১৯৭৭-এ ভারতের রাজনীতিতে এরকম একটা সময় এসেছিল। তাবৎ শর্ত ও ক্ষুদ্রস্বার্থ ভুলে আসমুদ্র হিমাচলে বিরোধীরা জোটবদ্ধ হয়েছিল। অবসান হয়েছিল অগণতান্ত্রিক জমানার। সেদিন জয়প্রকাশ নারায়ণ এক ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছিলেন। ভারত-ইতিহাসে আবার সেরকম এক প্রহর। মাহেন্দ্রক্ষণ সমুপস্থিত। কংগ্রেসকে বাস্তবটা বুঝতে হবে। বিশ্লেষণে জয়ন্ত ঘোষাল
(গতকালের পর)
আস্তে আস্তে কংগ্রেসের মধ্যে বিবর্তন ঘটে। বাম এবং ডান, দুই ধরনের রাজনীতির সংমিশ্রণ ঘটে। ফলত দল হিসেবে কংগ্রেস একটা অন্যরকম সম্ভবনার বলিষ্ঠ ভিত্তি রচনার অবকাশ পেয়ে যায়। কংগ্রেসের অভ্যন্তরে সেসময় গণতন্ত্রের বিকাশ হয়।
এরকম সময়েও এমন কিছু কিছু পদক্ষেপ কংগ্রেস সরকার নেহরুর সময় পর্যন্ত নিয়েছিল যেগুলো ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর পক্ষে খুব ভালো দৃষ্টান্ত কিন্তু নয়।
যেমন নেহেরুর সময়ে অনেকগুলো রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি হয়েছিল আর সেই রাষ্ট্রপতি শাসন জারির যে ঘটনাগুলো সেগুলোকে সুরঞ্জন দাস তাঁর উল্লিখিত ‘Interrogating Politics & Society : Twentieth-Century Indian Subcontinent’ গ্রন্থে অগণতান্ত্রিক বা যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর পরিপন্থী বলে তুলে করেছেন। স্মর্তব্য, ১৯৫২ থেকে ১৯৬৪ অন্তত পাঁচ বার অ-কংগ্রেসি মুখ্যমন্ত্রীদের নেতৃত্বাধীন রাজ্য সরকারকে ভেঙে দেওয়া হয়েছে। সেই সরকার ফেলার ক্ষেত্রে কোনোরকম সাংবিধানিক নৈতিকতা গুরুত্ব পায়নি। এটা কেরলে করা হয়েছে, এটা অন্ধ্রপ্রদেশে করা হয়েছে, এটা উড়িষ্যায় করা হয়েছে, ইত্যাদি ইত্যাদি।
এরপর ধাক্কা খেল কংগ্রেস। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা সত্ত্বেও ইন্দিরা গান্ধির সময়ই জোরালো ধাক্কা খেল তারা। এটা ঘটল ১৯৬৯ সালে।
একটা নয়, দুটো নয়, ন’টা রাজ্যে ক্ষমতাচ্যুত হয় তারা। এমনটা আগে কস্মিনকালেও কংগ্রেস ভাবেনি, এমনকি দুঃস্বপ্নেও নয়।
এর পর ভাঙন। ইন্দিরা গান্ধির সময়েই কংগ্রেসের ভাঙনের শুরু। দু-দুবার কংগ্রেস ভেঙেছে। সে সময়েই।
হিন্দু জাতীয়তাবাদী শক্তি ছিল তখনও ছিল। কিন্তু রাজনৈতিক দল হিসেবে জনসংঘ থেকে বিজেপিতে রূপান্তর হওয়ার পর আস্তে আস্তে বিজেপিও কিন্তু ভারতের একটা গুরুত্বপূর্ণ দল হতে শুরু করে।
আর এসবের মধ্যে ১৯৭৭-এ দিল্লিতে প্রথম অ-কংগ্রেসি সরকার গঠিত হল। কংগ্রেসের বিরুদ্ধে জনতা সরকার গঠন হয়েছে। কিন্তু ১৯৭৭ সালেই হোক বা পরবর্তীকালে দেবেগৌড়া-গুজরালের সরকারই হোক কখনওই কিন্তু সেই সরকার স্থায়ী সরকার হিসেবে মাথাচাড়া দিতে পারেনি। বিজেপি প্রথম দল যারা মোরারজি দেশাই, চরণ সিং, বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং, চন্দ্রশেখর, দেবেগৌড়া এবং গুজরালের মতো প্রধানমন্ত্রী দেয়নি। অটলবিহারী বাজপেয়ি ৬ বছর প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তখনও সেটা কোয়ালিশন সরকার ছিল।
পরবর্তীকালে এই বিজেপিই কিন্তু টানা দশ বছর স্থায়ী সরকার দিল। নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ একটা ব্রুট মেজরিটি নিয়ে তাঁরা রাজত্ব করছেন। সেই পরিস্থিতিতে কংগ্রেস ক্ষয়িষ্ণু। বিরোধী দল হিসেবে কংগ্রেসের কেবল যে আসন কমছে তা নয়, শুধু শতকরা ভোট কমছে তাও নয়, রাজ্যে রাজ্যে কংগ্রেস কার্যত মুছে যাচ্ছে। সংগঠন সাইনবোর্ড থেকে দেশলাই বাক্স হওয়ার পথে।
পশ্চিমবঙ্গের কথায় যদি ধরা যায় তাহলে দেখা যাবে এবারে বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেস বামপন্থীদের সাথে হাত মিলিয়ে ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্টে সঙ্গে জোট বেঁধে ভোট যুদ্ধে নেমেছিল। ফল কী হল? কংগ্রেস এবং বাম দু’পক্ষই শূন্য হয়ে গেছে। আর পশ্চিমবঙ্গেও কংগ্রেসের সৌজন্যে বিরোধী রাজনৈতিক পরিসরটা কিন্তু বিজেপি নিয়ে নিয়েছে।
দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে কংগ্রেসের এইরকম একটা অবস্থা কী কাম্য? কংগ্রেসের বোধহয় বোঝা প্রয়োজন যে পুরনো সামন্ততান্ত্রিক জমিদারি মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আর রাজ্যে রাজ্যে আঞ্চলিক দল গঠিত হয়েছে, রাজ্যভিত্তিক রাজনৈতিক শক্তি অর্জন করেছে; তাদেরকে মর্যাদা দিতে হবে।
এটা ঠিক যে বেশকিছু রাজ্যে কংগ্রেস বনাম বিজেপি একটা লড়াই আছে। আঞ্চলিক দলগুলো এখনো সেভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারেনি। কিন্তু দুদিন আগেও যেখানে আঞ্চলিক দলগুলো ছিল না সেখানে আঞ্চলিক দলের সংগঠন তৈরি নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে।
কেউ কি ভাবতে পেরেছিল যে গোয়াতে তৃণমূল কংগ্রেস এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে? কেউ কি ভাবতে পেরেছিল যে ত্রিপুরায় বিজেপির শাসন এইরকম ভাবে তৃণমূল কংগ্রেসের জন্য একটা বিরাট চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে?
সুতরাং কংগ্রেসকেও তার নেতৃত্ব সুগঠিত করতে হবে। ক্রমবর্ধমান অবক্ষয় রোধ করতে হবে। কিন্তু কংগ্রেস যখন গণতন্ত্রের কথা বলে তখন কিন্তু কংগ্রেস নেতাদের ভেবে দেখতে হবে, তাদের সংগঠনের ক্ষেত্রেও কতটা গণতন্ত্র কার্যকর হচ্ছে । যে বিক্ষুব্ধ নেতারাও চিঠি দিয়েছিল, যারা G-23 বলে পরিচিত সেই বিক্ষুব্ধ নেতাদের এখনও ডেকে কথা বলা তো দূর অস্ত, তাদের সঙ্গে এখনও পর্যন্ত কোনও আপসমীমাংসা কংগ্রেস হাইকম্যান্ড করে উঠতে পারেনি। এই পরিস্থিতিতে ভারতের মতো এত জটিল আর এত বড় দেশ চালানোর জন্য যে রাজনৈতিক দর্শন, প্রজ্ঞা ও মানসিকতা প্রয়োজন সেটা কিন্তু রাহুল গান্ধির নেতৃত্বে দেখা যাচ্ছে না।
সুতরাং এই মুহূর্তে নরেন্দ্র মোদির মোকাবিলা করার জন্য অন্যকে দোষ না দিয়ে কংগ্রেসের আগে নিজেদের ঘর নিজেদের সামলানো উচিত। আর সমস্ত বিরোধীদলের উচিত নরেন্দ্র মোদির বিরুদ্ধে একই মঞ্চে এসে দাঁড়নো। কে প্রধানমন্ত্রী হবেন আর কে হবেন না, সেটা আজকের আলোচ্য বিষয় নয়। আজকের প্রধান আলোচ্য বিষয় হচ্ছে যে বিজেপিকে প্রধান শত্রু চিহ্নিত করে সমস্ত বিরোধীদলকে একটা ছাতার তলায় এসে দাঁড়াতে হবে। ঠিক যেমনটা হয়েছিল জয়প্রকাশ নারায়ণের আন্দোলনের সময়। এটাই সময়ের দাবি।