এক বালক তার বাবার হাত ধরে চলেছে কলকাতায় হেঁটে। চলতে চলতে বালক দেখল রাস্তার ধারে ধারে বাটনাবাটা শিল। বাবাকে জিজ্ঞাসা করে, ‘‘বাবা রাস্তার ধারে শিল পোঁতা কেন?” বাবা জবাব দিলেন ‘‘ওগুলো মাইলস্টোন।” আর বুঝিয়ে দিলেন ‘মাইল মানে হল আধ ক্রোশ আর স্টোন হল পাথর। আধ ক্রোশ পরপর এইরকম একটা করে পাথর বসানো। ওটা হল দূরত্বের চিহ্ন। কলকাতার এক মাইল দূরে যে পাথর তাতে এক লেখা আছে, এটাতে ১৯। মানে হল আমরা কলকাতা থেকে ১৯ মাইল দূরে আছি।’ সবকিছু দেখেশুনে বালক বলল ‘‘এটা তবে ইংরেজির এক, এটা ৯?” বালক মনে মনে ঠিক করে নিল, এইভাবে সে ইংরেজি অংক শিখে নেবে। শুনে বাবা বললেন, ‘‘বল এটা কত?” বালকের উত্তর ‘‘নয়”। বাবা পরের মাইলস্টোনের কাছে এসে জিজ্ঞাসা করলেন ‘‘বল এটা কত?” বালকের জবাব আট। বাবা ভাবলেন ছেলে আন্দাজে বলছেন। উল্টোদিক থেকে পর পর বলে যাচ্ছে সংখ্যা। তিনি একটু চালাকির আশ্রয় নিলেন। বালককে ছয়ের মাইলস্টোন না দেখিয়ে তাড়াতাড়ি একেবারে ৫ এর অংকে এনে ফেললেন। ছেলেকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘‘বল এটা কত?” ছেলে বিলম্ব না করে বললে ‘‘বাবা এটা হবে ছয় কিন্তু ভুলে লিখেছে পাঁচ।” বাবা অত্যন্ত প্রীত হলেন। বুঝলেন ছেলে একটা তুখোড় ছেলে হবে। সেই বালকটির নাম ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। বাবা হলেন ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। মা ভগবতী দেবী। এই বালকই হয়ে উঠলেন সকলের প্রিয় শ্রদ্ধার মানুষ বিদ্যাসাগর।
আরও পড়ুন-প্রয়াত নির্মলা
এক সময়, বিশেষ করে বাংলা ছবির সুবর্ণ যুগে (৫০, ৬০, ৭০-এর দশক) বাংলার বিশিষ্ট মানুষদের নিয়ে অজস্র ছবি নির্মিত হয়েছে। শ্রীরামকৃষ্ণ ও মহাপ্রভুকে নিয়ে বহুবার হয়েছে। এছাড়া বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস থেকে শুরু করে মধুসূদন, রাসমণি, গিরিশচন্দ্র, নিবেদিতা, রামমোহন, সুভাষচন্দ্র, চিত্তরঞ্জন, বিবেকানন্দ, মুকুন্দদাস, অরবিন্দ-সহ বাংলার প্রণম্য সকলের জীবন নিয়ে তৈরি হয়েছিল জীবনী চিত্রগুলি। সেখানে বিদ্যাসাগরের জীবনকথা বড় পর্দায় উঠে আসবে না তাই হয়? সেই কাজটি করতে এগিয়ে এলেন স্বনামধন্য পরিচালক কালীপ্রসাদ ঘোষ। এম পি প্রোডাকশনের ব্যানারে ছবিটি তৈরি হল। এই ছবিতে বিদ্যাসাগরের বাল্য অবস্থা থেকেই কাহিনি অগ্রসর হয়েছে। ছবির নাম ‘বিদ্যাসাগর’। ছবিতে অভিনয় করেছেন অহীন্দ্র চৌধুরি (ঠাকুরদাস), মলিনা দেবী (ভগবতী দেবী), সন্তোষ সিংহ (বাচস্পতি), উৎপল দত্ত (মধুসূদন), গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায় (শ্রীরামকৃষ্ণ), অনুপকুমার (কালীপ্রসন্ন সিংহ), কমল মিত্র (কৃষ্ণমোহন)। নাম ভূমিকার শিল্পী পাহাড়ী সান্যাল। তিনি যেন চরিত্রটিতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করলেন। বিদ্যাসাগরের চরিত্রের দৃঢ়তা আবার পাশাপাশি নমনীয়তা সবকিছু শিল্পীর অভিনয়ে মূর্ত হয়ে উঠেছে। শিল্পীর মেকআপ হয়েছিল চমৎকার। কৃতিত্ব অবশ্যই মেকাপম্যান বসির আহমেদের প্রাপ্য। এছাড়াও এ ছবিতে কাজ করেছেন ছবি বিশ্বাস, রেণুকা রায়, হরিধন মুখোপাধ্যায়, রণজিৎ রায় প্রমুখ শিল্পীরা।
আরও পড়ুন-দুয়ারে প্রশাসন মুশকিল আসান জেলাশাসক
এই ছবিতে রবীন চট্টোপাধ্যায় সুরে দুটি গান রয়েছে। প্রথমটি গেয়েছেন আলপনা বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য আলপনা এই ছবিতেই প্রথম রেকর্ড করার সুযোগ পান। গানটি হল ‘‘মাটির ঘরে আজ নেমেছে চাঁদ রে আজ নেমেছে চাঁদ” আর দ্বিতীয় গানটি ছবির প্রায় শেষের দিকে অভিনেতা রঞ্জিত রায়ের মুখে। তিনি দলবল নিয়ে বিদ্যাসাগরের প্রশস্তিমূলক গানটি গাইলেন ‘‘বেঁচে থাকো বিদ্যাসাগর চিরজীবী হয়ে”। ১৯৫০ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর ছবিটি মুক্তি পায় উত্তরা-পূরবী-উজ্জ্বলা চেইনে। সুপারহিট ছবি। দর্শক ও সমালোচক প্রশংসাধন্য এ ছবি। ছবির শেষ দৃশ্য ছিল ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ এসেছেন বিদ্যাসাগরের বাড়িতে। তাঁদের বিখ্যাত সংলাপের মধ্য দিয়ে মূল কাহিনি শেষ হয়েছে ছবিতে যেখানে ঠাকুর (গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়) বিদ্যাসাগরকে (পাহাড়ী সান্যাল) বলছেন, ‘‘তুমি কি অবিদ্যার সাগর? বিদ্যারসাগর। সিদ্ধপুরুষ।”
আরও পড়ুন-শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে পদক্ষেপ, বৈঠক ডাকলেন ব্রাত্য
বিদ্যাসাগর যখন লেখালেখির জন্য কলম ধরলেন তখন বেশ কয়েকটি গ্রন্থের তিনি অনুবাদ করলেন। তার মধ্যে একটি অনুবাদ হল বিখ্যাত ইংরেজ নাট্যকার উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের লেখা ‘‘কমেডি অফ এররস”- এর অনুবাদ ‘‘ভ্রান্তিবিলাস”। আক্ষরিক অনুবাদ কখনওই বলা যাবে না। মূলটি ছিল নাটক। বিদ্যাসাগর তা গদ্যে রূপান্তরিত করেছিলেন। এমন সরল ভাবে অনুবাদ করেছিলেন যা পাঠকের কাছে অত্যন্ত উপভোগ্য হয়ে উঠেছে। তাছাড়া গল্পের মধ্যেই আছে মজার মজার সব ঘটনা। দুই ভাই চিরঞ্জীব এবং চিরঞ্জিত যমজ। কিন্তু জন্ম সূত্রে তারা বিচ্ছিন্ন। দুজন মানুষ দু-জায়গায় বড় হয়ে উঠেছেন। তাদের সহযোগিতা করার জন্য দুই ভৃত্য। তারাও যমজ। শক্তিকিংকর ও ভক্তিকিংকর। চিরঞ্জীবের সঙ্গে শক্তিকিংকর আর চিরঞ্জিতের সঙ্গে ভক্তিকিঙ্কর। চিরঞ্জীব বিবাহিত। ঘরে তাঁর সুন্দরী স্ত্রী লাবণ্যপ্রভা আছেন আর আছেন শ্যালিকা বিলাসিনী। ঘটনাচক্রে এরা সবাই মফসসল শহরে উপস্থিত, তখন ধুন্দুমার কাণ্ডের সূত্রপাত। মানুষেরা চিরঞ্জীবকে চিরঞ্জিত আবার অন্যদিকে চিরঞ্জিতকে মনে করছেন চিরঞ্জীব। এর জন্য স্বামীকে বাড়িতে ঢুকতে দেননি লাবণ্য। কাজের বৌ পর্যন্ত প্ররোচিত করেছে লাবণ্যপ্রভাকে। তবে সব ভাল যার শেষ ভাল। চিরঞ্জীব ও চিরঞ্জিত খুঁজে পেয়েছেন তাঁদের মাকে। অবিবাহিত চিরঞ্জিত-এর সঙ্গে বিবাহ সম্পাদিত হয়েছে বিলাসিনীর।
আরও পড়ুন-কাঁচের ঘরে বসে ঢিল ছুঁড়বেন না, আপ্তসহায়কের বাজেয়াপ্ত টাকার হিসাব দিন দিলীপ
এমন মধুর গল্প নিয়ে মহানায়ক উত্তমকুমার প্রযোজনা করলেন ‘‘ভ্রান্তিবিলাস” ছবিটি। পরিচালক মানু সেন। চিত্রনাট্যকার বিধায়ক ভট্টাচার্য। উত্তমকুমার দ্বৈত চরিত্রে (চিরঞ্জীব ও চিরঞ্জিত) ভানু বন্দোপাধ্যায় দ্বৈত চরিত্রে (শক্তিকিংকর ও ভক্তিকিংকর) এমন অভিনয় করলেন যে দর্শকেরা কোনওদিন ভুলতে পারবেন না। লাবণ্যপ্রভা সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়, বিলাসিনী সন্ধ্যা রায়, মা ছায়া দেবী, স্যাঁকরার চরিত্রে বিধায়ক ভট্টাচার্য। অন্যান্য ভূমিকায় তরুণকুমার, সবিতা বসু, লীলাবতী করালি প্রমুখ শিল্পীরা ছিলেন। শ্যামল মিত্রের সুরে বিলাসিনীর মুখের গানটি গেয়েছেন গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ‘‘তুমি কি সে তুমি নও”, এ-ছাড়া চিরঞ্জিত যখন বন্ধনদশা থেকে পালাচ্ছেন তখন বাউলের কণ্ঠের গানটি গেয়েছেন শ্যামল মিত্র ‘‘সেই বাসর নেই বাঁশরী নেই ভোর যে হয়ে গেল”। পুতুলনাচের গানটি গেয়েছেন ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য ও নির্মলা মিশ্র।
আরও পড়ুন-নবান্নে নিরাপত্তা: বসছে স্মার্ট গেট, ঢুকতে বিশেষ কার্ড
ইতিপূর্বে উত্তমকুমার আলোছায়া প্রোডাকশনের ব্যানারে দুটি ছবি প্রযোজনা করেছিলেন ‘‘হারানো সুর” এবং ‘‘সপ্তপদী”। উত্তমকুমার ফিল্মস প্রাইভেট লিমিটেডের ব্যানারে উত্তমকুমার প্রযোজিত প্রথম ছবিটি হল ‘‘ভ্রান্তিবিলাস”। ছবিটি মুক্তি পেল ১৯৬৩ সালের ৩১ মে রূপবাণী, অরুণা, ভারতী চেইনে। দমফাটা হাসির ছবি। সুপার ডুপার হিট ছবি। ছবিটি বিদ্যাসাগরকে উৎসর্গ করা হয়েছিল। অনেক সময় জনপ্রিয় ছবি রিমেক হয়ে থাকে কিন্তু ‘‘ভ্রান্তিবিলাস” ছবির রিমেক করতে কেউ এখন পর্যন্ত সাহস করেননি। বাংলা হাস্যরসের ছবির জায়গায় ‘‘ভ্রান্তিবিলাস” বিশিষ্ট স্থান করে নিয়েছে।