স্মৃতির জলছবিতে সুব্রত মুখোপাধ্যায়

কয়েক দিন আগেই ৪ নভেম্বর চলে গেল সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের পঞ্চম প্রয়াণদিবস। সেই উপলক্ষে ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণায় প্রবীণ শিক্ষাবিদ ড. শিবরঞ্জন চট্টোপাধ্যায়

Must read

পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় সুব্রত মুখোপাধ্যায় তাঁর বিতর্ক-আলোচনার দ্বারা সংসদীয় গণতন্ত্রকে সমৃদ্ধ করেছেন।
তিনি ১৯৮২ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত কখনও বিরোধী মুখ্যসচেতক হিসাবে, কখনও উপ-বিরোধী দলনেতা হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। ১৯৭১-এ সুব্রতদা প্রথম বিধায়ক নির্বাচিত হওয়ার পর এসইউসি-র বরিষ্ঠ বিধায়ক সুবোধ ব্যানার্জিকে অনুরোধ করেছিলেন, বিধানসভার নিয়মাবলি ও কার্যবিধি তাঁকে একটু শিখিয়ে দিতে। সুবোধবাবু রাজি হলেন একটি শর্তে— এই সংক্রান্ত কয়েকটি বই হাতে নিয়ে প্রতিদিন সুব্রতদাকে বিধানসভায় আসতে হবে, তিনি বইগুলি পড়ুন বা না পড়ুন। একমাস পরে সুবোধবাবু পাঠ দেবেন। সুব্রতদা এবং সুবোধবাবু উভয়ই তাঁদের কথা রেখেছিলেন। এই প্রবন্ধকারকে সুব্রতদা এই কথাগুলি বলেছিলেন। বিধানসভার এক উচ্চপদস্থ আধিকারিক আমাকে বলেছেন, বিধানসভার অধিবেশনে সুব্রতদার অনুপস্থিতি এক ব্যতিক্রমী ঘটনা। তিনি দেখালেন, বিরোধী দলের সদস্যসংখ্যা কম হলেও, বিধায়কদের নিষ্ঠা ও গুণগত মান যদি ঠিক থাকে, তাহলে সরকার ও প্রশাসনকে নানাভাবে চাপে রাখা যায়।

আরও পড়ুন-শ্যামসুন্দরের নৌবিহার, কদমা বড় আকর্ষণ সম্প্রীতির রাসে

তিনি বলতেন বিধানসভা তাঁর কাছে মন্দিরের মতো। তিনি তৈরি হয়ে, পর্যাপ্ত লেখাপড়া করে, বইপত্র, তথ্য নিয়ে বিধানসভায় যেতেন। বিধানসভাকে কেন্দ্র করেই ওঁর সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা হয়, যা আজীবন ছিল। ১৯৮২-র বিধানসভা ভোটে নির্বাচিত হওয়ার পর একদিন আমাকে বললেন— ‘তুমি তো রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক। প্রথম বিধায়ক হলাম শাসকদলের সদস্য হিসাবে। তারপর মন্ত্রী হলাম। ফলে বিরোধী বিধায়কের কাজের প্রকৃতি ও নিয়মকানুন সম্পর্কে ততটা অবহিত নই।’ সত্যি কথা বলতে কি, বিধানসভার নিয়মাবলি সম্পর্কে আমিও বিশেষ অবহিত ছিলাম না। ভারতীয় সংবিধান ও রাজনীতির গবেষক হিসাবে সাধারণ ধারণা ছিল। যাই হোক, কাজ শুরু হল। যেদিন বিধানসভায় বক্তব্য থাকত, তার আগের দিন রাত্রি দশটার পর আমরা পড়াশোনা শুরু করতাম। মাঝরাত, এমনকী শেষরাত পর্যন্ত কাজ চলত। আলোচনা শেষে সুব্রতদা আমাকে বাড়িতে পৌঁছে দিতেন। আগে দুপুর একটার সময় বিধানসভার অধিবেশন বসত। সারারাত কাজ করে আবার সকাল বেলা চূড়ান্ত প্রস্তুতি নিতেন। মনে হত প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জন্য তৈরি হচ্ছেন। বিরোধী সদস্যদের হাতে যে ক’টি অস্ত্র আছে, যেমন, প্রশ্নোত্তর, দৃষ্টি আকর্ষণী প্রস্তাব, উল্লেখপর্ব, প্রভৃতির পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেছেন। প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে সরকারকে সফলভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। ভারতীয় সংসদে অনেক কেলেঙ্কারি ফাঁস হয়েছে সাংসদের প্রশ্নের মাধ্যমে। সুব্রতদার যেদিন তারকাচিহ্নিত প্রশ্ন উত্থাপিত হওয়ার কথা থাকত, তার আগের দিন আলোচনা হত মন্ত্রী কী উত্তর দিতে পারেন, সম্ভাব্য উত্তর অনুমান করে সম্ভাব্য অতিরিক্ত প্রশ্ন তৈরি করা হত। এক-একটি প্রশ্ন নিয়ে কম করে আধঘণ্টা আলোচনা চলত। অনুমান কখনও কখনও মিলে যেত। যে কোনও প্রশ্নের পেছনে প্রশ্নকর্তার নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য থাকে। চোখা-চোখা অতিরিক্ত প্রশ্ন করে মন্ত্রীকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলতেন। নাজেহাল মন্ত্রী সভায় দাঁড়িয়ে প্রতিশ্রুতি দিতেন তিনি বিষয়টি দেখবেন। বিধানসভায় মন্ত্রীর প্রতিশ্রুতির অর্থ সরকারি প্রতিশ্রুতি। বিধানসভায় একটি কমিটি আছে, যার কাজ হল সরকারের দেওয়া প্রতিশ্রুতি কতটা রক্ষিত হল, সেটি দেখা— সরকারি প্রতিশ্রুতি সম্পর্কিত কমিটি। কথা দিয়েও মন্ত্রীমহোদয়ের নিস্তার নেই। উল্লিখিত কমিটির সদস্য হিসেবে সুব্রতদা খতিয়ে দেখতেন মন্ত্রীর দেওয়া প্রতিশ্রুতি কতটা কার্যকর হল। দীর্ঘ সংসদীয় জীবনে তিনি বিধানসভার বহুসংখ্যক কমিটির সদস্য বা চেয়ারম্যান ছিলেন। যতক্ষণ কমিটির বৈঠক চলত, জরুরি কারণ ছাড়া চেয়ারম্যান হিসাবে তিনি কোনও সদস্যকে মিটিং ছেড়ে যেতে দিতেন না। কড়া প্রধান শিক্ষকের ভূমিকা ছিল। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটির (পিএসি) চেয়ারম্যান ছিলেন একাধিকবার। বিধানসভার আধিকারিকদের কাছে শুনেছি, ১৯৭০-এর পর এই ধরনের পরিশ্রমী পিএসি-র চেয়ারম্যান তাঁরা দেখেননি। বিধানসভা পরিচালনার কার্যবিধির ধারা / উপধারার বিশ্লেষণ নিয়ে সুব্রতদা মাঝে-মধ্যেই বক্তব্য রাখতেন। সমস্ত সভা মনোযোগ দিয়ে শুনতেন। এই বিষয়ে আরও একজন বরিষ্ঠ বিধায়ক পারদর্শী ছিলেন ডক্টর জয়নাল আবেদিন। সংসদের নিয়মাবলি সংক্রান্ত অনেক বই সুব্রতদা কিনেছিলেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বই হল Erskine May লিখিত ‘Parlamentary Practice’। বইটি তিনি লন্ডন থেকে কিনেছিলেন। May-র লেখা বইটি প্রতিটি সাংসদ ও বিধায়কের অবশ্যপাঠ্য। বাজেট অধিবেশনে একাধিক দফতরের বাজেট বরাদ্দ সংক্রান্ত বিতর্কের সূচনা করতেন সুব্রতদা। তাঁর বক্তব্যে শুধুমাত্র সরকারের সমালোচনা থাকত না, গঠনমূলক প্রস্তাব থাকত। ১৯৯০-এর দশকের প্রথম দিকে স্বরাষ্ট্র (কর্মিবৃন্দ ও প্রশাসনিক সংস্কার) দফতরের বাজেট-বরাদ্দ-সংক্রান্ত বিতর্কের সময় তিনি প্রশাসনিক সংস্কার-সংক্রান্ত কিছু গঠনমূলক প্রস্তাব দিয়েছিলেন। মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু বিতর্কের উত্তর দেওয়ার সময় সুব্রতদার প্রস্তাবগুলির প্রশংসা করেছিলেন এবং বলেছিলেন, এই ধরনের গঠনমূলক আলোচনা সংসদীয় গণতন্ত্রে সবসময় কাম্য। এ-ছাড়া Zero Hour-এ বিভিন্ন সরকারি বিভাগের বিভিন্ন ত্রুটি ও দুর্নীতি তথ্য-প্রমাণ-সহ তিনি তুলতেন এবং এই নিয়ে ব্যাপক গোলযোগ ও উত্তেজনার সৃষ্টি হত। শেষ পর্যন্ত মাননীয় অধ্যক্ষ বাধ্য হতেন সুব্রতদার উত্থাপিত বিষয় নিয়ে আলাদাভাবে আলোচনার সময় ধার্য করতে।

আরও পড়ুন-বিপন্ন বন্যপ্রাণী আমদানি বন্ধের নির্দেশ দিল সিআইটিইএস

‘উল্লেখপর্বে’ বিধায়কেরা জনস্বার্থ-সংক্রান্ত কোনও বিষয়ের উপর দু-তিন মিনিট বলতে পারেন। বক্তব্যের প্রতিলিপি বিধানসভার সচিবালয় থেকে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনিক বিভাগকে পাঠানো হয়, যাতে সরকার তার পর্যবেক্ষণ জানাতে পারে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সরকার বিধানসভার চিঠির উত্তর দেয় না। সুব্রতদা তাঁর উল্লেখসংক্রান্ত প্রতিটি বিষয়ের ওপর সরকারের বক্তব্য জানবার জন্য বিধানসভার সচিবালয়ের মারফত প্রশাসনকে বারবার চিঠি দিতেন এবং প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট দফতরের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করতেন। বক্তব্য না জানিয়ে সরকারের কোনও উপায় ছিল না। একটা মজার ঘটনা উল্লেখ করছি— ১৯৯০-এর দশকে বিধানসভায় রাজ্যপাল অথবা কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক নিয়ে বিতর্ক হচ্ছিল। সুব্রতদা মুখ্য বক্তা। আমার লিখিত তিনটি বই নিয়ে গিয়েছিলেন এবং আমার নাম উল্লেখ করে বইগুলি থেকে উদ্ধৃতি দিলেন। আমি বিধানসভায় একতলার দর্শকের আসনে বসেছিলাম। লক্ষ্য করলাম, জ্যোতি বসু আমার বইগুলি দেখছেন। সুব্রতদা আমার কাছে এসে বললেন, আমি ওই তিনটি বই মুখ্যমন্ত্রীকে উপহার দিতে রাজি কি না? আমি রাজি হলাম। তখন চা-পানের অবকাশ ছিল। সুব্রতদা আমাকে মুখ্যমন্ত্রীর বিধানসভার চেম্বারে নিয়ে গেলেন। আমি তাঁর হাতে বইগুলি দিলাম এবং কিছুক্ষণ কথা হল। সৌগত রায়ও ছিলেন। তারপর আমরা মুখ্যমন্ত্রীর চেম্বার থেকে বেরিয়ে এলাম এবং দেখলাম, চিত্র সাংবাদিকেরা দাঁড়িয়ে আছেন। সুব্রতদা তাঁদের ডাকলেন এবং আমাকে বললেন, চলো, আবার যাই মুখ্যমন্ত্রীর কাছে। মুখ্যমন্ত্রীর ঘরে ঢুকে তিনি বললেন, ‘বইগুলি দিন!’ জ্যোতি বসু অবাক হয়ে তাকালেন। সুব্রতদা বললেন— শিবু আপনাকে আবার বইগুলি উপহার দেবে এবং ফটো তোলা হবে। মুখ্যমন্ত্রীর মুখমণ্ডল দেখে মনে হল, উনি বেশ মজা পেয়েছেন। আবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হল।
চলে যাওয়ার কয়েক দিন আগেও সুব্রতদার আক্ষেপ ছিল। এখনকার নতুন বিধায়কদের বিধানসভার কাজে আন্তরিকতার অভাব তাঁকে পীড়িত করত। বর্তমান কালে বিরোধী বিধায়কদের রকমসকম দেখলে তাঁর দুঃখ নিশ্চিতভাবে আরও বৃদ্ধি পেত।

Latest article