কণাদ দাশগুপ্ত : জাতীয় রাজনীতি আজ সন্ধিক্ষণে৷ দেশজুড়ে বিজেপি তথা মোদি-শাহ বিরোধী হাওয়ার গতিবেগ ক্রমশই বৃদ্ধি পাচ্ছে৷ বঙ্গ-ভোটে বিজেপিকে একক লড়াইয়ে পর্যদুস্ত করে সর্ভারতীয়স্তরে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মমতাকে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে প্রোজেক্ট করার আওয়াজও জোরদার হচ্ছে রাজনৈতিক মহলে৷ সর্বভারতীয় স্তরে কংগ্রেসের ‘Viable Option’ হিসাবে তৃণমূলের উঠে আসার জমি প্রায় তৈরি হয়ে আছে৷ এই পরিস্থিতিতে জাতীয়স্তরে তৃণমূলের প্রাসঙ্গিকতা বৃদ্ধি করার গুরুদায়িত্বে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়৷
সাধারণত এমন হয় না৷ নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসা দল ভবিষ্যতের জন্য ঘর গোচ্ছাছে৷ আর বিস্তর হাঁকডাক করেও লজ্জাজনকভাবে পরাজিত হওয়া দলটি এখনও ক্ষমতায় বসে পড়ার হ্যাং-ওভার কাটাতে না পেরে নিজেদের মধ্যেই গুঁতোগুতি করছে, দলের কথা ভাবা এখন এই নেতাদের কাছে নেহাতই গৌণ কর্ম৷
রাজনীতিতে এর উল্টোটাই দেখা যায়৷ ভোটে জেতার আনন্দে সংগঠনের কথা সাময়িকভাবে বিস্মৃতই হয় জয়ী দল৷ কারণ, ওই দল ধরেই নেয়, সংগঠনের প্রতিটি ধাপ ঠিকঠাকই আছে, নাহলে এই জয় এলো কীভাবে ? পক্ষান্তরে পরাজিত দলটি নেমে পড়ে সংগঠনকে মজবুত করার কাজে৷ এমনই দেখা গিয়েছে অতীতেও৷
আরও পড়ুন-মূল চুক্তিপত্রের কোথায় আপত্তি? সই না করা নিয়ে শ্রী সিমেন্টকে তোপ ইস্টবেঙ্গল কর্তাদের
বাংলায় এবার চালু এই ধারাকে উল্টে দিয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস৷ রাজ্য রাজনীতিতে পরীক্ষিতভাবে এক নম্বর দলটি নির্বাচনের ফলপ্রকাশের এক মাসের মাথায় সংগঠনকে আরও শক্তিশালী, আরও বিস্তৃত, আরও ‘টার্গেট- ওরিয়েন্টেড’ করে ফেললো বিরোধী শিবিরকে কার্যত বাউণ্ডারির বাইরে পাঠিয়ে৷ নেহাতই কথাসর্বস্ব বঙ্গ-বিজেপি এই বিষয়টিও হালকাভাবে নিয়েছে৷ মন্তব্যও করেছে ব্যাঙ্গাত্মক৷ কিন্তু অন্ধ হলে তো প্রলয় বন্ধ থাকে না। তৃণমূলের এই রেজিমেন্টেশনের উদ্যোগের মাশুল এই বিজেপিকেই দিতে হবে আরও বড়ভাবে, ২০২৪-এর লোকসভা ভোটে৷ অথচ তা এখনও বুঝতেই পারছে না অর্ধমেধাসম্পন্ন গেরুয়া শিবির৷
সর্বভারতীয় তৃণমূল কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়৷ বিষয়টি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ৷ দেশজুড়ে বিজেপি তথা মোদি-শাহ বিরোধী হাওয়ার গতিবেগ ক্রমশই বৃদ্ধি পাচ্ছে৷ জাতীয় রাজনীতিও এক সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছে৷ বঙ্গ-ভোটে একক লড়াইয়ে মোদি-শাহকে পর্যুদস্ত করে সর্ভারতীয়স্তরে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মমতাকে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে প্রোজেক্ট করার আওয়াজ জোরদার হচ্ছে রাজনৈতিক মহলে৷ তৃণমূলের পাখির চোখ ২০২৪- এর লোকসভা নির্বাচন৷ ঠিক সেই সময়ে অভিষেককে দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক পদে বসিয়ে জাতীয়স্তরে তৃণমূলের প্রাসঙ্গিকতাকে আরও গুরুত্বপূর্ণ করে দিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷
কেন গুরুত্বপূর্ণ ? রাজনৈতিক অঙ্ক বলছে, জাতীয়স্তরে বিজেপিকে কোনঠাসা করার লড়াইয়ে এখন থেকে মনোনিবেশ করবে তৃণমূল৷ দেশজুড়েই নানা কারণে বিজেপি বিরোধী হাওয়া প্রবল৷ এই হাওয়ার গতিমুখকে এক জায়গায় এনে লোকসভা ভোটে গেরুয়া শিবিরকে ধাক্কা দেওয়ার পরিবেশ-পরিস্থিতি তৈরি হয়ে গিয়েছে৷ তাই জাতীয় রাজনীতিতে নিজেদের পরিধি আরও বাড়ানোরও এটাই সঠিক সময়৷ অতীতে এমন চেষ্টা দু-একবার হলেও, তা ক্লিক করেনি৷ না করার কারণ নানাবিধ৷ ২০১১-র পর দলের একাধিক নেতাকে একাধিক রাজ্যে সংগঠন গড়ে তোলার নির্দিষ্ট দায়িত্ব দিয়েছিলেন সুপ্রিমো৷ দায়িত্বপ্রাপ্তরা বিষয়টি নিয়ে তেমন সিরিয়াস হননি৷ এই মুহুর্তে জাতীয়স্তরে তৃণমূলের উপস্থিতি একান্তই জরুরি৷ সে কারণেই ঠিক সময়ে ঠিক পদক্ষেপ করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷ সর্বভারতীয় স্তরে তৃণমূলকে ছড়িয়ে দেওয়ার গুরুদায়িত্ব অভিষেকের হাতেই তুলে দিয়েছে দলের কর্মসমিতি।
আরও পড়ুন-গান্ধী পরিবার নয়, জাতীয় রাজনীতির বিরোধী মুখ একমাত্র মমতা
গত কয়েক বছর ধরেই অভিষেক নিজের রাজনৈতিক প্রজ্ঞার প্রমাণ দিয়েছেন৷ তাঁর উপস্থিতি বা হস্তক্ষেপে অনেক রাজনৈতিক জটিলতা দূর হয়েছে৷ তাঁর রাজনৈতিক বোধ যে অত্যন্ত প্রখর, তাও প্রমাণিত৷ নতুন এই পদে অভিষিক্ত হওয়ার পরই অভিষেক এক বিনম্র ট্যুইটবার্তায় বলেছেন, “দেশের প্রতিটি প্রান্তে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বার্তা ছড়িয়ে দিতে চেষ্টার ত্রুটি রাখব না। আমি দলের প্রতিটি কর্মী-সমর্থকের প্রতি কৃতজ্ঞ, যাঁরা শত প্ররোচনা আর প্রতিবন্ধকতাকে উপেক্ষা করে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই চালিয়েছেন। মাথা নত করি দলের সমস্ত প্রবীণ নেতাদের সামনেও, যাঁরা সমস্ত বিপত্তিকে উপেক্ষা করে দল এবং দলীয় নীতির প্রতি ভরসা রেখেছেন।” সত্যি কথা বলতে কি, এ ধরনের বার্তা ওই দলের কোনও নেতার কাছ থেকেই এতদিন পাওয়া যায়নি৷ এতে স্পষ্ট হয়, অভিষেক লম্বা দৌড়ের ঘোড়া৷
সর্বভারতীয় স্তরে অভিষেকের এই উত্থানের পিছনে মোদি এবং অমিত শাহের ভূমিকাও বড় কম নয়৷ একুশের নির্বাচনী প্রচারে কলকাতা-দিল্লি ডেইলি-প্যাসেঞ্জারি করা পদ্ম-বাহিনী প্রতি মুহুর্তে অভিষেককে টার্গেট করেছিলেন৷ বিজেপির শীর্ষনেতাদের প্রতিটি বক্তৃতার সিংহভাগ জুড়ে ছিলেন অভিষেক৷ তাঁর নামে অজস্র অপ্রমাণিত অভিযোগ এনে বাজি মারতে চেয়েছিলো বিজেপি৷ প্রতিটি অভিযোগ ব্যুমেরাং হয়ে ফিরেছে গেরুয়া শিবিরে৷ আর মোদি-শাহের এই অপরিনামদর্শী, আইনবিরুদ্ধ কাজে গোটা দেশে বিজেপি-বিরোধী অন্যতম ‘প্রধান মুখ’- হিসাবে স্বীকৃতি আদায় করে নিয়েছেন অভিষেক৷ গোটা দেশ জেনেছে, শুধু মমতাই নন, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ও বিজেপি’র মাথা ব্যথার কারণ৷
অভিষেককে এই গুরুদায়িত্বে আনার প্রধান কারণ, বাংলার বাইরে দলের সংগঠন বিস্তারে তৃণমূল আগ্রহ এবং জাতীয়স্তরে তৃণমূলের ওজন বাড়ানো৷ উত্তর-পূর্ব ভারত তো বটেই, দক্ষিণের কেরলেও তৃণমূলের সংগঠন যাত্রা শুরু করার পথে৷ অভিষেকের হাত ধরেই কেরলে পা রাখবে তৃণমূল৷ হিন্দি বলয় নিয়েও ভাবনাচিন্তা চলছে দলে৷ এই সব কিছুর সিদ্ধান্তই নিতে হবে অভিষেককে৷ তাঁর যোগ্যতার পরিচয় এবার মিলবে দেশজুড়েই৷
অভিষেককে দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক পদে আনার বিষয়টিকে বিজেপি-সহ অনেক দলই হালকাভাবে নিয়েছে৷ মন্তব্য করেছে তেমনই৷ এই সিদ্ধান্ত অনেক অঙ্ক কষে যে নেওয়া হয়েছে, তা এখনও বুঝে উঠতে পারছে না অনেকেই৷ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে এবার জাতীয়স্তরে বিজেপি-বিরোধী প্রধান মুখ করার লক্ষ্যে ভোটকুশলী প্রশান্ত কিশোরের বৃহত্তর কৌশলের গুরুত্বপূর্ণ অংশ অভিষেকের এই উত্তরণ৷ জাতীয়স্তরে কংগ্রেস দুর্বল থেকে দুর্বলতর হচ্ছে৷ কংগ্রেসের অন্দরের শীর্ষস্তরে সোনিয়া ও রাহুল গান্ধীকে অপছন্দ করার লোক বাড়ছে৷ UPA-র চেয়ারপার্সন হিসাবে সোনিয়া গান্ধী দীর্ঘদিন ধরেই কার্যকর ভূমিকা নিতে পারছেন না অসুস্থতার কারণে৷ কংগ্রেসের একাধিক শীর্ষনেতা চাইছেন UPA-র চেয়ারপার্সন পদ থেকে মর্যাদার সঙ্গে সরে আসুন সোনিয়া৷
এতদিন যে সব বিকল্প নাম নিয়ে আলোচনা চলছিলো, বাংলার নির্বাচনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিজেপি-বিরোধী রুদ্রমূর্তি দেখে সেই সব নাম তলিয়ে যাচ্ছে৷ কংগ্রেস এবং অনেক শরিকই আজ UPA-র চেয়ারপার্সন পদে যোগ্যতম মনে করছেন ‘Fire Brand’ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে৷ গান্ধী পরিবারের ‘বিরোধী’ এআইসিসি’র ২৩ জন শীর্ষনেতা জাতীয়স্তরে বিজেপি-বিরোধী ‘বিকল্প-মঞ্চ’ গঠনে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন অনেক আগেই৷ আর এই কাজে সোনিয়া গান্ধীর বিকল্প হিসাবে সর্বস্তরে গ্রহণযোগ্য নাম এখন মমতা৷ শুনতে খারাপ লাগলেও এটাই বাস্তব, কংগ্রেস মনোভাবাপন্ন মানুষের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ গান্ধী পরিবারের নেতৃত্ব ইদানিং অপছন্দ করছেন৷ এর কারণ সোনিয়ার ‘অসুস্থতা’, রাহুল গান্ধীর ‘ট্যুইটকেন্দ্রিক’ রাজনীতি এবং প্রিয়াংকা গান্ধীর ‘শখের রাজনীতি’৷ কেউ কেউ অসন্তুষ্ট হলেও কংগ্রেস মনোভাবাপন্ন মানুষ কিন্তু চট করে অন্য দলে পা রাখবেন না৷ সেক্ষেত্রে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বই ২০২৪-এর নির্বাচনে ‘দীর্ঘমেয়াদি- বিকল্প’ হতেই পারে৷ বিচ্ছিন্নভাবে তৈরি হওয়া এইসব আলোচনাই এবার একসূত্রে গাঁথতে চাইছেন প্রশান্ত কিশোর৷ জাতীয়স্তরে এই ফাঁকটাই কাজে লাগাতে চাইছেন তিনি৷ আর এই কাজে দিল্লিতে তৃণমূলের দরকার একজন উদ্যমী, গ্ল্যামারার্স, রাজনৈতিক বোধসম্পন্ন, নানা ভাষায় পারদর্শী এবং বিজেপির সরাসরি ‘হিটলিস্ট’- এ থাকা মুখ প্রয়োজন৷ এই গুণসম্পন্ন চরিত্র অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ছাড়া তৃণমূলে আর কেউই নেই৷ তার উপরে অভিষেক একজন নির্বাচিত সাংসদও৷ সর্বভারতীয় স্তরে কংগ্রেসের ‘Viable Option’ হিসাবে তৃণমূলের উঠে আসার জমি প্রায় তৈরি হয়ে আছে৷
আরও পড়ুন-চলতি মাসের শেষ সপ্তাহেই রাজধানী সফরে মমতা, রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রী সঙ্গে সাক্ষাতের সম্ভাবনা
একাধিক রাজ্যে বিজেপি-বিরোধী আঞ্চলিক শক্তিও কংগ্রেসকে ‘রাজার পার্ট’ দিতে রাজি নয়৷ এদের একটি অংশও মমতাকে, মমতার নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতাকে, মমতার রাজনীতির স্টাইলকে পছন্দ করে৷ এখনও পর্যন্ত ‘অগঠিত’ থাকা, আকার না পাওয়া বিভিন্ন দলের বা শীর্ষস্তরের নেতানেত্রীর এইসব ‘ইচ্ছা’-কে সাকার করা, এক ছাতার তলায় নিয়ে আসার কাজ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে তো আর করতে পারবেন না, করা সম্ভব নয়, দৃষ্টিকটুও বটে৷ অথচ এই কাজ এখনই শুরু করা দরকার৷ মমতা এবং প্রশান্ত কিশোরের সঠিক সিদ্ধান্ত, সহজেই এ কাজে ব্যবহার যাবে বিজেপির ‘চক্ষুশূল’ অভিষেককেই৷ অভিষেককে একদিকে যেমন বিভিন্ন রাজ্যে সংগঠন তৈরি করতে হবে, একইভাবে দিল্লির বিজেপি-বিরোধী হাওয়াকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পালে এনে লাগাতে হবে৷ যথেষ্টই গুরুদায়িত্ব সন্দেহ নেই৷ আর এ কারণেই তাঁকে এই গুরুত্বপূর্ণ পদে আনা হয়েছে৷ তৃণমূলের এই সিদ্ধান্ত, অচিরেই যে বিজেপির পক্ষে অশনি সংকেত হয়ে উঠবে, তা বলাই বাহুল্য৷
সম্ভবত, এই বিষয়টি ধরতে না পেরেই মন্তব্য করছেন বিজেপি নেতারা৷ বিজেপি বা তৃণমূল-বিরোধী অন্যান্য শিবির এই ব্যাখা আজ অস্বীকার করতেই পারেন৷ কিন্তু অন্ধ হলে তো আর প্রলয় বন্ধ থাকে না।