।” লিখেছিলেন নির্মল। আজ তাঁকে লিখতেই হবে, “এবার ‘অপু’ সুবীর বন্দ্যোপাধ্যায়কে একা করে দিয়ে চলে গেলে ‘দুর্গা’ উমা দাশগুপ্ত (Uma dashgupta)।”
স্বাধীন ভারতে নির্মিত পথের পাঁচালী ছিল প্রথম চলচ্চিত্র যা আন্তর্জাতিক মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল। ১৯৫৫ সালে চলচ্চিত্র বিভাগে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হিসেবে জাতীয় পুরস্কার, ১৯৫৬ কান চলচ্চিত্র উৎসবে শ্রেষ্ঠ মানবিক দলিল পুরস্কার-সহ বহু পুরস্কার লাভ করেছে ‘পথের পাঁচালী’। ২১ অক্টোবর, ২০২২-এ কিংবদন্তি চলচ্চিত্র নির্মাতা সত্যজিৎ রায়ের নির্মিত বিশ্ববিখ্যাত এই ছবি “ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অফ ফিল্ম ক্রিটিকস”-এর পক্ষ থেকে সর্বকালের সেরা ভারতীয় চলচ্চিত্র হিসাবে স্বীকৃতি পায়।
শরতের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর কাশফুল। সেটাকেই বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পথের পাঁচালী’তে সাদাকালো ক্যামেরায় চির রঙিন করে গেছে আর এক কিংবদন্তি সত্যজিৎ রায়। আর এটি দর্শকের সামনে জীবন্ত করে তুলে ধরেন, ‘দুর্গা’, ও ‘অপু’। ‘দুর্গা’র আবাহন হলেও ‘বিসর্জন’ অবশ্যম্ভাবী। আর সেই খবরে শোকে মূহ্যমান বাংলার চলচ্চিত্রপ্রেমী সমাজ।