শিশুর শরীরে অচেনা বিপদ

শীতের কুয়াশা-ঢাকা ভোরে যখন নিঃশ্বাসে জমে শিশির— ঠিক তখনই কিছু অচেনা রোগ নিঃশব্দে ঘিরে ফেলে শিশুদের জগৎ। না-বুঝে আমরা উপেক্ষা করি, কিন্তু ওইগুলোই ডেকে আনতে পারে ভয়ঙ্কর স্বাস্থ্যসংকট। তেমনই আরও কিছু রোগ নিয়ে আজ আলোচনায় তুহিন সাজ্জাদ সেখ

Must read

শীতের প্রসঙ্গ
শীত ঋতুতে শিশুরা বড়দের সঙ্গে মিলে উৎসবের আনন্দে মেতে ওঠে : রঙিন পোশাক আর রসনা তৃপ্তির খোরাক— দুটোই উপভোগ করে, সঙ্গে খড়ের আগুনের চারপাশে গল্পের আসর, কিংবা উষ্ণ কম্বলে জড়িয়ে খেলাধুলার হাসি-ঠাট্টা। শীতের হাওয়ায় লাগে মনের কোণে একটা অদ্ভুত আনন্দের ঝংকার— যা শিশুদের জীবন আরও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। কিন্তু এই আনন্দের পর্দার আড়ালে লুকিয়ে থাকে এক অদৃশ্য বিপদের ছায়া। সাধারণ ঠান্ডা-কাশি তো রয়েছেই, যা প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ শিশুকে আক্রান্ত করে, কিন্তু তার বাইরেও শীতের শুষ্ক বাতাস, কম আর্দ্রতা এবং ভাইরাল সংক্রমণের প্রাদুর্ভাব শিশুদের দেহে বিরল কিছু রোগের দরজা খুলে দেয়। শীতকালে শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা স্বাভাবিকভাবেই কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়ে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুসারে, শীতকালে শিশুমৃত্যুর হার প্রায় ২০-৩০% বৃদ্ধি পায় উন্নয়নশীল দেশগুলোতে, যার মধ্যে এই বিরল রোগগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
অ্যাটোপিক ডার্মাটাইটিসের তীব্রতা
এটি এক ধরনের দীর্ঘস্থায়ী ত্বকের প্রদাহজনিত রোগ, একে শীতকালীন একজিমাও বলা হয়। এতে ত্বকে চুলকানিযুক্ত, শুষ্ক ও লালচে দাগ সৃষ্টি হয়। শীতের শুষ্ক বাতাসে এই সমস্যা আরও বেড়ে যায়, ফলে ব্যাকটেরিয়াল বা ফাঙ্গাল সংক্রমণও ঘটতে পারে। বিরল ক্ষেত্রে এই প্রদাহ সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। এর মারাত্মক অবস্থার নাম এরিথ্রোডার্মা। যেখানে ত্বকের প্রায় পুরো শরীর জুড়ে লাল ও জ্বলন্ত হয়ে ওঠে।

কেন বিরল
সাধারণ একজিমা শীতকালে আর্দ্রতার অভাব, উলের পোশাকের ঘর্ষণ ও ধুলোর কারণে বেড়ে যায়। শীতের শুষ্কতায় যখন বাতাসে আর্দ্রতার অভাব, ত্বক তখন তার জৈব রক্ষাকবচ হারিয়ে ফেলে— আর তখনই জ্বালা, চুলকানি ও একজিমার নীরব কষ্ট ফিরে আসে। কিন্তু গুরুতর বা নিয়ন্ত্রণহীন অ্যাটোপিক ডার্মাটাইটিস তুলনামূলকভাবে বিরল— শিশুদের ত্বকজনিত রোগের মাত্র ২-৫ শতাংশ ক্ষেত্রে এইরূপ দেখা যায়। শহুরে দূষিত পরিবেশ, যেমন দিল্লির মতো অঞ্চলে, এই রোগের প্রকোপ তুলনামূলকভাবে বেশি।
প্রাদুর্ভাব ও প্রতিরোধ
মোট শিশুর প্রায় ১০-২০ শতাংশ অ্যাটোপিক ডার্মাটাইটিসে আক্রান্ত হলেও, তাদের মধ্যে প্রায় ৩০ শতাংশ বাচ্চার শীতকালে এই রোগের তীব্রতা বাড়ে। এই ঘটনাগুলি প্রায়ই ‘বিরল জটিলতা’ হিসেবে উপেক্ষিত থেকে যায়। তাই ত্বক আর্দ্র রাখতে নিয়মিত ময়েশ্চারাইজার ও ইমোলিয়েন্ট ব্যবহার, প্রদাহ কমাতে ডাক্তারের পরামর্শে ওষুধ সেবন এবং ধুলো, উলের পোশাক, হিটার বা ধোঁয়ার মতো উত্তেজক উপাদান থেকে বাচ্চাদের দূরে রাখা প্রয়োজন।

আরও পড়ুন-সুন্দরবনের উপকূল রক্ষায় ৪১০০ কোটি টাকার ‘শোর’ প্রকল্প, প্রযুক্তিগত সহায়তায় নেদারল্যান্ডস

হাইপোথার্মিয়া-জনিত আকস্মিক কিডনি বিকলতা
এই ঘটনা শহরের পরিবেশে সত্যিই বিরল। শরীরের কেন্দ্রীয় তাপমাত্রা যখন ৩৫° সেলসিয়াসের নিচে নেমে যায়, তখন শুরু হয় প্রবল কাঁপুনি, বিভ্রান্তি এবং ধীরে ধীরে বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের বিকলতা। শরীর উৎপন্ন করার চেয়ে দ্রুত তাপ হারায়। এর ফলে শরীরের প্রধান অঙ্গগুলি ঠিকমতো কাজ করা বন্ধ করে দিতে পারে এবং যদি চিকিৎসা না করা হয়, তবে এটি মারাত্মক হতে পারে এবং হার্ট ও শ্বাসকষ্টের ব্যর্থতার দিকে নিয়ে যেতে পারে। রক্তপ্রবাহ কমে যাওয়ায় কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ফলে দেখা দিতে পারে আকস্মিক কিডনি বিকলতা।

কেন বিরল
ভারতের তুলনামূলক নরম শীতের কারণে এই রোগ প্রায় অদেখা। তবে উত্তর ভারতের গ্রামীণ বা বস্তি এলাকায় প্রবল শৈত্যপ্রবাহের সময়— যেমন রাজস্থান বা হিমাচলের মাইনাস ৫° সেলসিয়াস তাপমাত্রায় এটি দেখা যায়। অপুষ্ট বা গৃহহীন শিশুরাই এ-রোগের সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। এই রোগের হার ০.১%-এরও কম, তবে চরম ঠান্ডা পড়লে কিছু ক্ষেত্রে আকস্মিকভাবে বেড়ে যায়। তখন অনেকক্ষেত্রেই আক্রান্তদের হাসপাতালে ভর্তি করাতে হয়।

প্রতিরোধ ও চিকিৎসা
বহুস্তরীয় উষ্ণ পোশাক, গরম তরল পানীয় এবং চরম বাড়াবাড়ির ক্ষেত্রে চিকিৎসকের নজরদারিতে নিয়ন্ত্রিতভাবে শরীরকে উষ্ণ করা ও শিরায় তরল প্রয়োগ— এইসবই প্রধান চিকিৎসা ও প্রতিরোধের উপায়।

ভিটামিন ডি-র ঘাটতিজনিত রিকেটস
সাধারণত হাড় নরম হয়ে যাওয়া, পায়ে বাঁক ধরা, বৃদ্ধি বিলম্বিত হওয়া এবং সহজে হাড় ভেঙে যাওয়া— এই রোগের প্রধান লক্ষণ। ভিটামিন ডি-এর অভাবে ক্লান্তি, পেশির দুর্বলতা, হাড় ও পেশিতে ব্যথা এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়ার মতো সমস্যা দেখা দেয়। পর্যাপ্ত সূর্যালোকের সংস্পর্শে না আসা এবং খাদ্যাভ্যাসে ভিটামিন ডি-এর ঘাটতি প্রধান কারণ। এর ফলে শিশুদের এবং প্রাপ্তবয়স্কদের এটা হতে পারে।

আরও পড়ুন-শুরু একাদশ–দ্বাদশে নিয়োগের ইন্টারভিউ

কেন বিরল
ভারতে ভিটামিন ডি-এর ঘাটতি শিশুদের মধ্যে ব্যাপক (৩০–৫০%) হলেও, চিকিৎসাগতভাবে স্পষ্ট রিকেটস্ দেখা যায় খুব কম— মাত্র ৫%-এরও নিচে। এর প্রধান কারণ হল প্রাথমিক পর্যায়েই ভিটামিন ডি সাপ্লিমেন্ট দেওয়া হয়। তবে উত্তর ভারতের কুয়াশাচ্ছন্ন ও ঠান্ডা শীতের মাসগুলিতে এর প্রকোপ কিছুটা বৃদ্ধি পায়। সমীক্ষায় দেখা গেছে, পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশুদের মধ্যে উপসর্গ-সহ রিকেটসের হার প্রায় ১-২%।

প্রতিরোধ ও চিকিৎসা
প্রতিদিন ৪০০ আইইউ ভিটামিন ডি গ্রহণ, প্রতিদিন অন্তত ১৫-২০ মিনিট সূর্যালোকে থাকা এবং খাদ্য তালিকায় পরিবর্তন, অবশ্যই দুধ ও ক্যালসিয়ামসমৃদ্ধ খাবার খাওয়াই এর প্রধান প্রতিরোধ ও চিকিৎসা।
শীতের দিনে শিশুদের সুরক্ষায় দরকার সচেতন যত্ন ও প্রতিরোধ। নিয়মিত হাত ধোয়া, ঘরে পর্যাপ্ত বাতাস চলাচল নিশ্চিত করা ও আর্দ্রতা বজায় রাখা যেগুলো ছত্রাক ও সংক্রমণ রোধে সহায়ক। ইনফ্লুয়েঞ্জা ও নিউমোকক্কাল টিকা নেওয়া জরুরি। যদি জ্বর ১০১° ফারেনহাইট ছাড়ায়, শ্বাসকষ্ট বা অস্বাভাবিক ক্লান্তি দেখা দেয়, অবিলম্বে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন। বিশেষ করে এইসময় শ্বাসজনিত রোগের প্রকোপ বেশি, তাই সতর্ক নজরদারি ও সময়োচিত চিকিৎসাই শিশুস্বাস্থ্যের সুরক্ষার চাবিকাঠি।

Latest article