বৈষ্ণব পদাবলি সাহিত্যের মূল বর্ণিতব্য বিষয় রাধাকৃষ্ণলীলা বা গৌরাঙ্গলীলা। গোটা মধ্যযুগের বাংলায় জনসমাজের ভিতর সম্প্রীতি ও সমন্বয়ের অত্যুজ্জ্বল নিদর্শন বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন বৈচিত্রময় ধারা। প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মমতের জায়গায় হিন্দু-মুসলিম সংস্কৃতির ফারাক থাকলেও, সাহিত্যের আঙিনায়, লোকসমাজের বৃহত্তর পরিসরে অথবা দৈনন্দিন গ্রামীণ জীবনে এই সম্প্রদায়গত ভেদ ঘুচে গিয়েছিল। কারণ, একটাই সাংস্কৃতিক পরিসর বাংলার সামগ্রিক জীবনে বহমান ছিল। তার উপরে শ্রীচৈতন্যের বৈপ্লবিক ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন সমাজের উঁচুতলার মানুষ থেকে আরম্ভ করে একেবারে নিচুতলার অসংখ্য মানুষকে এতটাই প্রভাবিত করেছিল যে, দুই পৃথক সম্প্রদায়ের মানুষ বৈষ্ণব ভাবাদর্শের অখণ্ড পরিসরে একে অপরের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল। সঙ্ঘ পরিবার আজ এই বাংলায় সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধির বিষ ছড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা করেও যে সফল হচ্ছে না, কারণ, বাংলার সামাজিক তন্ত্রীতে (social fabric) হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতি এবং ঐক্যের এক অটুট বন্ধন দৃঢ় হয়ে আছে।
আরও পড়ুন-শেষ দফার ভোট চলাকালীন মুম্বইগামী বিমানে বোমাতঙ্ক!
একাধিক গবেষক দেখিয়েছেন, চৈতন্যের ভাবাদর্শে ইসলামি সুফি দর্শনের প্রভাব পড়েছিল। তাই, সুফি মতের সঙ্গে বৈষ্ণব মতের সাদৃশ্যও একাধিক মুসলমান কবিকে বৈষ্ণব পদ-রচনায় আকৃষ্ট করে থাকতে পারে। আবার, নিছক সাহিত্যিক আগ্রহে, প্রেমের কবিতা হিসেবেই তাঁদের কেউ কেউ হয়তো পদাবলি— সাহিত্যধারার অনুসরণ করেছিলেন। কিন্তু যাঁরা বাংলার লোকসমাজের গড়ন নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করে চলেছেন, তাঁদের মতে বৈষ্ণব ভাবান্দোলন একটি বিরাট অংশের মানুষের মধ্যে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল। স্বাভাবিকভাবেই, সেই লোকসমাজের মধ্যে মুসলমান জনসমাজও ছিল। তাদের অনেকেই বৈষ্ণবধর্মের প্রতিও আকৃষ্ট হয়েছেন। সুফিধর্মের প্রভাবে জীবাত্মা ও পরমাত্মার রূপক হিসেবে রাধা-কৃষ্ণকে গ্রহণ করেছেন কেউ কেউ— একথা অনেক সাহিত্য ইতিহাসকারই বলেছেন। এই কবিরা লায়লা-মজনু, ইউসুফ-জোলেখা, শিরি-ফরহাদের মতো মর্ত্যপ্রেমের কাহিনিকে রাধা-কৃষ্ণ প্রেমের আখ্যানে মিলিয়ে দিয়েছেন। যেমন সৈয়দ মর্তুজার একটি পদ, যেখানে কবি কৃষ্ণের প্রতি তাঁর আকর্ষণ ও সমর্পণ প্রকাশ করছেন—
মোরে করহ দয়া দেহ পদছায়া
শুন শুন পরাণ কানু।
কুলশীল সব ভাসাইনু জলে
না জীয়ত তুয়া বিনু।।
আরও পড়ুন-উত্তরপ্রদেশে আবারও তাপপ্রবাহের জেরেই কি মৃত্যু ১৩ ভোটকর্মীর?
এই আকুতি রাধার। একজন মুসলিম কবিও যখন কৃষ্ণের কাছে নিজেকে সমর্পণ করছেন, তখন তিনি নিজেকে রাধার সদৃশ কল্পনা করছেন। মুসলিম কবিদের মধ্যে কেউ কেউ ব্রজবুলিতেও পদ রচনা করেছেন। নসির মামুদের একটি ব্রজবুলি পদের ভণিতা এরকম—
আগম নিগম বেদসার
লীলায় করত গোঠ বিহার।।
নসির মামুদ করত আলা
চরণে শরণে দান-রি।।
পদটি একান্তভাবেই বৈষ্ণব-ভাবাপন্ন। এতে একদিকে যেমন শব্দ-ঝঙ্কার এবং অলঙ্কার-নৈপূণ্য প্রকাশ পেয়েছে, অন্যদিকে তেমনই ধ্যানতন্ময় কবির আন্তরিকতার সুরটিও অগোচর থাকেনি। ‘পদ্মাবতী’ কাব্যের কবি আলাওল-ও বেশ কিছু বৈষ্ণব পদ রচনা করেছিলেন। তাঁর অঙ্কিত ছবিতে রাধা এক পল্লিবালিকার রূপ ধারণ করেছেন :
প্রত্যূষ বিহানে কমল দেখিয়া পুষ্প তুলিবারে গেলুম।
বেলা উদানে কমল মুদানে ভ্রমর দংশনে মৈলুম।।
কমলকণ্টকে বিষম সঙ্কটে করের কঙ্কণ গেল।
কঙ্কণ হেরিতে ডুব দিতে দিতে দিন অবশেষে ভেল।।
আরও পড়ুন-ওভারহেড তার ছিঁড়ে পুরীগামি নীলাচল এক্সপ্রেসে রক্তাক্ত যাত্রী
অধ্যাপক যতীন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য তাঁর ‘বাংলার বৈষ্ণবভাবাপন্ন মুসলমান কবি’ বইতে মোট ১০২ জন বৈষ্ণবভাবাপন্ন মুসলিম কবির কথা উল্লেখ করেছেন। মনে রাখা দরকার, এই কবিরা কিন্তু কেউই মুসলমান ধর্ম ত্যাগ করে বৈষ্ণব পদ লেখেননি। কিন্তু এঁরা ভক্ত-কবি। তাই, সাম্প্রদায়িক ধর্মমত নিয়ে কখনওই ব্যস্ত ছিলেন না। সম্প্রদায়গত গোষ্ঠীচেতনা ঔপনিবেশিক যুগে, বিদেশি শাসকের কূট কৌশলে আমাদের সমাজে এত বেশি শিকড় গেড়ে বসেছে। আর, সঙ্ঘ পরিবার ছিল ব্রিটিশের প্রত্যক্ষ সহযোগী। তারা ঔপনিবেশিক দৃষ্টিকোণ থেকেই হিন্দু-মুসলিম বিভাজনের বিদ্বেষী ভাবনা প্রচার করে চলেছে গত একশো বছর ধরে। কিন্তু বাংলা সাহিত্য ও বাংলার লোকধর্মের ইতিহাস সঙ্ঘ পরিবারের বিকৃত ইতিহাস-ভাবনার সম্পূর্ণ বিপরীত। যে মুসলমান কবিদের কথা বলা হল, তাঁরা সকলেই ভক্তির ঐকান্তিক নিষ্ঠা আর অন্তরের সারল্য নিয়েই কবিতা লিখেছেন। আরাকান-রোসাঙের কবি দৌলত কাজি ও আলাওল যে দুটি আখ্যানকাব্য লিখেছিলেন, অর্থাৎ ‘সতী ময়না ও লোর চন্দ্রানী’ এবং ‘পদ্মাবতী’, তাদের ভিতর নানা জায়গায় রাধাকৃষ্ণের প্রসঙ্গ আছে। সৈয়দ মর্তুজার ভণিতায় ২৮টি পদ পাওয়া গেছে। সতেরো শতকের শেষদিকে মর্তুজা মুর্শিদাবাদের হিন্দু-মুসলমান ভক্তসমাজে বিশেষভাবে পরিচিত ছিলেন। তাঁকে বাউল বা ফকিরসাধক বলেও মনে করেন কেউ কেউ। বৈষ্ণবতন্ত্র ও হিন্দুতন্ত্রের সঙ্গে তাঁর বিশেষ পরিচয় ছিল। আলিরাজা তাত্ত্বিক সাধক হিসেবে বিশেষভাবে পরিচিত ছিলেন। ইনি দরবেশ শাখাভুক্ত হলেও হিন্দু তন্ত্র ও যোগশাস্ত্রে বিশেষ পারদর্শী ছিলেন। সে-কারণেই হিন্দু-মুসলিম উভয়েই তাঁর শিষ্য হয়েছিল। তাঁর মাপের অসাম্প্রদায়িক, উদার, আধ্যাত্মিক কবি মধ্যযুগে বিরল। তাঁর একটি বৈষ্ণব পদে রাধার বেদনা— “বনমালী, কি হেতু রাধারে ভাব ভিন/ তোমার প্রেমের ঘায় দগধে জীবন যায়/ নিত্য রাধা মদন অধীন”। এইসব কবিতা পড়লে কি মনে হয় এরা হিন্দু বৈষ্ণব পদকর্তাদের চেয়ে কোনও অংশে কম প্রতিভাবান?