এই ভারতবর্ষে আমরা যুগ যুগ ধরে আছি। একই পাড়ায় হিন্দু-মুসলিম-খ্রিস্টান বা বৌদ্ধদের মানসিক মিলনের মধ্যে গড়ে উঠেছে পাড়ার পরিবেশ এবং সমস্ত অলিতে-গলিতে মন্দির-মসজিদের সহাবস্থান। সারা ভারতবর্ষ জুড়ে আমরা এই একই পরিবেশ দেখি। তাহলে এতদিন ধরে যখন আমরা এখানে হাতে হাত রেখে পথ চলতে পেরেছি— ইদের সময় সৌমেন পাল রফিকের বাড়িতে পায়েস খেতে আসে। জেবুন্নেসা দুর্গাপুজোয় বিজয়া দশমীর সময় রিনাদের বাড়িতে গিয়ে খাওয়াদাওয়া করে এবং রিনার মায়ের কাছে প্রণাম করে মাথার উপরে আশীর্বাদ নিয়ে বাড়িতে চলে আসে— তাহলে আজ আমরা থাকতে পারব না কেন এবং কোথায় বা সেই অসুবিধা একসঙ্গে একইভাবে আগের মতো থাকতে। বিজেপি সরকার আজ অভিন্ন দেওয়ানি বিধি (Uniform Civil Code) প্রচলন করতে চলেছে তার কারণ ভারতবর্ষকে ধর্ম ও উপজাতিভিত্তিক টুকরো টুকরো করে দেওয়া। কিন্তু তাহলে তৎকালীন পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তানের ধর্ম এক, আইন এক এবং খাদ্য এক ছিল তাহলে বাংলাদেশ হল কেন? আবার ধর্ম ভাষা ও সংস্কৃতি এক থাকা সত্ত্বেও জার্মানি দু-টুকরো হয়ে গেল কেন। আবার বলা যায় ধর্ম ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি এক থাকা সত্ত্বেও আরব দেশগুলোর মধ্যে বিভেদ ও শত্রুতা কেন এত বেড়ে উঠেছে এবং একইভাবে ধর্ম-ঐতিহ্য সংস্কৃতি থাকা সত্ত্বেও খ্রিস্টান দেশগুলোর মধ্যে যুদ্ধবিগ্রহ প্রায় সময় দেখা যায় কেন। তাই একই ধর্ম ও একই আইন হলেও একতা মজবুত কোনওদিন থাকতে পারে না। অভিন্ন দেওয়ানি বিধি শুরু হলে আমরা যে সমস্যার মধ্যে পড়ব সেগুলোর মধ্যে কিছু আলোচনা করছি। শিখদের আনন্দ বিবাহ আইনের নিয়ম অনুযায়ী বিচ্ছেদের কোনও বিধান নেই। তাহলে তাদের বহু বছরের প্রথা বাতিল হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেবে। স্বাধীনতার পরেও গোয়া পর্তুগিজদের দখলে ছিল ১৯৬১ সাল পর্যন্ত এবং তারপরে যখন গোয়া মুক্ত হল তখন থেকে নিয়ম হয়ে আসছে যে, কোনও পুরুষের বয়স ৩০ বছর হলেও যদি কোনও সন্তান না হয় তাহলে গোয়ার পুরুষরা দ্বিতীয় বিয়ে করতে পারবেন। পারসি আইন অনুযায়ী দত্তক ছেলের ও মেয়ের সমান অধিকার থাকবে। এ ছাড়া আরও অনেক উপজাতিদের বিবাহ এবং বিবাহবিচ্ছেদ ও ব্যক্তিগত আচার-অনুষ্ঠানের নানা প্রথা আছে।
এবারে ভারতের সংবিধান প্রণেতাদের বিভিন্ন মতবাদ নিয়ে আলোচনা করা দরকার। সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল পাঁচ-চার ভোটে এই অভিন্ন দেওয়ানি বিধির (Uniform Civil Code) উপর ভোটাভুটিতে জিতে যান এবং পরিষ্কার করে বলে দেওয়া হয় যে ইউনিফর্ম সিভিল কোর্ট মৌলিক অধিকারের বাইরে রাখা হবে। তার ফলে এটাই পরিষ্কার যে ধর্মীয় অধিকারের তুলনায় দেওয়ানি বিধিকে কম গুরুত্ব দেওয়া হবে। যদিও ইসমাইল সাহেব অন্য রকমের মত পোষণ করেছিলেন। আম্বেদকর পরিষ্কার করে বলে দিয়েছিলেন যে এই দেওয়ানি বিধি এমনভাবে ব্যবহার করতে হবে যাতে মুসলিমরা কোনও বিদ্রোহ না করে অথবা অন্য কোনও উপজাতিদের অধিকার যেন ছিনিয়ে না নেওয়া হয়।
আরও পড়ুন- অভিষেক-রুজিরার বিরুদ্ধে লুকআউট সার্কুলার প্রত্যাহারের নির্দেশ দিল সুপ্রিম কোর্ট
ভারতীয় সংবিধানে ২৫ থেকে ২৮ ধারার মধ্যে পরিষ্কার করে ব্যক্তির ধর্মীয় অধিকারের কথা বলা হয়েছে এবং ২৯ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে বিভিন্ন সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার অধিকার সংবিধান দিয়েছে। কারণ বহু বছর ধরে হিন্দু খুব বিপদে আছে বা হিন্দুত্ববাদী ভাবধারা প্রতিষ্ঠিত করার মতবাদ মানুষ আর নিতে পারেনি আর সেই জন্যেই ৯৭ শতাংশ হিন্দু বসবাসকারী হিমাচল প্রদেশকে হারাতে হয়েছে বিজেপিকে। এবং ঠিক একইভাবে কর্নাটকেও মুখ থুবড়ে পড়েছে ভারতীয় জনতা পার্টি। তবে ভারতীয় জনতা পার্টি কিছুটা উপজাতির তাস খেলার চেষ্টা করেছিল বা জনজাতিদের মন পাওয়ার চেষ্টা করেছিল আর সেই জন্যই উত্তর-পূর্ব ভারত যাদের আমরা সেভেন সিস্টার বলে থাকি সেখানে লোকসভার মোট সিট ২৫টি তাই আগে থাকতে বলে দিয়েছে যে উত্তর-পূর্ব ভারতে এই অভিন্ন দেওয়ানী বিধি হবে না। কারণ ভোট বড় বালাই। অথচ মোদিজি ভুলে গিয়েছেন যে সারা ভারতবর্ষের বিভিন্ন রাজ্যের জনজাতির জন্য ৪৭টি আসন আছে লোকসভায় এবং তাহলে এই জনগোষ্ঠীর জন্য কি কোনও আলাদা রূপরেখা তৈরি করবেন? আসলে কী করবেন বা কেমন ভাবে নিজের বুদ্ধি টিকিয়ে রাখবেন এটা নিয়েই এখন খুব চিন্তার মধ্যে পড়েছে বিজেপি সরকার। অধুনা মণিপুরেও এই অভিন্ন দেওয়ানি বিধির প্রভাব শুরু হয়েছে। আসলে যতদিন এই ভারতবর্ষে অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র থাকবে ততদিন দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ হবেই সে হস্তিনাপুর হোক বা মণিপুর হোক।