দ্বিজাতিতত্ত্ব নয়, বহুত্ববাদের জয়

ভারতীয় সেনার সাফল্য কেবল সামরিক শক্তির সফলতা নয়। সোফিয়া কুরেশি ও ব্যোমিকা সিংয়ের মতো সেনা আধিকারিকের আবির্ভাব কোনও হঠাৎ আলোর চমকানি নয়। কেন? উত্তর দিচ্ছেন পার্থসারথি গুহ

Must read

কথায় বলে হিস্ট্রি রিপিটস বা ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হয়। এক্ষেত্রে অবশ্য ঐতিহাসিক বিবর্তনের সাক্ষী থাকল সমগ্র দুনিয়া। বলা ভাল ইতিহাসের ভুলকে নতুনভাবে লিপিবদ্ধ করার কাজে অগ্রসর হল গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ ভারতবর্ষ। মহম্মদ আলি জিন্না পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে যে দ্বিজাতিতত্ত্বের বিষাক্ত বীজ রোপণ করেছিলেন বহুত্বের মধ্যে ঐক্য ও সংহতিতে বিশ্বাসী গান্ধীজি-নেতাজির ভারত বুঝিয়ে দিল সে চিন্তাধারা কত সর্বনাশা ছিল।
মঙ্গলের নিশা বুধে পা দেওয়ার আগেই পাকিস্তানে একের পর এক জঙ্গিঘাঁটি গুঁড়িয়ে দেওয়া ও সাধারণ মানুষের কেশাগ্র স্পর্শ না করে অপারেশন সিদুঁরের মাধ্যমে ভারতবিরোধী জঙ্গিদের নিকেশ করার পর সেই সাফল্য উদযাপনে প্রেস ব্রিফ ওপেন করলেন ভারতীয় সেনার স্থলবিভাগের কর্নেল সোফিয়া কুরেশি এবং বায়ুসেনার উইং কমান্ডার ব্যোমিকা সিং। যোগ্য সঙ্গত করলেন বিদেশ সচিব বিক্রম মিশ্রি। যদিও সেই প্রেস ব্রিফে কখনই প্রতিহিংসার উচ্ছ্বাস বা কৃতিত্ব নেওয়ার হামবড়াই চোখে পড়ল না৷ বরং আগাগোড়া তথ্যসমৃদ্ধভাবে ভারতীয় সেনার বক্তব্য উপস্থাপিত হল। একশ্রেণির রাজনীতিবিদের ধর্মের ঢক্কানিনাদের পুরো উল্টো রাস্তায় হেঁটে ভারতীয়ত্বর বার্তা স্পষ্ট করা হল। কিছুদিন আগেও এ-রাজ্যের বিরোধী দলনেতা ভারতীয় মুসলমানদের নিয়ে যে কুৎসিত ভাষা প্রয়োগ করেছিলেন তাকেও যেন চপেটাঘাত করলেন সোফিয়া কুরেশিরা। পহেলগাঁওয়ে জঙ্গিদের বাধা দিতে গিয়ে শহিদ হওয়া সৈয়দ আদিল হুসেন বা বাংলার ভূমিপুত্র ঝন্টু আলি শেখের নাম মুছে দিতে চেয়েছিল যে ষড়যন্ত্রীরা তাদেরও কার্যত ভাগাড়ে নিক্ষেপ করা হল।
বুঝিয়ে দেওয়া হল জঙ্গিরা শুধুমাত্র জঙ্গি। তাদের সঙ্গে মানবতার কোনও যোগসূত্র কোনওদিনই ছিল না। ভারত চিরকাল সন্ত্রাসবাদের বিরোধী ছিল, আছে এবং থাকবে। ভারতীয়ত্বর হাতিয়ার মনুষ্যত্ব। যা আবহমান কাল ধরে এদেশ বহন করে চলেছে।
এদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে এপিজে আব্দুল কালামের মতো বিজ্ঞানসাধক মহাপুরুষকে যেমন আমরা পেয়েছি, তেমনই দেশের ফুটবলকে বিশ্বমানে পৌঁছে দিতে রহিম সাহেব চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। পিকে ব্যানার্জি থেকে চুনী গোস্বামীর মতো প্রবাদপ্রতিম ফুটবলাররা যে রহিম সাহেবের পিতৃস্নেহে বড় হয়ে উঠেছিলেন। ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সেই অসমসাহসী লড়াইয়ে বলিদান দিয়েছেন বহু অহিন্দু। পার্সি শ্যাম মানেক শ’র অবদান ছিল অনস্বীকার্য। ভারতীয় ক্রিকেটের অধিনায়ক হিসেবে আজহারউদ্দিন বা আজ্জু জমানাও অবিস্মরণীয়। মহম্মদ শামি, মহম্মদ সিরাজরা যেমন বিশ্বের যে কোনও শক্তির বিরুদ্ধে ভারতীয় বোলিংয়ের অক্ষশক্তি। কপিলদেবের বিশ্বকাপ জয় অধরা থেকে যেত উইকেটের পিছনে সৈয়দ কিরমানির হাত না থাকলে।
দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে অকাতরে অকুতোভয় ভারতবাসী যেমন নিজেদের প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন, স্বাধীন ভারত গড়ে ওঠার পিছনেও সেই সম্মিলিত লড়াই সামনে এসেছে। আজও সোফিয়া কুরেশিরা হলেন তার জলজ্যান্ত উদাহরণ। এভাবেই হিন্দু, মুসলমান, তামিল, তেলেগু, বাঙালি, মারাঠি, পাঞ্জাবি মিলেমিশে একাকার হয়েছে বারংবার।
অথচ সবসময় উল্টোপথে হেঁটেছে পাকিস্তান। দেশের সার্বিক উন্নতি, প্রযুক্তি, বিজ্ঞানসাধনার চেয়েও মধ্যযুগে পড়ে থাকা হয়েছে কাল। গণতন্ত্রের সুষম বিকাশ ঘটেনি। বারবার গণতন্ত্রের গলা টিপে ধরেছে সামরিক শাসন। অন্য মতালম্বীদের প্রতি সহমর্মিতা, সহনশীলতাও চোখে পড়েনি। সেজন্যই যথেষ্ট প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও পাকিস্তানের প্রথম হিন্দু ক্রিকেটার অনিল দলপত ও দানিশ কানেরিয়াকে সর্বদা বঞ্চনার শিকার হতে হয়েছে। বিশ্বজনমানসে ক্রমাবনতি হয়েছে পাকিস্তানের। ভারত এদিক থেকে বরাবর নিজস্ব গণতন্ত্র অটুট রেখে এগিয়ে চলেছে।

আরও পড়ুন-গুজবে কান দেবেন না : সিপি

মহম্মদ আলি জিন্নার দ্বিজাতিতত্ত্ব আগেও মানেনি, আজও মানে না গান্ধীজি, নেতাজি, পণ্ডিত নেহরু, সর্দার প্যাটেলের ভারতবর্ষ। বহুত্ব ও বৈচিত্র্যের মাঝেই ভারতবর্ষ মিলন মহান। পহেলগাঁওয়ের যোগ্য জবাবের পর
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি থেকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, জাতীয় কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী, সমাজবাদী পার্টির নেতা অখিলেশ সিং যাদব, বিহারের প্রবীণ আরজেডি নেতা লালুপ্রসাদ যাদব-সহ সবার কথাতেই সেই ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক ভারতের ছবি ধরা পড়েছে। ভারতীয় সেনার ভূয়সী প্রশংসা এবং জঙ্গিদমনে সর্বতোভাবে কেন্দ্রের পাশে থাকার বার্তা দলমত নির্বিশেষে প্রত্যেকের।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্স সেরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্পষ্ট বলেছেন, এই সময় কোনও বিভেদ, মতবিরোধ নেই। আমরা সবাই দেশের পক্ষে। দেশের জন্য বাংলা চিরকাল বলিদান দিয়েছে। তৃণমূল কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ও বলেছেন, এটাই ভারতের শক্তি। একইসঙ্গে সেনা অভিযানের পর কর্নেল সোফিয়া কুরেশি ও উইং কমান্ডার ব্যোমিকা সিংকে নিয়ে বিদেশ সচিব বিক্রম মিশ্রির সাংবাদিক বৈঠককে ভারতের মাটিতে বহিরাগত শক্তির বিভাজনের চেষ্টার বিরুদ্ধে ঐক্যের ছবি হিসেবে তুলে ধরেছেন অভিষেক। বস্তুত, পহেলগাঁওয়ে জঙ্গি হামলার পর সন্ত্রাসবাদের শিকড় সমূলে উৎপাটন করতে পাক অধিকৃত কাশ্মীর দখলের ডাক দিয়েছিলেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর চিন্তা যে কতটা সুদূরপ্রসারী ছিল ভারতীয় সেনার সাম্প্রতিক অভিযান সে-কথাকেই মান্যতা দিল।
কুটনৈতিক এবং সেনা ত্র্যহস্পর্শে তামাম বিশ্বের কাছে বার্তা গেল দেশের সুরক্ষা বিঘ্নিত হলে কোনও ভাবে ছেড়ে কথা বলবে না ভারত। মাত্র ২৫ মিনিটে পাক অধিকৃত কাশ্মীর এবং পাকিস্তানের মূল ভূখণ্ডে ঢুকে জইশ-ই-মহম্মদ ও লস্কর-ই-তৈবার মূল ঘাঁটি গুঁড়িয়ে দিল অত্যাধুনিক ক্ষমতাসম্পন্ন ভারতীয় মিসাইল। জইশ-ই-মহম্মদের মূল ঘাঁটিতে ভারতের সুকৌশলচিত আক্রমণে প্রাণ হারিয়েছে মাসুদ আজহারের ভাই, বোন, ভাইপো-সহ পরিবারের অধিকাংশ সদস্য। সংবাদ সূত্রে জানা গিয়েছে মাসুদ আজহার নিকট আত্মীয়দের শোকে রীতিমতো বিলাপপ্রলাপ করছেন। দিন পনেরো-ষোল আগে ঠিক এই ভয়ঙ্কর শোকাতুর পরিবেশ প্রত্যক্ষ করেছে ভূস্বর্গের পহেলগাঁও।

আরও পড়ুন-গুজবে কান দেবেন না : সিপি

পাপের ঘড়া পূর্ণ হওয়ার পর সেই পাপের তাপে আজ দগ্ধ মাসুদ আজহার। শোনা যাচ্ছে লস্কর-ই-তৈবার কর্ণধার হাফিজ সইদও খুব সঙ্গীন অবস্থায় পড়েছেন ভারতের প্রত্যাঘাতে। এটাই সমীচীন। একতরফা হামলাকারীর শেষ পরিণতি যে এমনই নিঃসঙ্গ ভয়ঙ্কর।

Latest article