রোগের চিকিৎসার করার চেয়ে রোগ প্রতিরোধ করা বেশি জরুরি অর্থাৎ prevention is better than cure— বিশেষ করে সেইসব ভাইরাস যেগুলোর বিরুদ্ধে কাজ করে এমন অ্যান্টিবায়োটিক নেই বা সহজে মেলে না। যেসব ভাইরাস মিউটেশনের মাধ্যমে নিজেদের আকারে পরিবর্তন আনতে সক্ষম তাদের জন্য একমাত্র উপায় প্রতিরোধ বা এককথায় টিকাকরণ। ভ্যাকসিন লাগাম পরিয়েছে বহু রোগে। সম্প্রতি সেই অভিজ্ঞতা সবার হয়েছে অতিমারির সময়। কোভিড ১৯ রুখতে গণটিকাকরণ বা মাস ইমিউনাইজেশন খুব কার্যকরী ফল দিয়েছে।
আরও পড়ুন-১৪ দিন বয়সে ছ’বার হার্ট অ্যাটাক, মায়ের কোলে ফিরিয়ে দিল পিজি
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তরফে দাবি করা হয়েছে, কোভিড টিকাকরণের ফলে বিশ্বে অন্তত ২ থেকে ৩ মিলিয়ন প্রাণ বাঁচানো সম্ভব হয়েছে। অ্যাকিউট রেসপিরেটরি ইনফেকশন বা এআরআই যেমন ফ্লু, শ্বাসনালির অসুস্থতা ইত্যাদির ক্ষেত্রে একমাত্র প্রতিরোধ গড়েছে ভ্যাকসিন। টিকাকরণের এই গুরুত্বের কথা মাথায় রেখেই প্রতি বছর ১৬ মার্চ ভারতে পালিত হয় জাতীয় টিকাকরণ দিবস। ১৯৯৫ সালে এই দিনটিতেই ভারতে প্রথম ওরাল পোলিও ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছিল। পোলিও রোগটি নির্মূলের জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রচার টিকাকরণ কর্মসূচি গ্রহণ করে ১৯৮৮ সালে। দেশব্যাপী টিকাকরণ কর্মসূচিকে জনপ্রিয়তার শিখরে এনে দেয় ‘দো বুন্দ জিন্দেগি কি’ শীর্ষক কর্মসূচি। নবজাতক থেকে শুরু করে ৫ বছর পর্যন্ত প্রত্যেকটি শিশু যাতে দু’ফোঁটা ওরাল পোলিও টিকা পায়, সেই বিষয়ে ভারতে দীর্ঘদিন কর্মসূচি চলেছে। অবশেষে ২০১৪ সালের ২৭ মার্চ ভারতকে পোলিও ফ্রি নেশনের তকমা দেয় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। এই লড়াইয়ের জন্যই ভারত আজ পোলিও মুক্ত। শুধু পোলিও নয়, শিশুর জন্মের পরই বিভিন্ন সংক্রমণ রুখতে যেমন দেওয়া হয় টিকা তেমনই প্রাপ্তবয়স্কের জন্যেও রয়েছে একাধিক টিকা। জাতীয় টিকাকরণ দিবসে সেই সচেতনতা বৃদ্ধি ও প্রচার করা হয়।
আরও পড়ুন-তৃণমূলে যোগ দিলেন নির্দল কাউন্সিলর
২০২৪-এ এই দিনটার থিম হল ‘ভ্যাকসিন ওয়র্ক ফর অল’।
টিকাকরণের ইতিহাস
টিকার সঙ্গে প্রথম পরিচয় চিনের। ১০ম শতাব্দীতে ‘ভ্যারিওলেশন’ নাম এক চিনা চিকিৎসা পদ্ধতি ছিল যেখানে অসুস্থ রোগীর দেহ থেকে টিস্যু নিয়ে সুস্থ মানুষের দেহে বসিয়ে দেওয়া হত। এর আট শতাব্দী পরে ব্রিটিশ ডাক্তার এডওয়ার্ড জেনার লক্ষ করলেন গোয়ালিনীরা গরুর বসন্তে আক্রান্ত হচ্ছে যা প্রাণঘাতী। যা গুটিবসন্ত নামে পরিচিত।
সে-সময় এই গুটিবসন্ত ছিল সবচেয়ে ভয়ানক এক সংক্রামক ব্যাধি। এই রোগে শতকরা ৩০ ভাগ মারা যেতেন। আর যাঁরা বেঁচে থাকতেন তাঁরা হয় অন্ধ হয়ে যেতেন বা তাঁদের মুখে থাকত মারাত্মক ক্ষতচিহ্ন। ১৭৯৬ সালে ডক্টর জেনার, জেমস ফিপস নামে আট বছর বয়সি এক ছেলের ওপর পরীক্ষা চালান এবং গুটিবসন্তের টিকা আবিষ্কারে সফল হন। ১৭৯৮-এ তাঁর সেই পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিতও হয়। বিশ্ব এই প্রথম ভ্যাকসিন শব্দটার সঙ্গে পরিচিত হল। ‘ভ্যাকসিন’ শব্দটি এসেছে ল্যাটিন শব্দ ‘ভ্যাক্সা’ থেকে যার অর্থ গরু। ১৯৭৯ সালের মধ্যে গণটিকাকরণের প্রচেষ্টায় গুটিবসন্তকে নির্মূল করতে সক্ষম হয়েছে ভারত।
১৮, ১৯ শতকে বিজ্ঞানী লুই পাস্তুর আবিষ্কার করেন অ্যানথ্রাক্স রোগের কারণ এবং অ্যানথ্রাক্সের প্রতিষেধক। সেসময় জলাতঙ্ক রোগের ব্যাপক প্রকোপ ছিল। পাগলা কুকুর কামড়ালে মানুষ সেই রোগে আক্রান্ত হত। জীবনহানি ঘটত। লুই পাস্তুর ১৮৮৫ সালে আবিষ্কার করেন জলাতঙ্ক রোগের প্রতিষেধক। জলাতঙ্কের টিকা আবিষ্কারের পরে ফ্রান্স সরকার পাস্তুর ইনস্টিটিউট স্থাপন করেন।
টিকা আবিষ্কারের সময় থেকেই ধর্মীয় কারণে টিকার ব্যাপারে সন্দিহান ছিলেন বহু মানুষ। এটা মানুষের সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকারকে খর্ব করে বলেও কিছু মানুষ মনে করতেন। সপ্তদশ শতাব্দীতে ব্রিটেনের বিভিন্ন জায়গা জুড়ে টিকা-বিরোধী লিগ গড়ে ওঠে। তারা বিকল্প ব্যবস্থার পরামর্শ দিত। কিন্তু টিকাকরণের গুরুত্ব দিনে দিনে বেড়েছে।
আরও পড়ুন-জল্পেশ মন্দিরে পুজো দিয়ে প্রচার শুরু প্রার্থী নির্মলের
কী কী টিকা নিলে ভাল
জন্মের পরই শিশুদের জন্য টিকার
তালিকা দিয়ে দেওয়া হয়
হাসপাতাল, নার্সিংহোম থেকে। এই মুহূর্তে জাতীয় টিকাকরণ কর্মসূচি এবং ইন্ডিয়ান অ্যাকাডেমি অফ পেডিয়াট্রিক্সের নির্দেশিত টিকাসূচির অন্তর্ভুক্ত ভাইরাসরোধী টিকাগুলো হল :
১) পোলিও
২) মিজিলস বা হাম
৩) মাম্পস
৪) রুবেলা
৫) ইনফ্লুয়েঞ্জা বা ফ্লু
৬) ভ্যারিসেলা বা চিকেন পক্স
৭) জাপানিজ এনকেফেলাইটিস
৮) হেপাটাইটিস এ, বি
৯) রোটা ভাইরাস
১০) এইচপিভি বা হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস
প্রাপ্তবয়স্কের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট তালিকা না থাকলেও চিকিৎসকের পরামর্শে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ভ্যাকসিন নেওয়া উচিত। সেগুলো হল—
ইনফ্লুয়েঞ্জা ভ্যাকসিন
ইনফ্লুয়েঞ্জা সাধারণত ফ্লু নামে পরিচিত একটি অত্যন্ত সংক্রামক শ্বাসযন্ত্রের অসুস্থতা যা গুরুতর জটিলতার কারণ হতে পারে। বার্ষিক ফ্লু শট নেওয়া সব বয়সের প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য অপরিহার্য।
টিটেনাস, ডিপথেরিয়া, পারটুসিস
টিড্যাপ (Tdap) ভ্যাকসিন এই তিনটি গুরুতর ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়ে যেগুলো হল টিটেনাস, ডিপথেরিয়া এবং পার্টুসিস (হুপিং কাশি)। প্রাপ্তবয়স্কদের প্রতি দশ বছরে একটা Tdap বুস্টার ভ্যাকসিন নিতে হবে।
নিউমোকক্কাল
নিউমোনিয়া, মেনিনজাইটিস এবং রক্তের সংক্রমণের মতো গুরুতর কারণে নিউমোকক্কাল রোগ হতে পারে। মোট তিন ধরনের নিউমোকক্কাল কনজুগেট ভ্যাকসিন রয়েছে বয়সের উপর ভিত্তি করে চিকিৎসক স্থির করেন ডোজ।
শিংলস
ভ্যারিসেলা জস্টার ভাইরাস থেকে হয় শিংলস রোগ যা হারপিস জস্টার নামেও পরিচিত। ভ্যারিসেলা জস্টার ভাইরাস আবার চিকেন পক্সেরও কারণ। এই রোগে ফুসকুড়ি হয় যা খুব যন্ত্রণাদায়ক। চিকেন পক্সের পরে এই রোগটি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। ৫০ বছর বা তার ঊর্ধ্বের যাঁরা তাঁদের জন্য এই ভ্যাকসিন নেওয়া জরুরি।
এইচপিভি
সার্ভিকাল ক্যানসার থেকে রক্ষা পেতে মেয়ে এবং ছেলে উভয়ের জন্য HPV টিকা নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। যৌন কার্যকলাপ শুরু আগে এই টিকা নেওয়া জরুরি। ছেলে এবং মেয়ে উভয়ের ২৫-এর আগেই এই টিকা নেওয়া প্রয়োজন।
হেপাটাইটিস
হেপাটাইটিস ভ্যাকসিন হেপাটাইটিস ভাইরাসের বিরুদ্ধে সুরক্ষা দেয়। যা লিভার রোগের কারণ। প্রাপ্তবয়স্ক যাঁরা লিভারের রোগে ভুগছেন চিকিৎসকের পরামর্শে তাঁদের তিনটে ডোজ অবশ্যই নিতে হবে।
এছাড়াও রয়েছে আরও বেশকিছু ভ্যাকসিন তবে যেটাই নিন না কেন, অবশ্যই বিশেষজ্ঞের পরামর্শে নিন।