বড় মনের মানুষ
দাঙ্গার সময়। হিন্দু-মুসলিম তখন আর ভাই ভাই নয়, পরস্পরের শত্রু। লাশ পড়ছে এদিক-ওদিক। সেই সময়, ১৯৪৬-এর এক বৃষ্টিধোয়া দিনে রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী কলিম শরাফী নামলেন হাওড়া স্টেশনে। শুনশান এলাকা। চোখ ফেরাতেই দেখলেন, অদূরে পড়ে রয়েছে একটি রক্তাক্ত মৃতদেহ। বুক কেঁপে উঠল তাঁর। আতঙ্কিত হলেন। কী করবেন, ভেবে পান না। বুঝলেন, যে কোনও সময় প্রাণ যাবে। তখন তাঁর চোখের সামনে ভেসে উঠল একজনের মুখ। সতর্কতার সঙ্গে, লুকিয়ে পৌঁছলেন তাঁর বাড়ি। কলিম শরাফীকে দেখে সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে ভেতরে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করলেন গৃহকর্তা। চালান করলেন খাটের তলায়। কেউ ঘুণাক্ষরেও জানতে পারলেন না মুসলিম কলিম শরাফী রয়েছেন তাঁর বাড়িতে। জানাজানি হলে হিন্দু-অধ্যুষিত সেই অঞ্চলে কলিম লাশ হয়ে যেতেন। কে এই গৃহকর্তা, যিনি চরম ঝুঁকি নিয়ে নিজের ঘরে কলিম শরাফীকে আশ্রয় দিয়েছিলেন? তিনি দেবব্রত বিশ্বাস বা জর্জ বিশ্বাস। রবীন্দ্র-গানের কিংবদন্তি শিল্পী। বড় শিল্পী তো বটেই, সেইসঙ্গে ছিলেন বড় মনের মানুষ। দিলখোলা। তাঁর রাসবিহারী এভিন্যু-এর ভাড়া বাড়িতে ছিল সবার অবারিত দ্বার। প্রতিদিন বসত নির্ভেজাল সান্ধ্য-আড্ডা। থাকতেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়-সহ অনেকেই। গান, গল্প, রসিকতায় কেটে যেত সময়।
আরও পড়ুন-কী লভিনু এই চন্দ্রযানে?
অবাক পৃথিবী
রবীন্দ্র সঙ্গীতের পাশাপাশি অন্যান্য গানেও কণ্ঠ দিয়েছেন দেবব্রত। গেয়েছেন সলিল চৌধুরীর বেশকিছু গান। সলিল সুর করেন কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘অবাক পৃথিবী’ কবিতায়। সেই গান দেবব্রত মাঝেমধ্যেই বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গাইতেন। ১৯৫০ সালে সেই গান রেকর্ড করেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। গানটি তুমুল জনপ্রিয়তা পায়। জানা যায়, দেবব্রতর পরামর্শেই নাকি গানটি হেমন্তকে দিয়ে রেকর্ড করানো হয়েছিল। হেমন্তর প্রতি ছিল দেবব্রতর অগাধ স্নেহ। তাঁদের প্রথম আলাপ বঙ্গসংস্কৃতির রেনেসাঁয়। ১৯৩৮ সালে।
রক্তকরবী-র বিশু
১৯৪৭ সালে ‘গীতবিতান’ থেকে ‘রক্তকরবী’ নাটক মঞ্চস্থ হয়। দুদিন ধরে। ‘কালিকা’ সিনেমা হলে। সেখানে বিশুপাগলের চরিত্রে অভিনয় ও গান করেছিলেন দেবব্রত। এর ঠিক পরের বছর অর্থাৎ ১৯৪৮-এ হেমেন গুপ্তর পরিচালনায় ‘ভুলি নাই’ ছায়াছবিতে দেখা যায় দেবব্রতর অভিনয়। গেয়েছিলেন দুটি গান, ‘সাবধান সাবধান’ এবং ‘অজ্ঞানতম বিদূরকারিণী’। সঙ্গীত পরিচালনায় ছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। হেমন্তর সুরে দেবব্রতর প্রথম কণ্ঠদান এবং চলচ্চিত্রে অভিনয়— এই দুইয়ে মিলে ‘ভুলি নাই’ ছবিটির ঐতিহাসিক মূল্য অনেকটাই বেড়ে গিয়েছিল। এরপরেও হেমন্তর সুরে দেবব্রত বেশ কয়েকটি ছবিতে গান করেছেন। গেয়েছেন নজরুলের গানও।
আরও পড়ুন-হাওড়ার বাজারে টাস্ক ফোর্সের হানা
কেরানি জীবন
গায়ক হবার কথা স্বপ্নেও ভাবেননি। ১৯১১ সালের ২২ অগাস্ট বরিশালে দাদুর বাড়িতে জন্মানো দেবব্রত বিশ্বাস, ১৯৩৩ সালে অর্থনীতিশাস্ত্রে এমএ করেন। ১৯৩৪ সালে তিনি বিনা মাইনেতে হিন্দুস্থান ইনসিওরেন্স কোম্পানিতে শুরু করেন কাজ। তার ঠিক এক বছর পর তাঁর নাম সরকারি খাতায় ওঠে। মাত্র ৫০ টাকায় কেরানি জীবন শুরু করেন। তখনও পর্যন্ত গানের সঙ্গে রচিত হয়নি তাঁর সম্পর্ক। থাকতেন ভবানীপুর থানার উল্টোদিকের একটি মেস বাড়িতে। সেইসময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাইয়ের ছেলে সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। তিনিও আগে ওই জীবনবিমা কোম্পানির কর্তাব্যক্তি ছিলেন। মাঝে মধ্যে আসতেন এই অফিসে। দেবব্রতকে পছন্দ হয় তাঁর।
রবীন্দ্রনাথের দর্শন
সুরেন্দ্রনাথই নিয়ে যান ইন্দিরা দেবীচৌধুরানীর কাছে। ইন্দিরা দেবীচৌধুরানী দেবব্রতর গলা শুনে অবাক হয়ে যান। তাঁকে গান শেখাতে শুরু করেন। ‘আমি চিনি গো চিনি তোমারে’ গানটি তিনি পাশ্চাত্য কায়দায় হারমোনাইজ করে শেখান। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গাইতে পাঠান। এইভাবেই দেবব্রত জড়িয়ে পড়েন গানের জগতের সঙ্গে। যেতে শুরু করেন আরও কয়েকটি জায়গায়। পয়সা জমিয়ে কেনেন চার খণ্ডের জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘স্বরলিপি-গীতমালা’। এই বই দেখে দেখেই তিনি গান তোলার চেষ্টা করতে থাকেন। সবটাই করতেন খালি গলায়। সুর তাঁর গলায় নিজে থেকেই ছিল। একদিন তিনি শান্তিনিকতনে যান। দর্শন পান রবীন্দ্রনাথের। আর থেমে থাকেননি। ভেসে গেছেন গানের ভেলায়। রবীন্দ্রনাথকে বুকে আঁকড়ে।
সুরের নেশায় মাতাল
প্রবল তাসের নেশা ছিল দেবব্রতর। রীতিমতো টাকা-পয়সা দিয়ে খেলতেন। যেদিন জিততেন, বাড়িতে বসাতেন ভোজের আসর। অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিলেন ঋত্বিক ঘটক। দুজন পরস্পরকে নিবিড়ভাবে চিনতেন, জানতেন। ঋত্বিকের একাধিক ছবিতে গান গেয়েছেন দেবব্রত। তবে সেসব খুব সহজে হয়নি। ঋত্বিককে রীতিমতো বেগ পেতে হয়েছে। ‘কোমল গান্ধার’ ছবিতে দেবব্রতর কণ্ঠ ব্যবহার করবেন ঋত্বিক। হঠাৎ বেঁকে বসেন গায়ক। তিনি গাইতে চান না। কেন? দেবব্রত জানান, তিনি অভিনয়ও করতে চান বন্ধুর ছবিতে। তাও আবার সুপ্রিয়া দেবীর সঙ্গে এক দৃশ্যে। বন্ধুর কথায় বাধ্য হয়ে রাজি হন ঋত্বিক। তারপরই বাড়ি থেকে বেরোন দেবব্রত। যান রেকর্ডিংয়ে। গেয়ে ওঠেন ‘আকাশ ভরা সূর্য তারা’। অনিল চট্টোপাধ্যায়ের লিপে দৃশ্যায়িত হয়েছিল গানটি। সেই গান আজও মনে রেখেছে বাঙালি। পরবর্তী সময়ে গেয়েছেন ঋত্বিকের ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’র ‘কেন চেয়ে আছ গো মা’। জানা যায়, এই গানটাই নাকি মদ খেয়ে গাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন ঋত্বিক। রবীন্দ্রনাথের গান মদ খেয়ে গাওয়ার কথা ভাবতেও পারেন না দেবব্রত বিশ্বাস। মানেননি বন্ধুর পরামর্শ। মদের প্রয়োজন কী? তিনি ছিলেন সুরের নেশায় মাতাল। বিতর্কে জড়িয়েছেন। চেষ্টা হয়েছে তাঁর কণ্ঠরোধের। তবে তাঁকে ব্রাত্য করে রাখা যায়নি। স্বতন্ত্র গায়কির গুণে তিনি জয় করেছেন অগণিত শ্রোতার হৃদয়। আজও তিনি চর্চিত।