শাঁওলি মিত্রের অভিনয় প্রথম দেখেছিলাম ১৯৭১-এ। ‘পাগলা ঘোড়া’ নাটকে। রচক বাদল সরকার। অবিস্মরণীয় অভিনয়। শাঁওলি তখন ২৩, বড়জোর ২৪।
এরপর রবীন্দ্রনাথের ‘রাজা’ নাটকে সুরঙ্গমার ভূমিকায়। নির্দেশনায় তাঁর বাবা শম্ভু মিত্র। সুদর্শনার ভূমিকায় তাঁর মা তৃপ্তি মিত্র। যুগান্তকারী সেই প্রযোজনা। আনন্দবাজার পত্রিকায় তা নিয়ে একটি দীর্ঘ আলোচনা লেখেন সাহিত্যিক-সাংবাদিক সন্তোষকুমার ঘোষ। শিরোনাম ‘একই নদীতে দুবার স্নান’। আমার তখন ১৮ বছর।
আরও পড়ুন-করোনার কোপে
১৯৮১-তে জার্মানি থেকে এলেন সিক্সথ বেনেভিট এলেন। রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত, বিভাস চক্রবর্তী, নীলকণ্ঠ সেনগুপ্তদের বিশেষ চেষ্টায় তখন মঞ্চস্থ হচ্ছে ‘গ্যালিলিওর জীবন’। রাতে রাস্তায় কাটিয়ে পড়ে থাকতে হত পরের দিন শোয়ের টিকিট পাওয়ার জন্য। সেভাবেই দেখলাম সেই নাটক। সেখানে শাঁওলি গ্যালিলিও-র কন্যা ভার্জিনিয়ার ভূমিকায়। সংলাপ প্রায় নেই বললেই চলে। কিন্তু মঞ্চে উপস্থিতি অনেকটা। এই ভার্জিনিয়ার বিয়ে ভেঙে গিয়েছে গ্যালিলিওর জন্য। গ্যালিলিওর অন্তিম জীবনে তাঁর পাশে কিন্তু ওই ভার্জিনিয়া ছাড়া আর বিশেষ কেউ নেই। অথচ গ্যালিলিও তখনও কন্যার প্রতি রূঢ়ভাষী। একটি দৃশ্যে উইংসের এক পাশ দিয়ে মঞ্চে প্রবেশ করেন ভার্জিনিয়াবেশী শাঁওলি। গ্যালিলিও তাঁর প্রতি কটূ কথা বলেন। ভার্জিনিয়া একটি কথাও না-বলে তাঁর সামনে পানীয় রেখে দিয়ে উইংসের অন্য পাশ দিয়ে প্রস্থান করেন। সংলাপের স্পষ্টতায় নিজেকে প্রকাশের সুযোগ নেই। অথচ মুখের অভিব্যক্তিতে শাঁওলি ফুটিয়ে তোলেন ভার্জিনিয়ার তাঁর পিতার প্রতি মনোভাব।
আরও পড়ুন-আগামী ২৮শে ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হচ্ছে আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলা
পরবর্তীকালে, যখন বাংলা আকাদেমিতে কাজের সুবাদে ঘনিষ্ঠতা বেড়েছে, তখন জানতে চেয়েছিলাম, ওরকম সংলাপহীন অভিনয়ে অত স্পষ্ট আবেগ ফুটিয়ে তুলতে কে সাহায্য করেছিলেন? শাঁওলি জানান, তাঁর বাবা শম্ভু মিত্রই তাঁকে শিক্ষা দিয়েছিলেন, সংলাপ বিহীন চরিত্রের অন্তঃসার আস্বাদনের তত্ত্ব। নির্বাক আবেগকে ফুটিয়ে তুলতে হলে চরিত্রটাকে নিয়ে ভাবতে হয়, চরিত্র-গভীরে ডুব দিতে হয়। সেই পরামর্শই কাজে লাগিয়ে ছিলেন শাঁওলি।
পরবর্তীকালে ‘নাথবতী অনাথবৎ’ এবং ‘কথা অমৃতসমান’-এর মতো প্রযোজনায় দেখেছি কীভাবে মঞ্চোপরি শাঁওলি হাতের মুদ্রা আর কণ্ঠ স্বরের তারতম্যে উপস্থাপন করছেন মহাভারতের একাধিক চরিত্র একাই, একক অভিনয়ে।
অন্য শাঁওলি মিত্রকে চিনলাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে সিঙ্গুর নন্দীগ্রাম আন্দোলন পর্বে। মিছিলে হাঁটলেন একেবারে প্রথম সারিতে। ‘পশুখামার’ নাটক মঞ্চস্থ হওয়ার দিনগুলোতে প্রেক্ষাগৃহের বাইরে ঝোলান থাকত পোস্টার, আন্দোলনের সমর্থনে। শঙ্ঘ ঘোষ, অপর্ণা সেনদের সঙ্গে ছুটে গেলেন লালবাজারে আন্দোলনের সমর্থকদের জেল থেকে ছাড়ানোর জন্য। সে সময় সংবাদপত্রে বাম অপশাসনের বিরুদ্ধে কলমও ধরলেন শাঁওলি। প্রায় নিয়মিত। দৈনিক স্টেটসম্যানের পাতায়।
আরও পড়ুন-বীরভূমে অব্যাহত গেরুয়াশিবিরের ভাঙন, তৃণমূলে যোগ ৪৮ মণ্ডল সভাপতির
আর প্রশাসক হিসেবে তাঁর দক্ষতার পরিচয় পেলাম বাংলা আকাদেমিতে কাজের সূত্রে। মমতাই তাঁকে সেখানে এনেছিলেন। এই পর্বে তিনি আর নাটক করেন না। কিন্তু সাহিত্যের সঙ্গে তাঁর নিত্য যোগাযোগ। আমাদের কাছ থেকে পাওয়া বই মন দিয়ে পড়েন। ওঁর দেওয়া বই পড়ে ওঁকে মতামত জানালে মন দিয়ে শোনেন।
একটা সময় মঞ্চে অভিনয় বন্ধ করেছিলেন। নাটক লেখাও থামিয়ে দেন। মনোনিবেশ করেন নাট্য সম্বন্ধীয় রচনা প্রণয়নে। সেই সঙ্গে গল্প লিখনে। সমান্তরালে চলে পাঠ-অভিনয়। সেখানেও তিনি জন সমাদৃত।
পুরো জীবনটাই তাঁর শিল্পসাধিকার জীবন। শিল্পের প্রয়োজনেই তিনি প্রশাসনের দায়ভার সামলেছেন। শিল্পের দাবি মেনেই রাজনীতিতে অংশ নিয়ে রাস্তায় নেমেছেন। তাঁর চলে যাওয়া তাই একজন সত্যিকার শিল্পসাধিকার জীবনাবসান।
ঠিক শম্ভু মিত্রের মতোই লোকচক্ষুর অন্তরালে তাঁর ইহলৌকিক শরীর পঞ্চভূতে বিলীন হল। রয়ে গেল তাঁর কাজগুলো। এতেও যেন শৈল্পিক পরম্পরার ছোঁয়াটুকু লেগে রইল। (সাক্ষাৎকারভিত্তিক অনুলিখন)